রাবণ জানতেন
যতই গণ্ডি কেটে দিয়ে যাক লক্ষ্মণেরা
আমি ঠিক তার বাইরে বের করে আনব তোমাকে
দু’বাহুতে বন্দি করে রাখব।
সূর্পণখার নাক কেটে দিয়েছে দেখে
রাবণ সীতাকে হরণ করেননি
তিনি ভাল করেই জানতেন
ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনও নারীকে ছুঁলেই
তাঁর ন’টা মুণ্ডুই তৎক্ষণাৎ খসে যাবে।
ফলে আপনারা যা ভাবছেন, সে মতলবেও নয়,
রাবণ জানতেন
সীতা আসলে লক্ষ্মী
লক্ষ্মীকে নিজের রাজ্যে রাখতে পারলে
ধন-সম্পদ-শস্যে উপচে পড়বে দেশ
তাই শুধুমাত্র প্রজাদের মঙ্গলের জন্যই
তিনি সীতাকে হরণ করেছিলেন।
যতই গণ্ডি কেটে দিয়ে যাক লক্ষ্মণেরা
আমি তার বাইরে ঠিক বের করে আনব তোমাকে
দু’বাহুতে বন্দি করে রাখব।
আমার ঘর নিষ্প্রদীপ, মলিন
তুমি থাকলে ঝলমল করে উঠবে ঘর
এবং দুয়ার।
টোকা
দরজা না হয় না-ই খুললে জানালাটা তো খুলবে
পৃথিবী তোমাকে এত ভালবেসে নিয়ে এসেছে
তুমি তাকে একটুও আদর করবে না!
যে ভালবাসতে জানে না
সে কখনও কচুরিপানায় রঙের বাহার দেখতে পারে না
যে ভালবাসতে জানে না
তার কোলে কখনও কোনও শিশু খিলখিল করে হাসে না
আকাশের বুকে মেঘের লুকোচুরি তার নজরে পড়ে না
পাখিদের সঙ্গে সে কথা বলতে পারে না
ঝর্নার তান তার শরীরে কোনও দোলা জাগায় না
কচি কচি ঘাস তাকে ইশারায় ডাকে না
যে ভালবাসতে জানে না
তার সঙ্গে তার ছায়াও হাঁটে না।
পৃথিবী এত ভালবেসে তোমাকে নিয়ে এসেছে
দরজা না হয় না-ই খুললে জানালাটা তো খুলবে।
সব সময় কি আর ডাকাত টোকা মারে?
মাঝে মাঝে মুশাফিরও আসে
কখন কোন বালক তোমার বইয়ের ব্যাগে একটা চিরকুট রেখে গেছে
তুমি তা না দেখেই ফেলে দিচ্ছ!
বর্ষাদিন
আমাকে দেখলে ও ভাবে মুখ ফিরিয়ে নাও কেন?
আকাশে রামধনু উঠলে সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে
রামধনু কাউকে বলে না—
তাকিয়ে আছ কেন গো?
পুকুরে থোকা-থোকা কচুরিপানা ফুটলে
তার ছটা সকলের নজর কাড়ে
কেউ করে পা ডুবিয়ে জল থেকে তুলে আনে একটা-দুটো,র
কাউকে অপছন্দ হলেও
একটু তফাতে সরে গিয়ে কখনও কচুরিপানা বলে না—
আমাকে একদম ছোঁবে না।
ঝলসে যাওয়া পৃথিবীতে যখন ঝিরঝির করে বর্ষা নামে
সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে
বর্ষা কাউকে বিমুখ করে না।
তুমি স্কুলবাসে যাও, আসো
মাঝে মাঝেই দাঁড়াও ঝুল-বারান্দায়
আমাকে দেখলে ও ভাবে মুখ ফিরিয়ে নাও কেন?
অভিমন্যু
অভিমন্যু, তুমি অনায়াসে ওদের কব্জা করতে পারতে
জন্মানোর আগেই তো যুদ্ধে জেতার সব কৌশল
তোমার জানা হয়ে গিয়েছিল
শুধু চক্রব্যূহ থেকে বেরোনোর পথ ছাড়া
তাই সাত-সাতজন অশ্বারোহী…
তুমি তখন একা ছিলে
এখন এখানে আমরা প্রত্যেকেই এক-একজন অভিমন্যু
মাকে বউকে ছেলেকে ছক কষে দিচ্ছে
উঠোনে আলাদা আলাদা খুপরি তুলে থাকার
চোখ বেঁধে দিয়ে যে যেমন পারছে খোবলাচ্ছে
ঘোর অমাবস্যায় করছে যাগযজ্ঞ, তুকতাক।
এই চক্রব্যূহ থেকে বেরোনোর মন্ত্র আমরাও জানি না অভিমন্যু
সাত নয়, সাতশো অশ্বারোহীর সঙ্গে আমরা লড়াই করছি সারাক্ষণ
আমাদের কথা কি কেউ একটা পোস্টকার্ডেও লিখবে না।
সাক্ষী আছে
আপনার সঙ্গে আমার কত নিবিড় মাখামাখি
সে সবের সাক্ষী আছে আপনাদের খসে খসে পড়া বাড়ির
পুরনো ইট, কড়িবরগা, দেওয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা বট-অশ্বত্থ
সাক্ষী আছে— জানালা দিয়ে উঁকি মারা ঝিকিমিকি তারা
ভোরের নরম আলো
সাক্ষী আছে— শান্তিনিকেতনের সেই হোটেলের বিছানা।
দু’জন দু’জনকে রাঙিয়ে দেওয়া আবির
সুন্দরবনের সেই দু’রাত তিন দিনের ট্যুর
সাক্ষী আছে— কলেজ স্ট্রিটের আদি মোহিনীমোহন কাঞ্জিলাল
নন্দন চত্বর, চার চাকার লুকিং গ্লাস
সাক্ষী আছে— দক্ষিণেশ্বর
ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্সের সুনীলদার বাড়ির লিফট
দিঘার আছড়ে পড়া এক-একটা ঢেউ
সাক্ষী আছে, সাক্ষী আছে, সাক্ষী আছে।
ওরা দেখেছে, এগুলো আপনার সঙ্গে বারবার ঘটেছে, বারবার
শুধু আমার জায়গায় ও
ও-র জায়গায় সে
আর সে-র জায়গায় অন্য কেউ
অন্য কেউ
অন্য কেউ…
শিক্ষা
ক্লাস টু-এ উঠেই ছেলে বলল, পৃথিবীর তিন ভাগ জল
বাবা, তুমি আমাকে সাঁতারে ভর্তি করে দাও।
দিলাম।
চোদ্দো পেরোতে না-পেরোতেই মেয়ে বলল,
বাবা, রাস্তাঘাটের ছেলেরা যা হয়েছে
আমি কুংফু-ক্যারাটে শিখব।
বললাম, শেখো।
বাজারে সেরে এসে বউ বলল, জিনিসপত্রের যা দাম
ভাবছি, উঠোনের ও দিকটায় সবজি লাগাব।
আমি বললাম, লাগাও।
ছেলে সাঁতার শেখে
মেয়ে কুংফু-ক্যারাটে
আর বউ সবজি ফলায়।
সন্ধেবেলায় মায়ের মহাভারত পাঠ শুনতে শুনতে
হঠাৎ মনে হল, গোটা দেশটাই কুরুক্ষেত্র, গোটা পৃথিবীটাই…
কিন্তু এই বয়সে আমি কি আর যুদ্ধের তালিম নিতে পারব!