হঠাৎ করেই ফোন এলো মহেশখালি দ্বীপ থেকে, তরুণ কবি সাইয়্যীদ মঞ্জুর ফোন। মহেশখালির সর্বদক্ষিণে যে দ্বীপ, সেই সোনাদিয়া দ্বীপে তারা কবি হাফিজ রশিদ খানের জন্মদিন উদযাপন করবে। জন্মদিন তো কত জায়গাতেই উদযাপিত হয়, কিন্তু বঙ্গোপসাগরের কোলে একটি দ্বীপে জন্মদিন উদযাপনের আয়োজন অভিনব বটে। এ কেবল ওই তরুণ কবিদের অগ্রজ কবি হাফিজ রশিদ খানের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাই প্রকাশ করে না, প্রকাশ করে তাদের সৃজনশীলতাও। অবশ্য মহেশখালির বাহুলগ্ন থাকার কারণে চিন্তাটি সম্ভব হয়েছে।
কদিন ধরেই শান্ত বলছিল, বাবা, আমাকে কক্সবাজারে বেড়াতে নিয়ে যাও। এই তাগাদার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা হলো গত ফেব্রুয়ারিতে আমরা যখন পরিবারের প্রায় সবাইকে নিয়ে কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিন বেড়াতে যাই, শান্ত তখন যেতে পারেনি মেডিকেল কলেজে ওর পরীক্ষার কারণে। তাই ওর দাবিটি যৌক্তিক। শুনে প্রান্ত বল্ল, ‘বাবা, আমিও যাব।’ তখন প্লান করি কক্সবাজারে আসার। এমনকি রাজারবাগ গিয়ে গ্রীণলাইন কাউন্টার থেকে ডাবল ডেকার বাসের আপার ডেকের তিনটি টিকেট কেটে আনি। এর মাঝে ওই আমন্ত্রণটি আসায় ভাবি দুটোকে এক করবো। আমি যে দিনটি সোনাদিয়া থাকব, সেদিন দুভাই কক্সবাজারে থাকবে। যেন তারা হোটেলেই আনন্দিত থাকে তাই তাদের একটি পাঁচ তারকা হোটেলে রাখবো। কক্সবাজারে একটি পাঁচ তারকা হোটেলই আমি চিনি- হোটেল কক্স টু-ডে। তৎক্ষণাৎ মহিউদ্দিন খান খোকন ভাইকে ফোন করে জানতে পারি কক্সবাজারে লকডাউন চলছে, হোটেল কক্স টুডে তো বন্ধই, সব হোটেলই ব্ন্ধ। সী বিচেও কাউকে যেতে দিচ্ছে না প্রশাসন। গুগলে সার্চ দিয়ে দেখি ২২ জুন থেকে ২৯ জুন বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা। এমন অবস্থায় ছেলেদের নিয়ে বিপদের মুখে পড়ার কোনো ইচ্ছে নেই। টিকেটগুলো বাতিল করে দেই।
ওদিকে সাইয়্যীদ মঞ্জু বারংবার আহবান জানাচ্ছে, কমপক্ষে আমি যেন যাই। হাফিজ রশিদ খানও তাই চাচ্ছেন। আমাকে বললেন বর্ষায় সোনাদিয়ার রূপ খোলে, অন্য প্রকৃতি, ভিন্ন চেহারা। শীতকালে এই সৌন্দর্য দেখা যায় না। হাফিজ রশিদ খান আমাকে এমনও বলেন যে সম্ভবত আমরাই হবো সর্বশেষ কবি যারা সোনাদিয়াকে তার প্রাকৃতিকরূপে দেখতে পাবে। কেননা সরকার দ্বীপটিতে বিবিধ স্থাপনা নির্মাণ করে এর কৌমার্য হরণ করবে। লোভনীয় প্রস্তাব। এই আলাপনের সময়টায় আমার সমুখে ছিলেন ‘নিসর্গ’ সম্পাদক সরকার আশরাফ। তিনি আমাকে উৎসাহিত করেন যেতে। আমি বলি, তাহলে চলুন দুজনে মিলে যাই। তিনি রাজী হলেন, কিন্তু অফিস থেকে ছুটি পেলেন না। তখন এ্যাপ্রোচ করি আরেক হাফিজ – মাহমুদ হাফিজকে। তিনি রাজি। বললেন, এটা একটা লাইফটাইম অপরচুনিটি। কিন্তু দুর্ভাগ্য তিনি সর্দিজ্বরে আক্রান্ত হলেন। শেষাবধি আমি একাই হয়ে রইলাম, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।’
ফের সেই গ্রীনলাইন ডাবলডেকারে, এবার আর রাজারবাগ যাই না, অনলাইনে টিকেট কিনি।করোনাকালে সেটাই নিরাপদ। টিকেট না হয় কাটলাম, কক্সবাজারে গিয়ে উঠবো কোথায়, হোটেল তো সব বন্ধ। হঠাৎ মনে পড়লো এই তো কিছুূূদিন আগে কথা সাহিত্যিক ঝর্না রহমান সপরিবারে কক্সবাজার ঘুরে এলেন। তার বেয়াই হলেন এয়ারফোর্সের একজন এয়ার ভাইস মার্শাল। ভীষণ উঁচু পদ। তারা ছিলেন এয়ারফোর্সের গেস্টহাউজে। ঝর্না আপাকে ফোন করতে তিনি বল্লেন, নতুন বেয়াই, তিনি বারবার বিরক্ত করতে চান না। যদিও জানি এয়ার ভাইস মার্শালের একটি ফোনই যথেষ্ট, তবু আমি তো আসলে রবাহুত। এই সংকটে এগিয়ে আসেন চির শুভাকাঙ্ক্ষী বহু কাজের কাজী মাহমুদ হাফিজ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২/৩ বছর সিনিয়র এক ভাইকে ফোন দিলেন, যিনি পিডিবির একজন ডিরেক্টর। Equivalence করা হয়তো যাবে না, তবে বিমানবাহিনীতে এয়ার ভাইস মার্শাল যা করতে পারেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালকও তা করতে পারেন। আর তা হলো একজন উটকো অতিথিকে গেস্ট হাউজে রুম দিতে পারেন। ক্ষমতা বিচারের এ তুলনায় তারা equivalent।
যেদিন রাতে আমার ফ্লাইট বাই রোড সেদিন গ্রীনলাইন পরিবহন থেকে ফোন এলো, আমার ৩১০ নাম্বার সিরিয়াল বাসটি যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য বাতিল করা হয়েছে। আমি বল্লাম, যান্ত্রিক গোলযোগ নাকি যাত্রী সংকট? নারীকণ্ঠ দ্রুত বল্ল, আপনার সিট অপরিবর্তিত থাকবে, শুধু বাস নাম্বার ৩১৩ হবে। বাস ছাড়বে রাত ১০: ৪৫ এ, আমি যেন ১০:৩০ এর ভেতর আমার নির্ধারিত বাস স্টেশনে রাজারবাগে থাকি। আমি সতর্ক, ঠিক নটায় উবারে চড়ি। শান্ত প্রান্তকে প্রতিশ্রতি দেই লকডাউন উঠে গেলে আমি দুভাইকে কক্সবাজারে বেড়াতে নিয়ে যাব। লুবনা বল্ল, এত বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়। বাড়াবাড়ি হলো সোনাদিয়া দ্বীপে যাওয়া।
উবার ড্রাইভাররা, আমি দেখেছি, এমনিতে চুপচাপ থাকবে। যেই না আপনি কিছু জিজ্ঞেস করেছেন, অমনি গল্পের ভাণ্ডার খুলে দিবে। আমি যাচ্ছি দূরপাল্লার নৈশকোচ ধরতে, সে আমাকে শোনায় তার চোখের সামনে ঘটা এক দুর্ঘটনার কাহিনী, বাস-মিনিবাস মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের ১৪ জন নিহত হওয়ার ভয়ঙ্কর ঘটনা। বাসের ড্রাইভার নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে যাই হোক, শুভযাত্রায় অশুভ সংবাদ শোনা মঙ্গলকর নয়। ড্রাইভারের নাম মিজান, বাড়ি পাবনা। সে যখন নিহত আহত মানুষদের সংখ্যা বলছিল তিনজন না বলে তিনটা, চারজন না বলে চারটা বলছিল। আমি তার রুট ঠিক করে দেই, জাহাঙ্গীর গেট দিয়ে বেরিয়ে বিজয় সরণি-তেজগাঁও সংযোগকারী ফ্লাইওভার দিয়ে ওপাশে গিয়ে মগবাজারমুখী ফ্লাইওভারে চড়া। সে প্রথমত জাহাঙ্গীর গেট দিয়ে যেতে ভীত, সেনারা যদি কিছু বলে, দ্বিতীয়ত, তেজগাঁ গিয়ে পথঘাট দেখে বিস্ময় লুকাতে পারে না। এ এলাকায় নাকি সে কখনোই আসেনি। মগবাজারে ফ্লাইওভারে এই প্রথম উঠলে অথচ উবার বলছে সে নাকি ৫০০০+ জার্নি সমাপ্ত করেছে ৫ বা তার চেয়ে বেশি পয়েন্ট পেয়ে। ওরকম ভয়ঙ্কর গল্প বলে, পথঘাট না চিনে? আশ্চর্য! তার শেষ বাক্য ছিল, স্যার নিচ দিয়ে যাব, নাকি ফ্লাইওভারে উঠব?
গ্রীনলাইন কাউন্টারে এসে ই-টিকেট দেখালে একজন সেলসম্যান আমাকে টিকেটের প্রিন্ট আউট বের করে দেয়। সেদিন সকালে টিকেট কিনতে এসে দেখেছিলাম পাঁচ কাউন্টারে চার নারী, এক পুরুষ; এখন রাত্রিতে এসে দেখি উল্টো চিত্র, চার পুরুষ, এক নারী। টিকেট নিয়ে কাচের ওপাশে যাত্রী অপেক্ষার লাউঞ্জে এসে দেখি ফাঁকা ফাঁকা। পরিবারের সাথে যেবার কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিন বেড়াতে গিয়েছিলাম সেবার ছিল বিপরীত চিত্র। ডাবলডেকার এলো কলাবাগান থেকে ঠিক সময়েই, লাল ব্যাগটি তার পেটের ভেতর চালান করে দিয়ে আমি সমুখের দরোজার সন্নিকট থেকেই ওঠা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যাই। সিঁড়িগুলো কার্পেটে মোড়ানো, লাল ফিতে বাতিতে প্রজ্বলিত। একটা ভিআইপি ভাব এসে যায় সে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে। আমার সিট নম্বর ডি৩।
রাতের গাড়ি মানে যাত্রীরা ঘুমাবে, যাতে কাল প্রাতে ঝরঝরে হয়ে সমুদ্রসৈকত নগরীতে নামা যায়। আমারও তেমনই অভিপ্রায়, তবে অত দ্রুত নয়। সিট সোজা রেখে পর্দা সরিয়ে কম আলো, বেশি অন্ধকার বাইরেটা দেখি। দিনের চেনা পৃথিবীটা রাতে কেমন বদলে যায়। আমাকে যা অবাক করে তা হলো মধ্যরাত ছুঁই সময়েও মানুষের কর্মব্যস্ততা, বিশেষ করে ফল ও মাছ বিক্রি। ভাবি অতরাতে কারা ফল ও মাছ কেনে? কাঁচপুর ব্রিজ এলে শীতলক্ষ্যা ও তার বুকে ভাসমান বা নোঙড় করা জলযানগুলো, দুপারের কারখানাগুলো চোখে পড়ে। আমার সামনের যাত্রী তার সিট নব্বই ডিগ্রি খাড়া থেকে ক্রমান্বয়ে ৬০ ডিগ্রি ও ৪৫ ডিগ্রি হেলিয়ে দিলে আমার মাথা ও তার মাথা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিধি লঙ্ঘন করে, কারণ আমি তো তখনো নব্বইয়ে। মৃদু প্রতিরোধ তুলতেই সেও নব্বই ডিগ্রি টানটান। বেশ ভদ্র যুবকটি। আমি বলি, ষাট পর্যন্ত ঠিক আছে। পরে আমি যখন ঘুমের আয়োজন করছি দেখি আমিও ৪৫ ডিগ্রি হেলতে পারি, কেননা আমার পেছনের সিটে কেউ নেই। গ্রিনলাইন কোম্পানি করোনার সরকারিকরণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে তিন কলামের মাঝের কলামটি অর্থাৎ ২ নম্বর কলাম বিক্রি করেনি, দম্পতি বা যুগল হলেও নয়। তা বাসে উঠে যুগলরা সে বিধি মানবে কেন? E-row এর যুগল ১ নম্বর সিটকে গুডবাই বলে ২ ও ৩ নম্বরে গিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়েছে। আমি তখন সমুখের যুবাকে বলি, আপনি ৪৫ ডিগ্রি (এই কৌণিক অভিক্ষেপে মিসাইল বা বর্শা সবচেয়ে বেশিদূর যায়) চিৎ হতে পারেন, কারণ আমিও তো তাই হয়েছি। মধ্যরাতে বাসের ঘুমন্ত যাত্রীরা সব মিসাইল হয়ে ঘুম ও স্বপ্নের সম্ভাব্য দূরত্বে পাড়ি দেয়।
(চলবে)