গল্প: মহারাজ নিধন

ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
36 মিনিটে পড়ুন

।।এক।।

মাচা থেকে ধীর পায়ে নিচে নেমে এল দুলাল। রোদে পিঠ রেখে পশ্চিম দিকে মুখ। দূরে কাজ করছিল এক দল লেবার। সামনে ঈষৎ ঝুঁকে ওদের কাজে নজরদাড়ি চালাল দুলাল। দু’এক পা এগিয়ে গেল। পায়ের ভারি জুতোয় চাপা পড়ল পান্না-সবুজ হিমেল ঘাস। চার পাশের ভেজা ঘাসে নরম রোদের রুপালী ঝিলিক। চক চক করছে বনানী। বিদায়ী শিতের বাতাসে গাছের ডালে ডালে হরেক পাখির কিচমিচ। গুলমোহরের উঁচু ডালে নিঃসঙ্গ ময়ূরের কেকাধ্বনী। সব ছাপিয়ে গাছ কাটার একঘেয়ে আওয়াজ উঠছে, খটাস খটাস খট।
শাল গাছের শক্ত গোড়ায় ভারী কুড়ুলের কোপ মারছে লেবারের দল। গাছের মাথায় শক্ত দড়ি বেঁধে পাশ থেকে টান রেখেছে তিন-চার জন। সবার কপাল পিঠ হাতের পেশি চুঁইয়ে ঝরছে রূপালি স্বেদ। ওদিকে পলক তাকিয়ে আরেকটু সামনে এগোল দুলাল। এবার আরও স্পষ্ট দেখা গেল। কয়েক হাত দূরে বড় শাল গাছের লাইন। সার দিয়ে গাছ কাটছে সাত-আট জন। তিনশো একরের বড় বিটে রাস্তা লাগোয়া অংশে ট্রি ফেলিং চলছে।
মাঝে মাঝে গলার শিরা ফুলিয়ে দুলালের।হুঙ্কার। লেবাররা কাজে ফাঁকি মারবে, সহ্য হয় না ওর। দুলাল চন্দ্র দাস কাজের মানুষ। বন দফতরের অফিস কুলি-মহল্লা লোথাবাড়ি বস্তী একডাকে চেনে। জংগলের কোর এলাকায় পরপর অনেক গুলো কাজ করে নাম কিনেছে। এবার তেইশ নম্বর বিটে জঙ্গলের গভীর এরিয়ায় কাজ। বারবার সাবধান করে বিট অফিসার বলেছিলেন, ‘ডেঞ্জারাস এলাকা। বি কেয়ারফুল।’
দুলালের পরিচিত এলাকা এটা। পূর্ব দিক বরাবর কালজানি নদী। ভুটান পাহাড়ের তোর্ষা চূ ডুয়ার্সে নেমে কালজানি। নদীর চওড়া বুক। বালিয়াড়ির মাঝখানে চিকন জলের ধারা। বছর ভর শুখা। শুধু পাহাড়ে বর্ষার ঢল নামলেই মরা নদী চাগিয়ে ওঠে। উতলা নদীর বুকে তখন বাঘের গর্জন। হরপা বান চমকে দেয় উত্তরের দলসিংপাড়া হাসিমাড়া। আরও উত্তরে ভুটান পাহাড়। দক্ষিণে বানিয়া মথুরা চা-বাগান। পূর্ব দিকের লতাবাড়ি ভাতখাওয়া আর পশ্চিমে মান্দাবাড়ি।
সংরক্ষিত অরণ্যে কঠোর আইন মোতাবেক প্রবেশ নিষেধ। দুশো বিশ বর্গ কিলোমিটার পরিধি জুড়ে গণ্ডার হাতি বাইসন চিতা সাপ আর দাঁতালের বিচরণ। সরকারি কাজে দিনের বেলা লেবার-কনট্রাকটাররা ঢুকতে পারে। এন্ট্রি গেটে বিট অফিসের পারমিট দেখিয়ে ফরেস্ট গার্ড সাথে নিয়ে জঙ্গলে চলতে হয়। রেঞ্জারের নেতৃত্বে চার বছর আগে বিটে লাগানো হয়েছিল হাইব্রিড শাল। ওগুলোর ভালো দর উঠেছে। এবার বর্ষা নামবার অনেক আগে পরিমিত জঙ্গল সাফাইয়ের কাজ। বিট অফিসের নম্বর লটকানো সাতাত্তরটা পুরানো গাছ কাটতে হবে। গাছ কাটতে মান্দাবাড়ি আর কোদাল বস্তী থেকে দুলালের কথা মত পুরুষ লেবারদের পাঠিয়েছে লেবার কনট্র্যাকটার। মেটেলির নাগেশ্বর প্রসাদ। বারবার বলেছিল নাগেশ্বরকে, ‘ঝেঁটিয়ে সব কটা লেবারকে পাঠাবেন। যেন একটা ছেলেও বাদ না-থাকে।’
হিসাবী চাহনিতে লেবারদের কাজ মাপতে মাপতে বড় শালের লাইনে নজর আঁটকে গেল দুলালের। কুড়ুল মারছে রাভা বস্তির সাত-আটটা গাঁট্টাগোট্টা জোয়ান। সবাইকে জরীপ করে তের নম্বর গাছের কাছে থামল দুলাল। ওখানে কুড়ুল চালচ্ছে ছেলেটা। অনেকের মতো প্যান্ট-জামা খুলে শুধু জাঙ্গিয়া পরে। ঘামে ভেজা পাথর-খোঁদা চকচকে কালো শরীর। নিঃশ্বাসের তালে তালে বুক মুচড়ানো আওয়াজ উঠছে। অরণ্যের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে গলার ঘ্যাঁক ঘ্যাঁক শব্দ আর শালের শক্ত গুঁড়িতে কুঠারের আঘাত। ওর কুড়ুল চালানো দেখছে দুলাল। কাঁধ আর পিঠের পেশিতে শিল্পীর নিপুণ ভাস্কর্য্য। কোপ মারছে বাঁ-দিক থেকে ডান, ডান থেকে বাঁ।
কুড়ুল মানুষের আদিম অস্ত্র। ভাবছিল দুলাল। অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় নিশানা মত কোনাকুনি কুড়ুল মারছে ছেলেটা। ‘শক্তি ক্ষিপ্রতা নিশানা আর সাহস শিকারির বৈশিষ্ট্য’, পটাদার কথা গুলো মনে পড়ল। ‘ফুটবল প্লেয়ারদের মত স্পীড স্কিল স্ট্যামিনা স্ট্রেন্থ, চারটে এস শিকারির থাকতেই হবে। আর দরকার তিনটে এ। আর্মস অ্যাঙ্গেলস আর অ্যাকিউরেসি।’ পটাদার হিসাবের সাথে মিল খাচ্ছে। শিকারি বাড়ির ছেলে কি এটা! ভাবছিল দুলাল। একে ধরে কি কোন ওস্তাদ শিকারির নাগাল পাবে?
রতনের প্রস্তাবটা লাট খাচ্ছে মাথায়। ‘কাজটা করে দিতে পারলেই নগদ চোদ্দ লাখ। খরচা পাতি বাদ দিয়েও হাতে বারো থাকবে’। বারোর নাগাল পেতে ছেলেটাকে একটু বাজাতে হবে, মনে মনে বলল দুলাল।
ভাবনা ছেড়ে কাজ। নরম গলায় ছেলেটার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল, ‘নি নি অতুং মুংরে?’
মালিকের ডাকে কুঠার থামিয়ে অবাক চোখে হাঁপাচ্ছে ছেলাটা। ডান হাতের তর্জনী দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলল, ‘আনি মুং এতোয়া রাভা।’
একটু থেমে বাবার নাম, বাসস্থান জানতে চাইল দুলাল। সংক্ষিপ্ত উত্তর শুনল, ‘রমেশ, নৌগুয়া, মান্দাবাড়ি।
উত্তেজনা চাপা দিতে এক ঢোক জল গলায় ঢেলে মুখে গাম্ভীর্য আনল দুলাল। এক পর্দা উঁচুতে স্বর, ‘ওঃ নাগেশ্বরদা পাঠিয়েছে তোকে! আগে এ জঙ্গলে এসেছিস?’
ভুট্টা দানার মত দাঁত বেড় করে হাসল এতোয়া, ‘ই তোলাইদাম, ফাংবূদা, আপপৌন জীব-জন্তু বেতেনি তোয়া।’
‘বুঝলাম, এই জঙ্গল বুড়ো গাছ সবগুলো জানোয়ার তুই চিনিস।’
এবার আরও নরম গলা দুলালের, ‘স্কুলে পড়েছিস?’
‘উঁ, ক্লাশ এইট পাশ তোয়া। বাগানাভি স্কুল’। উজ্বল চোখ এতোয়ার।
‘ঠিক আছে। একটু জিরান দিয়ে কাজে নাম। জল খা।’
একটা ঝাঁকড়া জারুল গাছের ছায়ায় বসল এতোয়া। ওকে দেখে আরো কয়েক জন। দুলাল সবার নাম জেনে নিল। সানু খারিয়া, লালু খারিয়া, মহেশ মিঞ্চ, রামু রাভা …।

।।দুই।।

‘রাইনো’, হাল ফ্যাশনের হোটেল কাম বার। চিলে পোতা জঙ্গলকে পেছনে রেখে, রাজ্য সড়কের গাঘেঁষে উদ্ধত দাঁড়িয়ে আছে। রেঞ্জার সাহেবের অফিস থেকে শুক্রুবার বিকেলে ওয়ার্ক অর্ডার হাতে নিয়ে রাইনোতে বসে একা একা ভদকা খাচ্ছিল দুলাল। নেশাটা ধরছিল না। একটু পরে ওল্ড মঙ্ক রামে খালি পেটে আরেকটা বড় চুমুক মারতেই নেশাটা চরাক করে মাথায় উঠে গেল। মাংসের একটা বড় টুকরো মুখে তুলতে যাবে। হঠাত বাজপাখির মত হাওয়ায় উড়ে এল রতন। ফাঁকা লাউঞ্জের চার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল ‘ফাটাফাটি নাম, হোটেল রাইনো’। সামনের চেয়ারে বসে শ্যেন দৃষ্টি মেললো, ‘ভালই আছিস দুলাল। তোকে খুঁজছিলাম।’  
দুলালের চোখে ঘোর। জড়ানো কথা, ‘চুনোপুঁটি কনট্রাক্টরকে খুঁজবি কেন?’ 
‘দরকার আছে। বুদ্ধিমান এলেমদার বন্ধু তুই।’  
‘আমি বুদ্ধিমান? বুদ্ধি খাটিয়ে শালা ইয়ে করলাম!’

‘ভালই তো করলি।’
‘ভালো করলাম? সবেতেই লস। কাঠের ব্যাবসা চায়ের হোলসেল তোর সাথে ঠিকাদারি। সব ফেল। শিরদাঁড়াটা ধনুক হয়ে গেল রে! তুই আমার বুদ্ধি দেখছিস?
‘নেশা হয়ে গেছে তোর। বেশী বকছিস দুলাল। তোর বুদ্ধি লাগিয়ে কম কাজ করলাম?’
‘কী কাজ করলি?’
‘বোল্ডার না ফেলেই তিস্তার পাড় বাঁধাই। তারপর ফটাফট বিল টাইপ। কাজ বন্ধ হতেই আমরা ভেসে গেলাম।
‘তুই ভেসে গেলি? খাপরাইল মোড়ে উড়িয়া রামুর জেলি ফ্যাক্টরিটা ঠকিয়ে কিনে একদিন সাইড হয়ে গেলি। এখন কলকাতার রহিস আদমী তুই। বাড়ি-গাড়ি-ফ্যাক্টরির মালিক আর আমি ফালতু কনট্রাক্টর। ফরেস্টের জঞ্জাল সাফ করি।’
‘জঞ্জাল সাফ করিস? শালা, জঙ্গলটাই সাফা করে দিলি!’
‘কেন, কী করলাম?’
‘বৈকুন্ঠপুরের পাঁচটা শিশু গাছ কাটল কে?’
‘আমি কাটলাম। তবে ধরা পড়তেই লাইফ হেল!’
‘কেন? কে কী করল?’
‘বিট অফিসার পুলিশ মিলে সব কামাই ফাঁক করে দিল। আর হারামি রেঞ্জারটা ছিবড়া করে ছাড়ল। টাকা না খেয়ে ধম্মপুত্র ডিএফওর কাছে নালিশ ঠুকল।’
‘তারপর?’
‘কালো তালিকায়। একদম বেকার। ঝড়ে ডানা ভাঙা বগা খালি কান্দে তখন। ছন্দা টিউশনি করে সংসারটাক টানলো বুঝলি!’
‘বুঝলাম, এখন তো ভালো আছিস?’
‘আছি, ঝড়ঝাপ্টা সামলে এখন বিন্দাস। ছেলের ক্লাস নাইন, এফডি স্কুল। টুকটাক কামাই চলছে। নতুন ফরেস্ট অফিসার বাচ্চা ছেলে। টাকার খাঁই নাই। ডেকে কাজ দেয়। সময়ে পেমেন্ট।’
একটু থেমে গ্লাসের বাকী মদটা গলায় ঢেলে দুলাল বলল, ‘নিজের কথা তো বকে গেলাম। এবার তুই বল।’
আপসু রামে হালকা চুমুক মারল রতন, ‘আনারস ফ্যাক্টরিটা ভোগে চলে গেল! জেলির সবটা কিনে নিত ব্যাংডুবির আর্মি ক্যান্টনমেন্ট। হঠাৎ এক দালালের চুকলিতে মাল নেওয়া স্টপ। হিমাচলের এক ফ্যাক্টরির জেলি নাকি মোর হাইজেনিক!’
‘তারপর কি হোল?’
‘ফ্যাক্টরি লাটে। শেড বেচে দিয়ে বেকার অবস্থায় বিয়ে। কাউকে খবর দিতে পারিনি। বৌ কলকাতার মেয়ে। স্ত্রী ভাগ্যে আমি আবার ফ্যাক্টরি-মালিক। ট্যাংরায় অফিস, বানতলায় কারখানা আর কসবায় ফ্ল্যাট। এক মেয়ে ছ-বছর, কনভেন্টে পড়ে।’
গ্লাসের বাকি মদটা চোখ বুজে গলায় ঢাললো দুলাল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীরে ধীরে বলল, ‘কদমতলা মোড়ে মাঝে সাঝে দেখা তো হয়ই। তবে সব খবর জানতাম না। এবার বল, আমাকে খুঁজছিলি কেন’?
একটু থামল রতন। বাঁ-হাতে চিকেনের টুকরো তুলে ছোট্ট একটা কামড় দিয়ে বলল, ‘জরুরী কাজ। তোর জাদু দিয়ে তুলে দে মাইরি! পরোপকার হবে আর একটা ভালো দাঁও…।
‘কী কাজ?’
‘এখানে না। বড় গল্প আছে, গাড়িতে বলবো। দার্জিলিং মেল থেকে নেমে জামাইবাবুর গাড়িটা নিয়ে চলে এসেছি।’
ফাঁকা রাস্তা। রতনের হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং। স্বর খাদে নামিয়ে রতন বলল, ‘গল্প শোন। জেড্ডার এক ধনকুবের শেখ, হারেমে একান্নটা বিবি। শেষ নিকাটা কলকাতায়। তখন মিঞা বাষট্টি আর বিবি বাইশ। পার্ক সার্কাসে একটা বাদশাহি বাড়ি কিনেছে, বছরে মাত্র ক’দিন থাকে। ও থাকলে কলকাতার ভিআইপি সিকিউরিটি ঢিলা হয়ে যায়। শেখকে আমি দেখিনি, ওর বাড়ি বেগম কিচ্ছু জানিনা। জানি শেখের একটা অসুখ।’
‘কী অসুখ?’ সিটে হেলান দিয়ে ডান দিকে ঘাড় ঘুরাল দুলাল।
সামনের রাস্তায় চোখ রেখে একটু হেসে রতন বলল, ‘অসুখের নামটা খটমট—ইংরাজিতে বলে ইমপোটেন্ট। মানে যৌনাঙ্গের ফাংশন নাই। বাংলা নাম ধ্বজভঙ্গ, বুঝলি!
‘শালা মাতাল! তোর ভাঁট গল্প, এখন রাখ।’
‘না রে, সিরিয়াস গল্প! শোন না! শেখ তো ধ্বজ। রতি ক্রিয়া, সংগম কিচ্ছু পারেনা। এদিকে বিবির ডগমগে জোয়ানি। শরীরে ঢল। বর্ষার তোর্ষা নদী। ন্যাতানো পৌরুষ নিয়ে দেওয়ালে মাথা ঠুকছে শেখ। শুধু ঢলমল সুন্দরীকে ঠাণ্ডা করা নয়। সংকট গভীর।’
মন দিয়ে শুনতে শুনতে দুলাল প্রশ্ন করল ‘কিসের সংকট।’
‘আরে, শেখ তো আর নিকা করতে পারবে না। পৌরুষ নাই বুঝলি, আহারে! কী দুঃখ বল তো!’
দুলালের মুখের দিকে পলক তাকাল রতন। তারপর রাস্তায় চোখ রেখে ধীরে ধীরে বলল, ‘দুনিয়ার সব ডাক্তার হেকিম কবিরাজ দেখেছে। আরব ইউরোপ আফ্রিকা ইয়েমেন তাসখন্দ। সবাই ফেল। শুধু ভিয়েতনামের ভ্যাঙতাও শহরের এক ডাক্তার নিভু নিভু পলতেটা একটু ফুঁ দিয়ে উস্কে দিয়েছে। ইলাজ নাকি জরুর আছে। তবে সাল ভর দাবাই গিলতে হবে। কিন্তু ওষুধটা বানানো একটু সমস্যা। লাগবে একটা …।’
‘বুঝলাম, ডুয়ার্সে জঙ্গল ভর্তি জড়িবুটি। তুই গাছ লতা শিকড় অর্কিড ফল কী লাগবে বল।
‘না রে, বোটানি না। জানোয়ার।’
‘মানে? জানোয়ার মারবো নাকি? শালা দু-পেগ ভুটানি রাম গিলেই ভাঁট বকছিস!’
‘শোন, ইয়ার্কি না। কাজের কথা বলতেই তোকে খুঁজে পাকড়াও করলাম। হেঙ্কি-পেঙ্কি না বকে সাফ সাফ বলি।’
ময়নাগুড়ি ছাড়িয়ে তিস্তা ব্রিজে উঠবার মুখে ফাঁকা জায়গায় গাড়ি থামাল রতন। দুলালের কানের কাছে ফিস ফিস করল, ‘চমকাস না বন্ধু। একটা শিঙ চাই।’
‘মানে’? চিৎকার করে উঠল দুলেল।
রতনের নিচু স্বর। বলল, ‘মানে কালো গণ্ডারের শৃঙ্গ। একটা হাফ কিলো খড়্গ চাই। আর জিনিষটা সাপ্লাই দিবি তুই। দাম… বারো লাখ। কথাটা গোপন, তোর বৌ-ও জানবে না।’
কথাটা শেষ করে কয়েক পা হেঁটে রতন স্টিয়ারিং ধরল। গাড়ীর ভিতর তখন হাল্কা শীতেও দরদর ঘামছে দুলাল। ওল্ড মঙ্কের মৌতাত উড়ে গেল আচমকা। গলায় উঠে আসা হৃৎপিণ্ডে প্রবল ধক ধক। পান্ডাপাড়া কালীপূজার একশ ঢাকের দমাদম। মাথায় বেমক্কা ভয়ের তুফান।
‘কি রে, কাঁপছিস নাকি?’ রতনের প্রশ্নে নিরুত্তর দুলাল। অসংখ্য ছবি ঘুরে ফিরে মাথায় হামলে পড়ছে। জঙ্গলে জানোয়ারের সামনে পড়েও তেমন কাঁপেনি। বাইসন হাতি ময়াল, এমনকি খয়েরবাড়ি জঙ্গলে একবার মুখোমুখি নেকড়ে দেখেও। কিন্তু হাতির পিঠে নয়ত রেঞ্জারের জীপে দূর থেকে গণ্ডার চোখে পড়তেই কেঁপে উঠেছে দুলাল।
গণ্ডার, নামটা শুনলেই কেঁপে ওঠে বুক। গরুমারা জঙ্গলের রেঞ্জার রাম কুমার রাভা গণ্ডারকে বলেন ‘মহারাজ’। মাঝে মাঝে নিজের ভাষায় আদর করে বলেন ‘গৌনদায়’। একদিন রাইনো রেস্টুরেন্টে মৌজ করে বলছিলেন ‘মহারাজ অসীম সাহসী। মহা শক্তিধর। চলন মন্থর কিন্তু অতর্কিতে আক্রমণ হানতে পারে। ক্ষিপ্র নেকড়ের মত। গণ্ডারের ঐ-গতি শক্তি আর ওজন! কংক্রিটের পিলার ভেঙে দেয়। নিজের চোখে দেখা, জলদাপাড়ায় একটা গৌনদায় এক ধাক্কায় পাথর বোঝাই লড়ি উলটে দিয়েছে।’
মন্থর গাড়িতে রাস্তার মিয়ানো আলোয় রতনের চোখে চোখ রাখল দুলাল। বলল, ‘আমার দ্বারা হবে না। মহারাজ মারা… অসম্ভব। ডেঞ্জারাস জানোয়ার। গুলি খেয়েও মরে না।’
‘তুই কেন মারবি?’
‘তাহলে?’
‘মারাবি। সুপারি দিয়ে মারাবি। লাখ-দু লাখ যথেষ্ট। শিকারির পাতা কর কিন্তু গোপনে।’
‘কী বলছিস রতন? স্কুলের ভালো ছেলে! ছবি আঁকা গান হাই-জাম্পে ফার্স্ট!’
‘পুরনো কথা ছাড়’।
‘ছাড়বো কেন? আমি নহে জাত বখাটে। টাউনক্লাব মাঠে রেফারি পিটানো গুন্ডা। সেদিন বীরপাড়ার পটাদা না বাঁচালে জেলের ঘানি টানতাম।’
‘আমার মনে আছে। জুবিলী পার্কে গাঁজার ঠেক থেকেও পুলিশ একবার ধরল তোকে। পটাদা ছাড়িয়ে আনলো। ওঁর টিমের ফরোয়ার্ড তুই।’
জামার হাতায় মুখ মুছল দুলাল। ধীরে ধীরে বলল, ‘ওই সময় আমার বাবার হঠাৎ কিডনি বিকল আর তোর বাবার গলায় ক্যান্সার। ক’মাস পরে স্কুলের গণ্ডী ডিঙিয়েই আমরা তখন অনাথ। শুরু করলাম কামাই ধান্দা।’
‘মনে আছে সব কথা’।
‘তোর মনে আছে রতন দিলীপ স্যারের মেয়েকে সাইকেল শেখানো। ওকে বীরত্ব দেখাতে ঢোরা সাপ মেরে তিন দিন ঘুমাসনি। সেই তুই এখন মহারাজ মারতে বলছিস!
‘বলছি। টাকার লোভ মাইরি! ল্যাংরা ইসমাইল, কাঁচা চামড়ার সাপ্লায়ার আমার লোভের আগুনে ঘি ছিটালো।’
বড় একটা শ্বাস ফেলে রতন বলল, ‘লোকটার মুখে শুধু জী আর আদাপ। খুন জখম স্মাগলিঙের চাঁই। সেদিন আমার মুখের দিকে স্থির তাকিয়েছিল ইসমাইল। একটু আগে অফিস খুলে টেবিলের ডান দিকে তাকিয়েছি। রাইনোর একটা বড় ছবি ওদিকে। আমার প্রচার সচিব রুবি চ্যাটার্জির দেওয়া। ওর আঁকা গণ্ডার দেখে আমি হাঁ-হয়ে গেছিলাম। রুবি ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ‘স্যার এটা কিস্‌সু হয় নি। পয়সার জন্য ছবি বেচে আমরা আর্টের গলা টিপছি। জার্মান শিল্পী আলব্রেখ্‌ট ডুরার বলতেন, গণ্ডার ঈশ্বরের সুন্দরতম সৃষ্টি। ওনার তৈরি রাইনোর উডকাট দেখলে আপনি দিওয়ানা বনে যাবেন স্যার!’
রতন থামতেই দুলাল বলে উঠল, ‘তারপর?’
দুলালের মুখের দিকে পলক তাকাল রতন। ধীরে ধীরে বলল, ‘আলফ্রেড ডুরারের রাইনো, মানে আসল শিল্প-কর্মের একটা কপি আমার টেবিলে। ওই চতুস্পদের ছবির দিকে তাকিয়ে আছি। কী সুন্দর প্রাণী! ওজনদার। ঘাস খায় কিন্তু শক্তিশালী। বাঘ ওকে ভয় খায়। এমনিতে শান্ত আর ভাবুক। অযথা আক্রমণ করেন মহারাজ। কাদাজলে লুকিয়ে রাখে পেল্লাই শরীর। নিরীহ লাজুক নির্বিরোধী। মনে মনে ভাবছি, এই জন্তুটাকেও মানুষ মারে? খুবলে নেয় মাথার শিং পায়ের নখ! ওর খর্গের মুল্য নাকি অনেক! খর্গের তৈরি ওষুধে লজ্ঝড় বুড়োও চাঙ্গা হয়ে যায়। ইয়েমেনে রাজাদের কোমড়ে রাইনো শিং-এর ছুরির বাঁট স্ট্যাটাস সিম্বল। রুবির মুখে শোনা এসব কথাই ভাবছিলাম। ঠিক তখনি আমার ফাঁকা অফিসে কানের কাছে মুখ এনে রাইনোর শিঙে আঙুল ছোঁয়াল ইসমাইল। খরখরে গলায় বললো, ‘এইটা আমার চাই, বাবুজী। মেহেরবানি করকে স্রিফ এক শিঙ। আপ ডুয়ার্সকা আদমী, জরুর সাকেগা। রুপয়া কোই বাত নেহি।’
শিঙটা কি কারণে দরকার, দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে ইসমাইল বলেছিল।
‘তারপর’?
সঙ্গে সঙ্গেই রতনের উত্তর, ‘তারপর কয়েক দিন ভেবে বিশ লাখের চুক্তি করে আমি এখন তোর কাছে।’
গাড়ি থামিয়ে তিস্তা ব্রিজের রেলিং ছুঁয়ে অনেক্ষন হাঁটলো দুলাল। তিরতির ঠাণ্ডা বাতাস। অন্ধকার নেমেছে দূরে। আকাশে উজ্জল হিরের দ্যুতি। একটু পর গাড়িতে ফিরে মুখ খুললো দুলাল, ‘আমাকে ভাবতে দে। টাকার খুব দরকার। আমার বৌ চায় একটা চাই স্থায়ী রোজগার। আবার মালবাজারে পাঁচ কাঠা জমি কিনেছি। ইচ্ছে আছে হোটেল বানাই। কিন্তু একটা ইটও ফেলতে পারিনি।’
দুলালের ঘাড়ে রতনের হাত, ‘পারবি। আমার কথাটা ভাব বন্ধু। আট-দশ দিন পর আমি আসবো। ফোন টোন কিচ্ছু করবি না আমাকে।’

- বিজ্ঞাপন -

।।তিন।।

‘খরচা পাতি বাদ দিয়েও তো বারো…, ’রতন চলে যাওয়ার পর থেকেই কথাটা চক্কর কাটছিল মাথায়। মনের আনাচ কানাচ জুড়ে অস্থিরতা। একরাশ ভাবনা মাথায় নিয়ে শনিবার সকালেই বীরপাড়া পৌঁছাল দুলাল। পরেশ চন্দ্র লাহিড়ীর বাড়ি। একতলা আসাম টাইপের। বাড়ির তিন দিকে ছিপছিপে সুপারি গাছ। ডানদিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে একটা বৃদ্ধ কাঁঠাল আর ঝাঁকড়া জামরুল গাছ। চন্দ্রমল্লিকার বাগান পেরিয়ে দরজায় কড়া নাড়ল দুলাল।
দরজা খুলে দুলালের পা থেকে মাথায় চোখ বোলালেন পরেশ বাবু। বড় সোফাটায় গা এলিয়ে দিল দুলাল। বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল, ‘তোমার খোঁজ নিতে এলাম, পটাদা।
‘আসল কথা বল, কনট্রাক্টর-ব্যাবসায়ী ধান্দা ছাড়া কিছু বোঝে?’
‘বিশ্বাস করো পটাদা, তোমাকে দেখতেই আসা। কেমন আছো?’
‘নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ যেমন থাকে! চোখে ছানি, হাঁটুতে বাত’। একটু থেমে আবার, ‘পাপ বুঝলি! বাবা বলতেন, শিকার ছেড়ে চা-বাগান নিয়ে থাক। জন্তু জানোয়ার মারলে অভিশাপ লাগে। কে শোনে কার কথা! তখন ভাবতাম শিকারই আসল উত্তেজক গেম।’
ঘরের চারদিক দেখছিল দুলাল। সাজসজ্জায় কিছু পরিবর্তন হয়েছে। ডানদিকের দেওয়ালে বাঘের চামড়া, তিন ফুট হাতির দাঁত, বাইসনের মাথা, হরিণের শিং। বাঁদিকের দেওয়াল জুড়ে অস্ত্রশস্ত্র। একনলা-দোনলা বন্দুক, তরোয়াল-বর্শা-টাঙ্গি-খুকরি, গন্ডারের চামড়ায় তৈরি একটা বড় ঢাল। ঢালটা দেখতে দেখতে কথার মাঝখানেই প্রশ্ন ছুড়লো দুলাল, ‘তুমি কখনো গণ্ডার মেরেছো, পটাদা?’
‘নাঃ! গায়ে গুলি ঢোকেনা, মারবো কি? কপালের উপর দু’ইঞ্চি জায়গায় উঁচু থেকে তাক করা। টু’শাটার দিয়ে দূর থেকে ওর নরম কপাল ভেদ করার মত এলেম আমার ছিল না। এ-সব কথা থাক। দুলালবাবু, তুমি ঠিকাদারী ছেড়ে হঠাৎ গণ্ডার নিয়ে পড়লে কেন?’
‘তোমার দেওয়ালে ঐ ঢালটা দেখে মনে পড়ল। শিলিগুড়ির বাবু পাড়ার এক কবিরাজ কী একটা ওষুধ বানাবে বলে খুঁজছিল। যদি কোথাও কিনতে পাওয়া যায়! তবে আমি তো তোমাকে দেখতেই এলাম’।
‘কী আর দেখবি! আচমকা পত্নী বিয়োগ। ছেলে দেখতে আসে না। মেয়েটাও নিঃসন্তান এবং বিধবা। সেও এবাড়ি মুখো হয়না। সব আভিশাপ বুঝলি! অদৃশ্য শক্তির মার।’
পুরানো কাজের লোক সুরেশ ওঁরাও রবার কাঠের ছোট টেবিলে চায়ের ট্রে আর বিস্কুট রেখে গেল। কাপ হাতে নিলেন পরেশ চন্দ্র। বললেন, ‘গণ্ডারের শিঙ খুজছিস? সাবধান!’
চায়ে আলতো চুমুক দিলেন পরেশ চন্দ্র। একটু থেমে ধীরে ধীরে বললেন, ‘আন্তর্জাতিক মাফিয়ারা শকুনের মত ওঁত পেতে আছে। জঙ্গলের নিয়ম ইদানীং খুব কড়া। মানুষ মারলে পার পাবি কিন্তু একটা হরিণ মারলে লাইফ হেল। অথচ আগে নিয়মের কোন বালাই ছিল না। বাবার মুখে শোনা বুঝলি! কুচবিহারের মহারাজা কুড়ি বছরে দুশো গণ্ডার মেরেছিলেন।’
দুলাল বিষম খেল। কাপটা টেবিলে নামিয়ে শিলিঙে চোখ রাখল। কাপের বাকি চা গলায় ঢেলে লম্বা সিগারেট ধরালেন পরেশ চন্দ্র। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘এসব সত্যিই অবিশ্বাস্য! শিলিগুরি-ডুয়ার্স-ভুটান আন্তর্জাতিক অ্যানিম্যাল ট্রেডের পীঠস্থান। কয়েক বছর আগে শিলিগুড়িতে আমি সাচ্চা কস্তুরী দেখেছি। আইনের কড়াকড়ি, বিস্তর ফরেস্ট গার্ড, কাঁটাতারের বেড়া সব কিছু টপকে পশু বধ মানে পোচিং চলছে। সঙ্গে অবৈধ বৃক্ষ নিধন। চোরাই বস্তু জয়গাঁ-ভুটান-পারো হয়ে এক লাফে আন্তর্জাতিক বাজারে। বহু সরকারী কর্মী, স্থানীয় মানুষ পোচিঙে মদত দেয়। গোটা দেশের একই ছবি। আসাম মেঘালয়ে খোদ মন্ত্রীরা জড়িত। পোচিঙের চোটে বহু দেশে গণ্ডার প্রাণীটাই বিলুপ্ত হয়ে গেল! অনেক দেশে গণ্ডারের শিং ব্যাবহারে এখনও কোন নিষেধ নেই! ভিয়েতনামের গ্রামে-গঞ্জে এমনকি খোদ হোচিমিন নগরীতে আজও এই বস্তু দিয়ে ইম্পোটেনসি ক্যান্সার এসবের চিকিৎসা চলছে। আর চাহিদা মেটাতে আফ্রিকার জঙ্গলও ফাঁকা হয়ে গেল। অথচ খড়্গ জিনিষটা চুল নখ ক্ষুর জাতীয় বস্তু। কেরাটিন প্রোটিন। এর রোগ সারানোয় কোন ভূমিকাই নেই।’
‘পটাদা, অনেক কিছু জানলাম। তোমার মতো জঙ্গলের খবর আর কে রাখে!’
‘লোক পটানো কায়দা ছাড়। আসলে বুড়ো মানুষ কথা বলবার সুযোগ পেলেই বক বক করে। কুড়ি বছর শিকার করিনি কিন্তু সব খবর রাখি। শুনে রাখো, বছর দেড়েক আগে জলদাপাড়া-গরুমারা রেঞ্জে তিনটে গণ্ডার পোচিং হয়েছিল। তার একটা ছিল মাদী। চোরা শিকারীরা তার পায়ের ক্ষুর গুলোও খুবলে নিয়েছিল। মান্দাবাড়ি থানার বড়বাবু, আমাদের বীরপাড়ার জামাই তাপস চক্রবর্তী প্রাণপাত করেও পোচারদের ধরতে পারেনি। আমার বাড়িতে বসে তাপস আফসোস করছিল। সন্দেহ করেছিল রমেশ রাভাকে। দুই জোয়ান ছেলের বাপ। কিন্তু সন্দেহ আর প্রমাণ কি এক?’
দুলাল একটু নড়ে বসল। রুমালে মুখ মুছে বলল, ‘তুমি কি রহস্য ভেদ করলে?’
‘পারি নি। পকেটের টাকা খসিয়ে জাসুসি করেছি। তোকে বলি, পোচিঙের পর দিন থেকেই রমেশের বড় ছেলে রবি, গুঙ্গা হয়ে গেল। কী এমন দেখলো যে তাগড়াই ছেলেটা বোবা হয়ে গেল! পুলিশ এসব ভাববে? আরো শোন, রমেশের হাতে টাকাপয়সা কিছু আসেনি। তার মানে ওদের হেপাজতে জিনিষটা এখনো আছে। ঐ তল্লাটে নজর লাগা। কান টানলে মাথা আসবে। শিকারীকে ধরতে পারলে আসল জিনিষও হয়ত পেয়ে যাবি। যাক, অনেক বকবক করলাম।’
ঘর জুড়ে স্তব্ধতা। অনেকক্ষণ চুপ থেকে আবার বললেন, ‘আজকে উঠতে হবে দুলাল বাবু, বাগানে অডিট চলছে। কিছু পেলে আমাকেও দিও, অন্তত দু’বোতল শ্যাম্পেন। শ্যাম্পেন আর সিগারেট নিয়েই তো সারভাইভ করছি।’
উঠে দাঁড়াল দুলাল। বাস স্ট্যান্ডে আসবার পথেই কম্পন চালে রাখা মুঠোফোনটা বুক পকেটে জেগে উঠল। মনিটরে নাগেশ্বর। ফোনটা হাতে নিয়ে একটা জলপাই গাছের নিচে দাঁড়াল ও। তারপর স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, ‘নাগেশ্বর, সোমবার মানে কাল বাদ পরশু কাজ শুরু করবো। কোদাল বস্তী আর মান্দাবাড়ির সব কটা ছেলেকে ঝেটিয়ে সাইটে পাঠাবে।’

।।চার।।

দুলালের ডাকে মাচায় উঠে এল এতোয়া। ওখান থেকে রাস্তার বিপরীতে গামারি সেগুন শিরীষের মাথা ছারিয়ে, সরু খয়ের গাছের জটলা ডিঙিয়ে জঙ্গলের অনেকটা দৃশ্যমান। পানিসাজ গাছের চুড়ায় একটা বন মোরগ ডেকে উঠল। দূরে কয়েকটা বাইসন নুন চাটছে। একটা বাচ্চা ওর মায়ের গা ঘেঁষে। এক দঙ্গল টিয়া টি টি শব্দে ঘরমুখি। ওদের মাথার উপর দিয়ে নীল আকাশে অনুজ্জ্বল চাঁদের দিকে ছুটছে এক সারি ধবধবে বক। এতোয়ার হাতে বাইনাকুলারটা তুলে দিল দুলাল, ‘কী দেখছিস বল।’ 
যন্ত্রে অনভ্যস্ত চোখ রেখে এতোয়া বলল, ‘পশু পৌলৌংদো তোয়া।’ 
‘আরে বাইসন গুলো তো আমিও দেখছি। আর কি দেখছিস বল।’ 
‘শিরীষ ফাংনি গাজেং গৌদোয়ায় জৌমায় ফৌরি দুফু গোদা তোয়া।’ 
‘বুঝলাম। শিরীষ গাছের মোটা ডালে জড়ানো ময়ালটার লেজে ঘা। তারপর বল।’  
‘ঢিবি কেতিয়ায় দহল গাদোয়ায় গৌনদায় গোদা গৌরোমৌন তয়তা। সৌপ দৌনৌন পাভা।’ 
‘ঢিবির পাশে বড় জলায় ঢাউস গণ্ডার- সব দেখতে পাচ্ছিস? আবার বলছিস গণ্ডারটা রোজ দিনই থাকে!’ 
নির্বিকার মুখ এতোয়ার। সামান্য চুপ থেকে বলল, ‘চেইতা তো, উয়ান উনি নপাউ তোয়া।’  
চমকে উঠল দুলাল, ‘বলিস কিরে? ওটাই ওর বসত আছে?’ 
কথাটা বলে চারদিকে তাকাল দুলাল। স্বরে মাখন, ‘মালবাজার চল তুই। এখনি ট্রাক আসবে। আমার সাথে হোটেলে থাকবি। আরও তিন দিন কাজ চলবে।’  
ঘাড় নেড়ে ওর মহল্লার ছেলে সানুকে খবর দিতে মাচা থেকে কাঠবিড়ালির মত নেমে গেল এতোয়া। তখন নিচে গোধূলির হলদে আলোয় কুনকি হাতি গুলো নিঃশব্দে গাছের কাটা লগ সরিয়ে রাখছে। কাগজপত্র গুছিয়ে ব্যাগে পুরল দুলাল। সামনের আকাশে তখন রংবাহার। সূর্যের গায়ে রঙ্গন ফুলের রং, আলোয় আলোয় বর্ণময় ধূসর আকাশ। গোলাপি আভা মিলিয়ে যেতেই আকাশ জুড়ে উদাসীন গেরুয়া। পরক্ষনেই সোনাঝুড়ির মোলায়েম হলুদ। শীতের অরণ্যে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে ঝিঁঝিঁর ডাক। আঁধার নামছে গাছের খাঁজে আর কালজানির রুক্ষ তটে। 
নিঃশব্দে মাচায় উঠে এল এতোয়া। গলা খাদে, ‘ই কৌমোতো সানিসানতামায় বুসুনা। নিভা আরা বিসিকালায় কালাভা?’  
স্পষ্ট উত্তর দুলালের, ‘ঠিকই, এই কাজটা তিন চার দিনেই শেষ হবে। এরপর তোদের কবে ডাকবো জানি না’। সামান্য চুপ থেকে চিন্তিত মুখে দুলাল বলল, ‘তুই কী কাজ করতে পারিস?’  

নিরুত্তর এতোয়ার দিকে তাকিয়ে আবার অস্থির প্রশ্ন, ‘নৌং কি কৌম কাপা?’
‘আপপৌন কৌম। চিকা পাঞি, হঁবা তানি, ইট-লহং দৌবীঞি। নৌং জেমরীপ ব্রাভা, তামরৌন তাভা।’
‘বুঝলাম সব কাজ, জল টানা মাটি কাটা ইট পাত্থর ভাঙা তুই করতে পারবি। আবার আমি যা বলবো তাই-ই করবি। এখন তাহলে কি করিস?’
‘বৌতুল মৌন তৌচাক, মাচাক গাতেতা। আরা বৌবুগোদানি নৌগুয়ায় কৌম তৌরিয়া। অগায় তো ইফিনি খৌব।’
‘গুলতি দিয়ে পাখি, হরিণ মারিস। পেট ভরাতে বাগানের বড়বাবুর বাড়িতে বর্তন মাজিস?’
মাথা নাড়ল এতোয়া। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে গলাটা গম্ভীর করল দুলাল, ‘ভালই তো আছিস। অন্য কামে লাগবি কেন? পেলেমৌন তো তৌয়তা। আতাং কৌম লৌয়া আতাভা?’
‘বৌবু, ঔংনিং কৌমো আং মাসচানাং’।
পড়ন্ত সূর্যের আলো এতোয়ার ম্লান মুখে। দুই হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজলো। হঠাৎ কান্নায় বেঁকে উঠছে সুঠাম শরীর। জঙ্গলের মাচায় ফুঁপিয়ে কাঁদছে শক্তিমান কিশোর। স্বল্প চেনা বালকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে দুলাল বলল, শার্দূল পোষ মানবে। ওর সারল্য আর শক্তি কাজে লাগিয়ে হয়ত রাজা হয়ে যাবে দুলাল চন্দ্র! এতোয়ার পিঠে হাত রাখল দুলাল, ‘কোন দু’টো কাজ তুই পাড়বি না?’
‘বৌবুনি নগুয়ায় থালা গৌনি আরা বালাজ বুকচিলায় সাবুন নৌভি।’
‘ঠিক আছে, বাবুর বাড়িতে বাসন মাজা আর সায়া ব্লাউজে সাবান ঘষা তুই পারবিনা। আমার জন্য সব কাজ করবি?
সম্মতিতে মাথা নাড়ল এতোয়া। ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল দুলাল, ‘আমার জন্য বাঘ মারতে পারবি?’
মাথা নিচু এতোয়ার। ভাঙা বাংলায় বিড়বিড় করলো ‘পারবো। বাঘ হাতি বাইসন গণ্ডার যা কহবা মারি দিবো। শুধু কাম দাও, বচ্ছর ভর কাম। যিখান বুলবি সিখানত যাবো।’
একটু পরে গলার পর্দা তুলে দৃপ্ত ভঙ্গিমায় মতামত জানিয়ে দিল, ‘মাসানাং, মাকসা নৌমপ্লৌ মশু পৌলাং গৌনদাই ঝি ব্রাভা গাতেৎ লাওয়া। খৌলি কৌম লাও। বৌসৌর দৌং কৌম। জিবায় ব্রাভা উবৌ য়ৌন লেইয়াং।’
‘বুঝলাম। আমার জন্য সব কাজ করবি, যেখানে পাঠাবো, সেখানে যাবি। কিন্তু তোর বাপ-মা ছাড়বে? লিপি আওয়া- আমায় গজকে লাওয়া?’
‘আমায় তো ম্যালিরিয়া কৌলৌমিলাই পাংতা, অতুং ব্রাভা। আরা আওয়া বাগানাঞি ঠিকা। কৌম তোংচা তো কৌদিবান তোংচা। চেকরি মাসারৌন বাকায় চানা?’
‘তোর বাড়ির হাল তো বুঝলাম। মা ম্যালিরিয়ায় কাহিল। বাবা বাগানের ঠিকা। কাজ নাই তো টঙ্কা নাই। তুই চাকরি পেলে না-ছেড়ে ওদের উপায় কি?’
এবার অন্ধকারে ঢিল ছুড়ল দুলাল, ‘তোর দাদা আছে না! কী করে?’
উত্তর না দিয়ে পেট ভর্তি খিদের কথা জানালো এতোয়া, ‘অগায় ইফিনি খৌব।’

মালবাজারে হোটেলে ফিরে আগের দু’দিনের মত ছটা পরোটা সঙ্গে এক বাটি মাংস খেয়ে ডরমিটারিতে ঘুমাচ্ছিল এতোয়া। রাত গভীর হোলে হোটেলের দারোয়ান ধাক্কা মেরে ঘুম ভাঙালো। ফাঁকা ঘরে এতোয়ার চোখের দিকে দৃষ্টি হানল দুলাল। শান্ত গলা। কেটে কেটে বলল, ‘আমার একটা জিনিস লাগবে এতোয়া, জঙ্গলের চিজ।’ 
ঢুলু ঢুলু চোখ এতোয়ার। ঘুমের খোয়ারি কাটেনি। বড় একটা হাঁই তুললো, ‘ই ঝাড়ায় পাং রৌন মাসানা বৌবু, ফাং–তেলি- নউমপ্লউওসি ফাতং মাকসা গৌনদাই। মুভো দুন লাও। অতরৌন চেকরি নি চিঠি লাওয়া তো?’   

‘মালুম হল না। আবার বল।’
বিকার হীন মুখ এতোয়ার, ‘এই জঙ্গলে থাকলে মিলবো বাবু, গাছ-লতা-হাতির দাঁত-বাঘ-গণ্ডার। নামটা কহ দাও। কিন্তু বাবু, নোকরির লেটার দিবি তো?’
‘দিব। তোর বাপ, মহল্লার সর্দাররে সামনে গিয়ে কথা দিব আমি। তবে ঐ মালটা, মানে জঙ্গলের চিজ আমার চাই।’
‘নামটা জলদি বল বাবু, নিন্দ লাগছে।’
ওর কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করল দুলাল, ‘গণ্ডারের শিঙ।’
নির্বিকার মুখে আবার একটা বড় হাঁই তুলল এতোয়া, ‘টাইম লাগব বাবু, তালাশ লাগাই’। তারপর ঢুলতে ঢুলতে বিড়বিড় করল, ‘সময় নিগিনা বৌবু, নিনি কৌমনি হাজায়ো সহজ দং চা। নাম নিগিনা’।
‘পুলিশ ধরলে কিন্তু তুই মরবি, আমি তোকে চিনবো না।’
ঘুম চোখে মুখ ভর্তি হাসি ছড়াল এতোয়া। বলল, ‘পুলিশ ধরলে ওদের তো রুপিয়া দিবা বৌবু, পাঁচ-দশ হাজার। বাপের হাতে দিবা বিস-তিস, আর হামার নোকরির লেটার। কহ দাও বাবু, মালটা যব মিলবে কুথাত রাখিব?’

- বিজ্ঞাপন -

।।পাঁচ।।

 ‘হোটেল কালজানি।’ তৈরি হচ্ছে মাল বাজারে। অসম্পূর্ণ হোটেলে পাহারাদারের নোকরি করতে হাসিমারা বাজার থেকে পোশাক কিনে গায়ে চাপাল এতোয়া রাভা। কালো প্যান্ট হলুদ জামা। পায়ে চামড়ার জুতো, সাদা মোজা। মাথায় নীল টুপি। চোখে কালো চশমা লাগিয়ে সারা দিন কাজে তদারকি করছে ও। ভিত ঢালাই শুরু হবো হবো। দুলাল কখনো সিমেন্ট বালি ইট কাঠ কিনতে ছুটছে। নয়ত রেঞ্জ অফিসে নোতুন টেন্ডার জমা দিচ্ছে। 
পান্ডাপাড়া থেকে সকালে মালবাজারের বাস ধরতে রিক্সায় শান্তিপাড়া যাচ্ছিল দুলাল। বেগুনটারি মোড়ে হঠাত পিছন থেকে রতনের ডাক। থেমে গেল দুলাল। ওকে পাশে বসিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করলো রতন। মালবাজারের পথে তিস্তা ব্রিজ পার হয়ে একটা বড় কাঠ বাদাম গাছের নিচে থামল। বাঁ’হাত দুলালের কাঁধে, ‘কী করে হাতে পেলি ওটা? মহারাজের মৃত্যু সংবাদ তো কাগজে পড়লাম না!’
‘ছাড় ওসব। কাজ শেষ। সিমেন্ট বালি পাথরে ঢুকে গেছে টাকা। ছ’মাস পর চালু হবে হোটেল।’ 
‘সবই যখন বললি, গৌনদায় মাকসানাং কাহিনিটা বলবি না? মহারাজ নিধনের ঘটনাটা।  
‘আমি জানতাম প্রশ্নটা একদিন তুলবি তুই। ছন্দাও জানতে চায়। প্রত্যেক দিন জেরা করে, কোথা থেকে আসছে হোটেল তৈরির টাকা। ওকে মিথ্যে বলে বলে হাঁপ ধরে গেল। আমার বাড়ি চল। ছন্দা আর তোর সামনে বলবো সব।’  
ছন্দার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে মুখ খুলল দুলাল, ‘রতনের প্রস্তাবটা পেয়ে নাওয়াখাওয়া ভুলে আমি শিকারি খুঁজছি। টাকা নিয়ে মহারাজের কপালে লক্ষভেদ করবে শিকারি আর চুপচাপ ওর খড়্গটা আমার হাতে তুলে দেবে। কিন্তু হাওয়ায় উড়ো খবর ভাসে। কে পাকা শিকারি, কে পুলিশের খোচর বোঝা কঠিন। আমার কথা এতোয়া পাঁচ কান করতে পারে বলে ভয়ও পাচ্ছিলাম। বিপদের ভয়ে আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। এরমধ্যে একদিন ডিএফও তলব করল। তেইশ নম্বর বিটে মান্দাবাড়ি জঙ্গলের কোর এরিয়ায় একটা কালভার্ট তৈরির কাজ। ওঁর মুখের কথায় কাজ শুরু করে দিলাম। জায়গাটা মাপজোক করে চিপস আনলোড করছি। তখন বনকর্মী স্যামসন ওঁরাও বলল, দাদা কাজটা হাতে নিলেন? এলাকাটা কিন্তু খতরনক। চারদিকে চোরা শিকারি। 

স্যামসনের পিছনে দু’দিন ঘুরে জানতে পারলাম, গত বছর একটা বিশাল গন্ডার পোচিং হয়েছে। উপর মহলে জানালেও বন দফতর পুলিশ ডাকেনি। তখন স্যামসন ‘ধুপগুরি বার্তা’ পত্রিকাতে খবরটা জানিয়ে দেয়। খবরের সত্যতা যাচাই করতে এক বছর আগের কাগজটা পত্রিকার অফিস থেকে উদ্ধার করে পড়লাম।
কাগজের খবর- বুধবার মান্দাবাড়ি এলাকায় একটি শৃঙ্গ বিহীন পূর্ণ বয়স্ক গণ্ডারের মৃতদেহ দেখতে পায় জনৈক বনকর্মী। উত্তরবঙ্গের মুখ্য বনপাল রাজনারায়ন সুদ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ব্যাপারটা খুবই উদ্বেগ জনক। হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার সোসাইটির (ন্যাস) তরফ থেকে একই খবর পেয়ে সরজেমিনে তদন্ত করেছি। গণ্ডারের শরীরে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা করে ওরা কোন বুলেট পায়নি। কিন্তু আমি নিশ্চিত, এর পিছনে চোরা শিকারিদের হাত আছে। জলদাপাড়া বিভাগের ডিএফও হরিমাধব জাখরকে সাত দিনের মধ্যে গণ্ডার মৃত্যুর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছি। পর্যাপ্ত বনকর্মী নিয়োগ করে আমরা আরও তীব্র নজরদারি চালাবো।
খবরটায় একটা ক্লু পেলাম। মানে পোচিঙের একটা সলিড প্রমাণ। এর পর নতুন উদ্দমে ঝাঁপ দিলাম’। একটু থেমে দুলাল আবার শুরু করল, ‘কোন্ শিকারি গন্দারটা মারল? শৃঙ্গটা কে কোথায় পাচার করলো? ব্যাপক তল্লাশিতে জানলাম জিনিষটা পাচার হয়নি। দু’জন পুলিশের সাহায্য নিলাম। শেষমেশ শিকারি সনাক্ত হোল আর ওর বাড়িতে মাদারি গাছের নিচ থেকে উদ্ধার হল মহা মূল্যবান বস্তুটা। দাম চাইল মাত্র পঁচিশ হাজার।’
‘সে কি’? ছন্দা আঁতকে উঠল। দুলালা বলে চলেছে, ‘চা-বাগানের এক অতিথি বাবু ওকে দাদন দিয়ে আর ফিরে আসেনি। কখনো এলে তার কুড়ি হাজার টাকা ফেরত দিয়ে দেবে। বলল অভাবে জর্জরিত শিকারি। ওর ঘরে চিকিৎসার অভাবে ধুঁকছে স্ত্রী। এক ছেলে অসুস্থ আরেকটা বেকার। আমি শিকারির হাতে দ্বিগুণ অর্থ তুলে দিয়ে মহার্ঘ জিনিষটা পকেটে ঢুকালাম। রতনের দেওয়া ভুটানের নম্বরে যোগাযোগ করল এখানকার পুলিশ। এরপর পুলিশের জীপে জয়গাঁ পেরিয়ে ফুন্টশিলিঙের এক হোটেলে। ম্যানেজারের ঘরে দেওয়া নেওয়া সেরে টাকার ব্যাগটা বগলদাবা করে বডি ফেললাম হোটেল রাইনোতে। পুলিশ সঙ্গে নিয়ে চলল রাতভোর খানা-পিনা।’
‘মহারাজকে মারল কী দিয়ে’? দুলালের চোখে চোখ রেখে অবাক প্রশ্ন ছুড়ল রতন।
চায়ে একটা বড় চুমুক দিয়ে দুলাল বলল, ‘আমিও ভাবছিলাম অভাবী শিকারি কোথায় পাবে এক নলা, দোনলা বন্দুক? উত্তরটা জানতে শিকারিকে আবার ধরলাম। লোকটা চা-বাগানের ঠিকা লেবার। শুকনো মুড়ি চিবাতে চিবাতে ওর বস্তির ঘরে বসে আমাকে শিকারের গল্প বলল।’
বড় একটা শ্বাস নিয়ে ছন্দা বলল, আমার কাছে সব চেপে গেছিলে?’
‘আজ মওকা পেয়েছি। বলছি শোনা। মহারাজকে মারবে বলে পূর্ণিমার রাতে শিকারিরা জঙ্গলে ঢুকলো। প্রবীন শিকারির সঙ্গে তার জোয়ান দুই ছেলে। সবার কোমড়ে শক্ত দড়ি, ঘাড়ে গামছা, হাতে কুড়ুল। ঝাঁকড়া শিরিষ গাছের ডালে নিজেদের শরীর বেঁধে নিয়ে শুরু করল প্রতীক্ষা। কখন মহারাজ আসে। জঙ্গলের গভীরে প্রত্যেক দিনের মত মহারাজ এগোচ্ছে জল খেতে। রোদ পড়ে এলে ঘণ জঙ্গলের ডোবা থেকে উঠে অনেকক্ষন ধরে লম্বা সবুজ ঘাস চিবিয়েছে চতুষ্পদ। স্নান আহারের পরই স্বাভাবিক নিয়মে পিপাসা জাগে। চেনা পথে এগিয়ে চলেছে পিপাসার্থ গৌনদায়। জঙ্গলের মহারাজকে সম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিচ্ছে বাইসন আর হরিণের দল। আত্মশক্তিতে ভরপুর দৃঢ় নিশ্চিন্ত পদক্ষেপ মহারাজের।
চাঁদের আলোয় ওকে দেখতে পেয়েই নিঃশব্দে নড়ে উঠল প্রবীণ শিকারি। ক্ষিপ্র শ্বাপদের মত গাছের নিচু ডালে নেমে এল। চতুস্পদ মহারাজ ঐ ডালের নিচে আসতেই নিঃশ্বাস বন্ধ করে কাঁধের গামছাটা ফেলে দিল শিকারি। চোখে বিস্ময়, ধীরে মাথা তুলল মহারাজ। আর মুহূর্তেই চরম ক্ষিপ্রতায় কুড়ুলের পিছন দিয়ে খর্গ লক্ষ করে প্রচণ্ড আঘাত হানল শিকারি। খর্গটা খুলে পড়েনি। পরক্ষনেই অন্য ডাল থেকে ভিন্ন কোণে মোক্ষম মারটা দিল কনিষ্ঠ শিকারি। এবার খর্গটা মুখমন্ডল থেকে খুলে ছিটকে পড়ল কুড়ি হাত দূরে। একটা সেগুণ গাছের গোড়ায়। খর্গ বিহিন মুখের শূন্য স্থান দিয়ে সজোর ধারায় নামছে রক্ত স্রোত। দ্রুত রক্তক্ষরণ আর তীব্র যন্ত্রণায় গগণ ভেদী আর্তনাদে ছটফট করছে মহারাজ।’
একটু থামল দুলাল। ধরা গলায় বলল, ‘গাছের ডালে ডালে ঘুম ভাঙা পাখিরা শুরু করেছে করুণ চিৎকার। আর আক্রান্ত মহারাজ? অসম আক্রমণে পর্যুদস্ত পিপাসার্ত বিশাল গণ্ডার তার ভারী শরীর দিয়ে ক্রমাগত ধাক্কা মারছে বিশাল সব মহীরুহের গায়ে। কেঁপে কেঁপে উঠছে সেগুন রবার অশ্বত্থ মণজিরি। ক্রমশ নেতিয়ে পড়ছে প্রবল পরাক্রান্ত বলশালী মহারাজ। গাছের ডালে ডালে বাঁদর কূলের বুক ফাটা হাহাকার। সশব্দে মেদিনী কাঁপিয়ে নিজ ভূমির রক্তাক্ত পিছল মাটিতে আছড়ে পড়ল নিরস্ত্র অতিকায় চতুস্পদ। প্রবল গর্জনে অন্যায় আক্রমণের বিরুদ্ধে একবার মাত্র প্রতিবাদ জানালো। ভয়ঙ্কর তীব্র আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ল নদী পাহাড় বাতাস আর নির্বাক প্রকৃতির সতত ক্রিয়াশীল চেতনায়। হঠাৎ মেঘ জমল আকাশে। ঢেকে গেল চাঁদ। অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামল। প্রকৃতির অশ্রু তখন ধুয়ে দিচ্ছে ঘাস মাটি লতগুল্মে জমাট বাঁধা রক্ত। আর কালজানি নদী রুধির ধারা বুকে নিয়ে কেঁদে চলেছে অবিরাম।’
‘তারপর?’
‘দ্রুত মাটিতে নেমে খর্গটা হাতে তুলে নিল কনিষ্ঠ শিকারি। শিকারির জ্যেষ্ঠ পুত্র তখন প্রবল ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে। বোবা লাগা মুখে শুধু গোঁ গোঁ আওয়াজ। ত্বরিতে নামানো হল গাছ থেকে। গলার আওয়াজও বন্ধ হয়ে গেল ধীরে ধীরে। বাইশ বছরের যুবক সম্পূর্ণ বোবা। গুঙ্গা যুবকের আজও এলাজ হয়নি।’
কথা বন্ধ করে ডুকরে কেঁদে উঠল দুলাল। ছন্দার দু-চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। চোখ মুছে বলল, ‘হত্যার দায় আমাদেরও। সারা জীবন প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।’
বুক খালি কড়া একটা শ্বাস ফেলল রতন। ধীরে ধীরে বলল, ‘শোন্‌ দুলাল, আমি ওই ছেলেটার চিকিৎসা করাবো।’
রতন থামতেই ঘর জুড়ে স্তব্ধতা। একটু পরে নিঃশব্দ ভেঙে দুলালের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, ‘তুই তো একটাকে হোটেলের গার্ড বানালি। দেখি আমিও আরেকটাকে পাহারাদার বানাতে পারি কিনা।’
‘মানে’? ছন্দার কণ্ঠে বিস্ময়।
ওর দিকে তাকিয়ে রতন বলল, ‘মানে ফরেস্ট গার্ড। ঘাতকদের হাত থেকে গণ্ডার বাঁচাবে ও।’
চোখের জল মুছল ছন্দা। ধীরে ধীরে বলল, ‘গণ্ডার হত্যা মহাপাপ’।
ওর কথায় সায় দিল রতন। বলল, ‘মহারাজকে বাঁচাতেই হবে। ঈশ্বরের অপূর্ব সৃষ্টি।’

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ ধন কুমার রাভা। আলিপুরদুয়ার।

- বিজ্ঞাপন -

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ড.সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা-700 026. প্রকাশিত গ্রন্থ- বিজ্ঞানের জানা অজানা (কিশোর উপযোগী বিজ্ঞান), আমার বাগান (গল্পগ্রন্থ), এবং বিদেশী সংস্থায় গবেষণা গ্রন্থ: Anticancer Drugs-Nature synthesis and cell (Intech)। পুরষ্কার সমূহ: ‘যোগমায়া স্মৃতি পুরস্কার’ (২০১৫), জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায় বছরের শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য। ‘চৌরঙ্গী নাথ’ পুরস্কার (২০১৮), শৈব ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাসের জন্য। গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরষ্কার (2019), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও জৈবপ্রযুক্তি দফতর থেকে), পঁচিশ বছরের অধিক কাল বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার জন্য)।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!