নদীর উপরের পর এবারে নদীর পানির নীচের ডুবোচরের দিকেও লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে ভূমিগ্রাসীদের। কুয়াকাটা পর্যটন এলাকা, পায়রা সমুদ্র বন্দর, তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শের-ই বাংলা নৌ-ঘাঁটি, সাব মেরিন ল্যান্ডিং ষ্টেশন সহ শিল্প এলাকা গড়ে তুলতে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে জমির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে ভূমিগ্রাসী জালিয়াত চক্র।
সরকারী খাস জমি, নদী, খাল দখলের পর এবার জাল জালিয়াতি কাগজে আন্ধারমানিক নদীর ডুবোচর বিক্রীর পরও অদ্যাবধি পদক্ষেপ নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
ইলিশ’র অভয়াশ্রম ও প্রজনন স্থল খ্যাত পটুয়াখালীর কলাপাড়ার আন্ধারমানিক নদীর সোনাতলা মৌজার এসএ ২ নং সিটভূক্ত ডুবোচরের অšতত: সাড়ে সাত একর জমি বিক্রী করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি সংঘবদ্ধ জালিয়াত চক্র।
সরকারের খাস খাতের নদী শ্রেনীর অন্তর্ভূক্ত এ হাতিয়ে নেয়ার জন্য এ জমি স্থানীয় ভূমি অফিস ম্যানেজ করে ভুয়া বন্দোব¯ত কেস, এসএ খতিয়ান, দাগ, সহিমোহর পর্চা, নাম সংশোধন, বিএস ও ডিপি খতিয়ান সৃষ্টি করে চক্রটি।
যার ৪৬ বছরের ভূমি উন্নয়ন কর একত্রে নিয়ে খাজনা দাখিলা দেয় তহশিলদার। এবং যাচাই বাছাই ছাড়াই দু’টি সাব কবলা দলিল রেজিষ্ট্রী করেন সাব রেজিষ্ট্রার। এভাবে রাষ্ট্রীয় ভূ-সম্পত্তি বেহাত হলেও অদ্যবধি পদক্ষেপ নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এদিকে নদীর মধ্যে জেগে ওঠা ডুবোচরের সরকারী খাস জমির বন্দোব¯ত গ্রহীতার ছেলে ইউনুস’র দাবী, চাকামইয়ার হানিফ মেম্বর ও নাচনা পাড়া চৌরা¯তার আক্কাসে’র মধ্যস্থতায় জমির দলিল রেজিষ্ট্রীর পর কেবল পাঁচ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে তাদের। দু’একদিন পর আরও পাঁচ লাখ দেয়ার কথা ছিল এবং বাকী চল্লিশ লক্ষ টাকার ব্যাংক চেক ও ষ্ট্যাম্প দেয়া হলেও কোন টাকা পাননি তারা। তাদের এ প্রতারণার দরুন তার মা আম্বিয়া খাতুন স্ট্রোক করে মারা যান।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের প্রসিদ্ধ ইলিশ প্রজনন স্থল আন্ধারমানিক নদীর মধ্যে ডুবোচর জেগে ওঠে বেশ কয়েক বছর আগে। এতে লোলুপ দৃষ্টি পড়ে স্থানীয় একটি সংঘবদ্ধ জালিয়াত চক্রের।
চক্রটি ভূমি অফিসের যোগসাজশে ভুয়া সেটেলমেন্ট কেস ৪৪কে/৫২-৫৩ ও ৫০কে/৬৬-৬৭’র বিপরীতে সাড়ে সাত একর জমির বন্দোব¯ত কাগজ তৈরী করে উপজেলার তুলাতলি গ্রামের মোন্তাজ উদ্দীন মৃধা’র কন্যা, মৃত উমর আলী খান’র স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন’র নামে।
যার তফসিল কলাপাড়াধীন ২৩ নং সোনাতলা মৌজা, এসএ-৫৯১/১ নং খতিয়ান, বার্ষিক খাজনা মং ২৮/৫০ পয়সা, দাগ নং- ১৭৬/১১৮৬ ও ১১৮৭, মোট জমি ৭.৫০ একর, যা সোনাতলা মৌজার এসএ ২ নং সিটভূক্ত আন্ধারমানিক নদীর এসএ ১১৮৬/১১৮৭ দাগ। এর বিপরীতে সৃষ্টি করা হয় ৩৯২২ ও ৩৯২৩ বিএস দাগ।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, কলাপাড়া সহকারী কমিশনার ভূমি অফিসে খাস খতিয়ানের রেজিষ্ট্রারে এসএ ৫৯১/১ খতিয়ান ও ১৭৬/ ১১৮৬ ও ১১৮৭ দাগের অ¯িতত্ব নেই। কিন্তু সার্ভেয়ার শাখার বন্দোব¯ত কেস খতিয়ানের রেজিষ্ট্রারের মাঝ বরাবর সোনাতলা মৌজার শুরুতে সাদা কাগজ আঠা দিয়ে লাগিয়ে আম্বিয়া খাতুন’র নামে অবিকল এসএ ৫৯১/১ খতিয়ান ও ১৭৬/ ১১৮৬ ও ১১৮৭ দাগ’র অস্তিত্ব রয়েছে।
এছাড়া পটুয়াখালী কালেক্টরেট অফিসের রেকর্ড রুম শাখা’র দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মাহবুবুল ইসলাম’র স্বাক্ষর জাল করে ১১-১০-১৮ তারিখ লেখা সহিমোহর পর্চা সৃষ্টি করা হয়েছে।
দিয়ারা সেটেলমেন্ট অপারেশন বরিশাল অফিসের আপত্তি অফিসার মনিরুল ইসলাম’র স্বাক্ষর জাল করে সৃষ্ট ২৫-০৯-০৭ তারিখ লেখা বিএস হাত পর্চা সৃষ্টি করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, নীলগঞ্জ ইউনিয়নের ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা তানিয়া আক্তার মুক্তা ০৮-০৫-১৯ তারিখ ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ রসিদ (জি-১৬৪৪৩০) এ ১৩৭৯ থেকে ১৪২৫ পর্যন্ত ৪৬ বছরের ভূমি উন্নয়ন কর একত্রে নিয়ে আম্বিয়া খাতুন’র নামে খাজনা দাখিলা প্রদান করেন।
এর প্রেক্ষিতে ০৯-০৫-১৯ তারিখ দলিল লেখক আবদুল্লাহ আল মামুন (সনদ নং ৬৮৪) ২০৫২/১৯ নং রফিকুল ইসলাম (সনদ নং ০৮) ২০৫৩/১৯ আন্ধারমানিক নদীর ডুবোচরের ওই জমি পৃথক দু’টি সাব কবলা দলিল লিখে রেজিষ্ট্রী সম্পাদন করেন।
উল্লিখিত দলিলের দাতা আম্বিয়া খাতুন এবং গ্রহীতা ওয়াই কে জেড কনষ্ট্রাকশন সলিউশন লি:’র পক্ষে ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালমান আহমেদ।
কলাপাড়া ভূমি অফিসের নাজির মিহির কুমার বলেন, ’ভূমি অফিসের ১নং রেজিষ্ট্রারে এসএ ৫৯১/১ খতিয়ান ও ১৭৬/ ১১৮৬ ও ১১৮৭’র কোন অস্তিত্ব নেই।’
সার্ভেয়ার হুমায়ুন কবির বলেন, ’আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না।’
পটুয়াখালী রেকর্ড শাখা’র দায়িত্ব প্রাপ্ত সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট ডিপ্লোমেসি চাকমা বলেন, ’রেকর্ড শাখায় এ খতিয়ান ও দাগের কোন অস্তিত্ব নেই। রেকর্ড শাখা থেকে এ ধরনের কোন সহিমোহর পর্চা সরবরাহ করা হয়নি।’
বরিশাল সেটেলমেন্ট অফিসের চার্জ অফিসার সুখেন্দ্র শেখর সরকার বলেন, উল্লিখিত বিএস খতিয়ান ও ডিপি সঠিক নয়।’
এ বিষয়ে নীলগঞ্জ ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা তানিয়া আক্তার মুক্তা বলেন, ’অফিস রেজিষ্ট্রারে সোনাতলা মৌজার এসএ ৫৯১/১ খতিয়ান ও ১৭৬/ ১১৮৬ ও ১১৮৭ দাগ’র কোন অস্তিত্ব নেই। অনেকেই এসেছিল এটি জানতে, এধরনের কোন খতিয়ান খোলা নাই। এছাড়া খাজনা দাখিলার নম্বর কিংবা কপি না দেখে আমার প্রদত্ত কিনা এ মুহুর্তে বলতে পারছিনা।’
সাব রেজিষ্ট্রার কাওসার খান (বর্তমানে নারায়ন গঞ্জের আড়াই হাজার ষ্টেশনে কর্মরত) বলেন, ’কেউ যদি জাল জালিয়াতি করে সেটি দেখার আমার সুযোগ নেই। তহশিলদার প্রদত্ত খাজনা দাখিলা দেখে আমি রেজিষ্ট্রী করেছি।’
কলাপাড়া সহকারী কমিশনার (ভূমি) জগৎ বন্ধু মন্ডল বলেন, ’সংশ্লিষ্ট শাখার সার্ভেয়ার ছুটিতে রয়েছে। বিষয়টি না জেনে এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না।’
কলাপাড়া ইউএনও আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক বলেন, ’এটা যদি সঠিক বন্দোবস্ত না হয়ে থাকে তাহলে সাব রেজিষ্ট্রারকে দলিল বাতিল করার জন্য বলা হবে। এছাড়া ভূমি অফিসের কাগজপত্র যাচাই করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।’