আজ রবিবার (১১ জুলাই) ‘বরিশালের জলবায়ু বিপদাপন্নতা, অভিযোজন পরিকল্পনা ও উত্তরণের পথঃ প্রেক্ষিত তারুণ্যের উদ্যোগ বিষয়ক এক মিডিয়া সংলাপে অংশ নেয়া বক্তারা বলেছেন জলবায়ু পরিবর্তনকে অস্তিত্ব সংকট হিসেবে বিবেচনা করে উপকূলীয় জেলা ও শহরগুলোর অভিযোজন ক্ষমতা এবং সহিষ্ণুতা বাড়ানোর জন্য যথাযথ স্থানীয় পরিকল্পনা ও পর্যাপ্ত বরাদ্দের সংস্থান করা দরকার।
শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিক থেকেও বরিশাল পিছিয়ে আছে। যোগাযোগ অবকাঠামোর দিক থেকেও দুর্বল । যথাযথ অভিযোজনের উদ্যোগ নিলে মোট ক্ষতির ৬০ শতাংশ হ্রাস করা সম্ভব তারা মনে করেন।
গণমানুষের সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগের দাবি তুলেছেন বরিশালের তরুণ জলবায়ু কর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
অংশগ্রহনকারীরা জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষদের জন্য নগর পরিকল্পনা গ্রহণ এবং পুর্ণবাসনের উদ্যোগ এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয়সহ অংশীদারিত্ব বির্ণিমানের সুপারিশ করা হয়।
এই উদ্যোগের মাধ্যমে বরিশাল অঞ্চলের জলবায়ু বিপদাপন্নতা চিহ্নিত করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার পাশাপাশি স্থানীয় অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়নে অবদান রাখবে বলে আশাবাদ উদ্যোক্তাদের।
আসন্ন জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন (কপ২৬ সম্মেলন) কে ঘিরে ’দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশে’র সহযোগিতায় যুব নেটওর্য়াক ’ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস’ এই সংলাপের আয়োজন করে।
বরিশালে জলবায়ু সংকটজনিত সমস্যা সমূহ চিহ্নিত করণ এবং সমস্যা উত্তরণে তরুণদের ভাবনা শীর্ষক একটি মাঠ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের উপরে সংলাপে অর্ধশত গণমাধ্যমকর্মী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও তরুণ জলবায়ু কর্মীরা এ ’জুম’ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। এসব কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা কম।
ব্রিটিশ কাউন্সিলের কপ২৬ ইয়ুথ চ্যালেঞ্জ ফান্ড বিজয়ী সোহানুর রহমানের সঞ্চালনায় সংলাপে মূল তথ্যপত্র উপস্থাপন করেন ইয়ুথ ক্লাইমেট অ্যাম্বাসেডর সায়লা শবনম রিচি, হাফিজুল ইসলাম রুম্মন, মাহমুদুল হক মাহিম ও মুনেম শাহরিয়ার।
২০১৫ সালে ’কেমফডাব্লিউ’র জার্মানির কারিগরি সহায়তায় বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এই সমীক্ষা চালায়।
মূল তথ্যপত্রে বলা হয়, বিশ্ব উষ্ণায়ণ ও ভৌগলিক গত কারনেই বরিশাল জেলা ও নগর জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বিরূপ প্রভাবের শিকার হচ্ছে। এই প্রভাব সরাসরি এখানে বসবাসকারী মানুষ ও আশেপাশের পরিবেশকে চরমভাবে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। এছাড়াও তাদের দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যহত করছে।
তারুণ্যের চোখে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারনে সৃষ্ট সমস্যা সমূহ হচ্ছে, কীর্তনখোলা নদীতে লবনাক্ততা বৃদ্ধি, নদী ভাঙণের কারনে দারিদ্যতা ও বাস্তুচ্যুতি, সুপেয় পানির সংকট, অত্যধিক গরম, অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি, জলবায়ু উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবহারে কারনে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা, উপকূলীয় অঞ্চলে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, দারিদ্রতা, বেকারত্ব, বাল্যবিবাহ, অপুষ্টি ও পানিবাহিত রোগের বৃদ্ধি প্রভৃতি।
‘বরিশাল নগরের বিপদাপন্নতা বিশ্লেষণ ও সম্ভাব্যতা যাচাই’ শীর্ষক সমীক্ষা এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরিশাল শহরের বাৎসরিক (জীবন, জীবিকা ও সম্পদের) ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮০ কোটি টাকা (১০ মিলিয়ন ইউএস ডলার)। যা বরিশালের মোট মূল্য সংযোজন উৎপাদনের ৬ শতাংশ। সবচেয়ে বড় হচ্ছে আপদ মৌসুমী বন্যা ও ঘুর্ণিঝড়।
এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করলে ২০৫০ নাগাদ প্রতি বছর গড়ে ১৩০ মিলিয়ন ডলার ক্ষয়ক্ষতি হবে যদি হয়। অথচ নগরীর পশ্চিম অংশে বন্যা সহনশীল ফসল উৎপাদন করা গেলে কৃষিক্ষেত্রের ৪০ শতাংশ মোট ক্ষতি হ্রাস করা সম্ভব।
তরুণরা স্থানীয় অভিযোজনের উপর বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের দীর্ঘমেয়াদী রুপকল্প তুলে ধরেন। সমাধানের পথ হিসেবে নগরের ড্রেনেজ সিস্টেমের উন্নয়ন, বন্যা সহনশীল বাড়ি নির্মাণ, খাল খনন, বন্যা সহনশীল শস্যের প্রচার, বাঁধ নির্মাণ, আগাম সর্তকবার্তা প্রদান, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির উপর গুরুত্ব দিতে আহবান জানানো হয়।
এছাড়া সমাজের নেতৃত্বে স্থানীয় অভিযোজন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, সকলের জন্য সুপেয় পানি, যথাযথ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও সঠিক স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করা, দারিদ্রতা দূরীকরণ এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা জোরদার করা, ক্ষতিগ্রস্ত’ মানুষদের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার দাবি জানান।
এ প্রসঙ্গে বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার জানান, অতিরিক্ত বৃষ্টির জন্য যে মৌসুমী বন্যা ও ঘুর্নিঝড় ও নদী ভাঙন হচ্ছে এতে বরিশালের মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আমাদের প্রকৃতি আসলেই হুমকির সম্মুখীন। আগামী দিনগুলোর জন্য আমাদের সচেতনতা জরুরী। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে আমাদের অঙ্গীকার বির্ণিমান করা। আমাদের যৌথ মনিটরিং ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে যথাযথভাবে এই বিষয়গুলোতে দৃষ্টি দেয়া যায়।
আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব পড়ছে তা মোকাবিলায় আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। জলবায়ু সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আমাদের নিজস্ব যে সীমাবদ্ধতা ও কাজের অভাব রয়েছে কিংবা আমাদের কাজগুলোকে কিভাবে আরো সম্প্রসারিত করতে পারি সে বিষয়ে তরুণদের সাথে নিয়ে জেলা প্রশাসন কাজ করবে।
ক্লাইমেট পার্লামেন্ট বাংলাদেশের আহ্বায়ক নাহিম রাজ্জাক এম.পি জানান, জলবায়ু পরিবর্তন এক রকমের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংকট। এ সংকট মোকাবিলায় যুব ও তরুণ সম্প্রদায় অগ্রগামী হবে অবদান রাখছেন। কারন তাঁদের ভবিষ্যত সুরক্ষিত রাখতে তাদেরকেও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পলিসিতে অনেক কিছু বলা থাকলেও তা তৃণমূল পর্যায়ে বাস্তবায়িত হচ্ছেনা এবং অনেক অমিল রয়েছে। তাই আমাদের নীতি-নির্ধারক ও জনপ্রতিনিধিদের পলিসি অ্যাডভোকেসিতে আরো বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে।
আয়োজক সূত্রে প্রকাশ, জাতিসংঘের ২৬তম জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলন বা ‘কপ ২৬- ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্স’ চলতি বছরের নভেম্বর মাসের ১ তারিখ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে যুক্তরাজ্যের সভাপতিতে অনুষ্ঠিত হবে।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জাতিসংঘের ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনকে সামনে রেখে বৃটিশ কাউন্সিল বিশ্বব্যাপী তরুণ সংগঠকদের সম্পৃক্ততার জন্য ‘কপ-২৬ চ্যালেঞ্জ ফান্ড’ চালু করে।
যুব সংগঠক সোহানুর রহমানের প্রস্তাবিত একটি সামাজিক উদ্যোগ ব্রিটিশ কাউন্সিলের চ্যালেঞ্জ ফান্ড বিজয়ী হয়। এই উদ্যোগের অধীনে বরিশাল জেলায় ২৫ জন তরুণ জলবায়ু দূত গড়ে তোলা হয়।
এই সামাজিক উদ্যোগ সমূহের মধ্যে রয়েছে, তরুণ দল গঠন, ২৫ জন তরুণ জলবায়ু দূতের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সপ্তাহব্যাপি প্রশিক্ষণ আয়োজন, নিয়মিত ফলোআপ সভা, ভার্চুয়াল জলবায়ু সংলাপ (বাংলাদেশের ব্রুনাই রাষ্ট্রদূত, বাংলাদেশ লন্ডন হাই-কমিশন, বাংলাদেশে সুইডেন ও নরওয়ের রাষ্ট্রদূত), সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে লিংকেজ সভা, সোস্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন, মিডিয়া ডায়লগ, অ্যাডভোকেসি সভা ইত্যাদি।