জীবনের প্রতি হতাশ হয়ে ৬৫ বছর বয়সে অবসর গ্রহণের পরে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন আমেরিকার কর্নেল হারল্যান্ড ডেভিড স্যান্ডার্স। তাঁর জন্ম ১৮৯০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর।
মাত্র ৫ বছর বয়সেই তিনি বাবাকে হারান। বাবাকে হারানোর পরে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। যখন তাঁর মা বাইরে কাজ করতে যেতেন, হারল্যান্ডকে তাঁর ছোট ভাই ও বোনকে দেখেশুনে রাখতে হত। রান্না করতে হত। মাত্র সাত বছর বয়সেই বেশ ভাল রান্না শিখে গিয়েছিলেন তিনি। কয়েক বছর পরে আবার বিয়ে করেন তাঁর মা। নতুন বাবার অত্যাচারে হারল্যান্ডকে সেই বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বেরিয়ে আসতে হয় এবং ১৯০৩ সালে স্কুলটুল ছেড়ে দিয়ে একটা খামারে কাজ করতে শুরু করেন তিনি।
মায়ের পরামর্শে ১৯০৬ সালে তিনি তাঁর এক কাকার সঙ্গে দেখা করেন। সেই কাকা কাজ করতেন ইন্ডিয়ানার নিউ আলবানিতে। একটি গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানিতে। কাকা তাঁকে ওই কোম্পানিতেই গাড়ি রং করার একটি চাকরি করে দেন। কিন্তু সেটাও তাঁর টিঁকল না। ১৭ বছর বয়সের মধ্যে মোট ৪ বার চাকরি খোয়ালেন তিনি। তবু ১৮ বছর বয়সেই বিয়ে করে ফেললেন। ১৯ বছর বয়সেই হয়ে গেলেন বাবা।
তার পরে রেলে চাকরি। সেই চাকরির পাশাপাশি করেসপন্ডেন্স কোর্সে আইন পড়তে শুরু করলেন হারল্যান্ড। কিন্তু বিবাদে জড়িয়ে পড়ায় রেলের চাকরিটিও হারাতে হল তাঁকে। এর প্রভাবও পড়ল সংসারে। দুই মেয়েকে নিয়ে স্ত্রী জোসেফিন চলে গেলেন তাঁর বাবা-মায়ের কাছে।
আইন পাস করে শুরু করলেন প্র্যাক্টিস। ভালই পশার জমিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বদ মেজাজের জন্য সব মক্কেলই আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগলেন। ফলে বন্ধ হয়ে গেল আইন প্র্যাক্টিসও। এর পরে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন এবং সেখানেও তিনি ব্যর্থ হলেন। তার পর যোগ দেন ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে। কিন্তু সেখানেও আলোর মুখ দেখতে পাননি তিনি।
এর মধ্যে একদিন নিজের মেয়েদের নিজেই অপহরণ করতে গিয়েছিলেন। সেটাও পারেননি। এর পর চাকরি নিয়েছিলেন রেললাইনের কন্ডাকটর হিসেবে। কিন্তু সেখানেও সুবিধে করতে পারলেন না।
তার পর কাজ নিলেন জীবনবীমায়। সেটাতেও ব্যর্থ হলেন। ক’দিন পরেই শুরু করলেন নিজের ফেরি সংস্থা। সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। আরম্ভ করলেন অ্যাসিটিলিন বাল্ব তৈরির কাজ। এ সময় বাজারে এসে গেল নতুন ইলেকট্রিক বাল্ব। যার ফলে বন্ধ হয়ে গেল তাঁর বাল্ব তৈরির কাজও।
অবশেষে এক ক্যাফেতে রাঁধুনির চাকুরি নেন তিনি এবং শেষ পর্যন্ত সেখানেই থিতু হন।
৬৫ বছর বয়সে তিনি অবসর নেন। রিটায়ারমেন্টের সময় সরকারের কাছ থেকে ১০৫ ডলারের একটা চেক পেয়েছিলেন।
তখন তাঁর মনে হয়েছিল, তাঁর জীবনটাই বৃথা। মূল্যহীন। তাই তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আত্মহত্যা করার। আত্মহত্যা করতে যাওয়ার আগে একটি গাছের নীচে বসে জীবনে কী কী অর্জন করেছেন তার একটা লিস্ট বানাতে শুরু করলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল, তিনি কি কিছুই পারেন না? তখনই তাঁর খেয়াল হল, তিনি পারেন। সবার চাইতে একটি জিনিস তিনি খুব ভাল পারেন। আর তা হল— খুব ভাল রান্নাবান্না।
ফলে ৮৭ ডলার ধার করলেন সেই চেকের বিপরীতে। আর সেই ডলার দিয়ে কিছু মুরগি কিনে এনে নিজের রেসিপিতেই সেগুলো ফ্রাই করলেন। তার পর কেন্টাকিতেই প্রতিবেশীদের দরজায় দরজায় গিয়ে সেই ফ্রাইড চিকেন বিক্রি করা শুরু করলেন! নাম দিলেন কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন। যেহেতু কেন্টাকি শহর থেকেই এর যাত্রা শুরু হয়েছিল, তাই তার স্মরণেই এই নাম। যাকে বিশ্বের সবাই এখন সেই নামের সংক্ষিপ্তকরণ ‘কে এফ সি’ নামেই বেশি চেনেন। আর এই রেস্তোরাঁর অসামান্য স্বাদের খাবারের জন্যেই ১৯৫০ সালে কেন্টাকির গভর্নর তাঁকে ‘কর্নেল’ উপাধি দেন। যেটা একটি রাজ্যের পক্ষে সর্বোচ্চ সম্মান।
৬৫ বছর বয়সে যিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন, সেই কর্নেল হারল্যান্ড ডেভিড স্যান্ডার্সই ৮৮ বছর বয়সে হয়ে যান বিলিয়নিয়ার।
১৯৮০ সালের ১৬ ডিসেম্বরে ৯০ বছর বয়সে বিশ্বখ্যাত এই ব্যবসায়ী মারা গেলেও, না, বিলিয়নিয়ার হিসেবে নয়, তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন কে এফ সি-র প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে! যাদের গোটা বিশ্বজুড়ে কর্মীসংখ্যা এখন প্রায় সাড়ে সাত লাখ।