গল্প: মূলধন

ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
23 মিনিটে পড়ুন

তারস্বরে ডেকেই চলেছে। জানলা ফাঁক করে ওদিকে তাকালাম। পাশের বাড়ির শীর্ণ আম গাছের ডাল সীমানা ডিঙিয়ে আমাদের ড্যাঙাতে। নিচু ডালে পাতার আড়ালে এক জোড়া কোকিল। চকচকে গা। লাল চোখ। দেখতে পেয়ে মনটা ভালো হয়ে গেল। মায়ের ঘরে ঢুকে মশারির খুঁট খুলতে খুলতে ভারি গলায় বললাম, ‘শীতেই এত পুলক ওদের…।’ মায়ের মলিন মুখটায় মৃদু হাসি। বললেন, ‘আজকের দিনটা ভালো যাবে দেখিস…।’ মনে মনে বললাম, ‘ধুস।’
মায়ের অগোছালো বিছানায় পায়ের কাছে তখন কার্তিকের নরম রোদের হামাগুড়ি। মাথার কাছে এক হাত ব্যাসের রঙচটা গোল টেবিল। তাতে মালিশের হরেক কিসিম তেল, এলোমেলো ছড়ানো ট্যাবলেট। ওদিকে একবার তাকিয়ে আমি চা করতে গেলাম। একটু পরে দু’কাপ চা অতি সাবধানে টেবিলের ফাঁকা জায়গায় রাখলাম। বিছানায় কাত হওয়া প্লাস্টিকের জারে মারি বিস্কুট। বিস্কুটে মচ করে একটা কামড় বসিয়ে চায়ে চুমুক দিতে ঘাড় নামিয়েছি, অমনি মুঠো ফোনের রিংটোনে কোকিল ডাক। মনিটারে তপাদা। বুড়ো আঙুলের এক খোঁচায় ফোনটা কেটে দিলাম।
মায়ের মুখে বিস্ময়, ‘কিরে কেটে দিলি যে!’
সকালে আমার গলাটা ভারি হয়ে থাকে। ধরা গলায় বললাম, ‘এটা আমার নিজস্ব সময়।’
মা কাঁপা হাতে ডান হাতের বাঁকা আঙুল গুলো দিয়ে চায়ের কাপটা তুললেন। ভাবিত মুখ। বোধগম্য হলো না কী ভাবছেন। নিঃসঙ্গ মানুষের অনন্ত ভাবনা আর বিচিত্র অনুভূতির তল পাওয়া দায়। সারাদিনই বাড়িতে একা, প্রায় শয্যা-বন্দী জীবন। একান্ত প্রয়োজনে দাঁতে দাঁত চেপে দেওয়াল ধরে হাঁটেন। চার দেওয়ালে আটক মানুষটাকে সঙ্গ দিতে কয়েক জন মানুষের অবশ্য আনাগোনা আছে বাড়িতে। আপন এক পিসি, তিন-চার জন প্রতিবেশী। তাঁরা নিজেদের সংসারের ঝক্কি-ঝামেলা সামলে মায়ের পাশে বসেন মাসে এক আধ দিন। আমিও রোজ সময় দিইনা। যে দিন সকালে পড়ানো থাকে, সাতটার মধ্যে বেরিয়ে যাই। তবে বাড়িতে থাকলে সকালে রান্না ঘরে ঢুকি। আমার হাতের ছোঁয়ায় সস্তা চা-পাতা নাকি মকাইবাড়ির গন্ধ ছাড়ে।
সকালের এ সময়টাতে, সপ্তাহে তিন চার দিন চায়ের আসরে আমাদের যা একটু কথা-বার্তা হয়। বিষয়ের বহু বিস্তার। বাজার দর থেকে বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য থেকে সঙ্গীত, নিমকি থেকে নাটক। গত সাত দিন ধরে ছন্দ মিলিয়ে বড় একটা কবিতা লিখেছিলাম। ভাবছিলাম আজ ওটাই মাকে শোনাব। তারপর মায়ের কাছে পাণ্ডুলিপি রেখে যাবো। এখনো আমার বানান ভুল মাকে শুধরে দিতে হয়। পাঞ্জাবীর বুক পকেট থেকে কবিতা লেখা ভাঁজকরা কাগজ বের করতে যাব ঠিক তখন মায়ের সুরেলা গলায় আবার সওয়াল, ‘ফোনটা কার ছিল রে?’
আমি জানি মা কী উত্তর পেলে খুশী হবেন। ফোনের ও-প্রান্তের মানুষ কোন বকুল জবা চাঁপা কাবেরি জাতীয় স্ত্রী লিঙ্গি হলেই মার মুখ নিমেষে ঝলমল করে উঠতো। কিন্তু মাকে নিরাশ করে শুকনো গদ্যে বললাম, ‘তপাদার ফোন।’
-কে তপাদা?
-তপব্রত সরখেল। কবি যশ পিয়াসী আবার ব্যাবসায়ী। ‘অমৃতস্য পুত্রা’র সম্পাদক। তুমি চিনবে না।
– বুঝলাম। ওর পত্রিকাতেই তো প্রতি মাসে তোর গল্প ছাপে। তো ফোনটা কাটলি কেন?
-লেখার জন্য ঘন ঘন তাগাদা মারছেন।
চায়ে বড় একটা চুমুক মেরে গোল চোখ তুলে মা বললেন, ‘এই ব্যপার! তুই আজকাল পত্রিকার গুরুত্ব বুঝে লেখা পাঠাস? ভালো, সেটাই তো উচিৎ।’
এর পর আরও কিছু কথা হোল মা’র সাথে। তপাদার কথা বললাম, ‘টাকার কুমির ওরা। প্রাসাদের মত বাড়ি, দু’খানা গাড়ি। একটা বোলেরো আরেকটা ডিজায়ার। গোটা ট্রান্সপোর্ট ব্যাবসার কার্যত মালিক এখন তপাদা।’
কড়া নাড়ার শব্দে আলোচনায় ছেদ। সন্ধ্যাদি এসময় রান্না করতে আসে। দরজা খুলে আমি নিজের ঘরে এসে বসলাম। বাজার যেতে হবে না, মজুত আলু পেঁয়াজে চলে যাবে আজ। বেশ নিরিবিলি সকাল। স্থির সময়। লেখায় মন দেবো ভাবছিলাম। শান্ত পরিবেশে তরতর করে লেখা এগোয়। সবে কলম ধরে নোতুন গল্পের প্রথম লাইন লিখেছি, তখনি তপাদার ফোন। ধরলাম। জরুরী তলব, ওনার বাড়ি যেতে হবে। ওখানেই গল্প কবিতার জমাটি আড্ডা বসবে।
কথা শুনে মেজাজটা খিঁচরে গেল। মনোভাব চেপে স্বরে ভদ্রতার মিশেল দিলাম, ‘হ্যাঁ আমি তৈরি হয়ে একটু পরে যাচ্ছি।’
লেখার মুডটাই ঘেঁটে গেল। বড় বিরক্তিকর একটা লোক। ওর জন্য আমাদের ফ্রেন্ডস ইউনিয়ন ক্লাবে সকাল-সন্ধ্যার আড্ডাটা উঠে যাবার জোগাড়। বিপুল আর আমাকে যখন-তখন ডাক। বিপুল সরকারি স্কুলে কেমিস্ট্রি পড়ায় আর নিয়মিত বিজ্ঞান-প্রবন্ধ লেখে। তপাদার দাবি, প্রতি মাসে বিপুল আর আমাকে লেখা দিতে হবে। বড় মাপের লেখা। পাঠক খাবে এমন গল্প লিখতে হবে আমাকে। বিপুলের সহজ ভাষায় প্রবন্ধ।
দেড় বছরে আমার এগারোটা গল্প ছেপেছে কিন্তু একটা পয়সা ঠেকায়নি। ব্যাপারটা নিয়ে আমার তেমন হেলদোল ছিলনা। বিপুলের কথায় আমার টনক নড়ল। একদিন চাঁচাছোলা ভাষায় ও বলল, ‘পত্রিকার ভালো বিক্রি, দশ পাতা ফুল-পেজ বিজ্ঞাপন ছাপে। কর্মচারীদের টাকা দেয়। লেখকদের বেলায় শুধু হাত টান?’
একটু থেমে জলন্ত সিগারেটের টুকরোটা বাঁ-পায়ে জুতোর নিচে ঘসে নিয়ে ঋত্বিক ঘটকের কবিতার দুটো পঙক্তি শোনাল, ‘আমি একটি ইতরের দেশে থাকি/এখানে বনিকেরা লেখকদের উদ্ভাবন করে…।’
বিপুলের চোখা প্রশ্নের উত্তরে আমি সরাসরি আত্মসমর্পণ করলাম, ‘ঠিক কথা। কিন্তু তপাদার মুখের উপর আমি ‘না’ বলতে পারি না রে! পায়ের নিচে মাটি কই?’
প্রসঙ্গ বদল করল বিপুল, ‘পরশু দিন আমাকে ধরেছিল তপাদা। একটা কন্ডোলেন্সের পর স্কুল ছু্টি। ভরদুপুরে আমার বাড়ি চলে এল। তারপর নাগাড়ে ভাষণ। বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরতের পর নাকি বঙ্গ সাহিত্য শুধু গরগরিয়ে নিচে নেমেছে। লোকটা সদ্য এরকম কোন লেখা পড়ে ঝাড়ছে, বুঝলি।’
-আমাকেও ধরেছিল সেদিন বিকেলে’। হাসতে হাসতে আমি বললাম,
-তারপর?
-বাস স্ট্যান্ডে স্পেসাল চা-এ চুমুক দিয়ে টানা দু’ঘণ্টা ভজর ভজর। পাকড়াও করে মোটর সাইকেলে ওর বাড়িতে নিয়ে গেল। একটা কবিতা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘দ্যাখ কেমন লিখেছি’!
-আমার মাথা বাঁ-দিকে হেলে গেল। মাতব্বর কবিতা-বোদ্ধা নই যে মূল্যায়ন করবো? ভালো-মন্দ তো বলবে পাঠক। তবু তুল্য-মুল্য বিচারের কথা না ভাবলেও বুকে একটা কাঁটা খচ করে উঠলো।
-কেন?
একটু থেমে বিপুলের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘যথেচ্ছ পঙতি চুরি করেছে তপাদা। নামি-অনামি কবি, বাদ নেই কেউ। ফলে ওর কবিতার ভাব-অনুভুতি–অর্থ সবই পরস্পর বিরোধী।
-তুই কিছু বললি না?
-একে সম্পাদক, তার উপর শহরের গন্যি-মান্যি। আসল কথা মুখের উপর বলা যায়?
গলা ফাটিয়ে হাসল বিপুল। বলল, ‘একটু বোস, সিগারেট কিনে আসছি’।
একা বসে তপাদার বিষয়ে জাবর কাটছি আমি। নিজের বাড়ির একতলায় ভালো একটা অফিস খুলে সাজিয়ে গুছিয়ে পত্রিকা চালাচ্ছে। মাইনে করা প্রুফ রিডার। একজন নিষ্ঠাবান কালেক্টর, লেখা জোগাড় করতে শহরের যত্রতত্র হানা দেয়। মাঝবয়সী এক ভদ্রমহিলা আয়-ব্যায়ের হিসাব রাখেন। এই তিন জন কর্মচারী অবশ্য ওদের পরিবহণ দফতরের কাজও সামলায়।
তপাদা সকাল-সন্ধ্যে পত্রিকা দফতরে সশব্দে বিরাজ করেন। বড় টেবিলের পেছনে গদিওয়ালা চার-চাকা চেয়ারে তলাপাত্র ট্রান্সপোর্ট এবং অমৃতস্য পুত্রার মালিক। ডাইনে–বাঁয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ নাচিয়ে কথা বলেন নাদুস-নুদুস দুই পুত্রের জনক তপদা। কথায় শক্তি আর আত্মবিশ্বাসের যুগলবন্দী।
সাফল্যের তেল চুকচুকে মুখের সামনে শিরদাঁড়া টান করে আমি অপ্রিয় শব্দ বলি কি করে? নিজেই যেখানে একটা আটার ফেলিওর। ব্যর্থতায় ঝলসানো আদ্যন্ত অসফল অখ্যাত গল্পকার। চল্লিশ ছুঁই ছুঁই ব্যাচেলার। মামুলি মফস্বলী কবি। বাড়িতে উইডো-পেনশন নির্ভর মা বাতে কাহিল। চিকিৎসার অভাবে শয্যাশায়ী। ব্যর্থতার তালিকা আরো দীর্ঘ। চাকরি জোটাতে ব্যার্থ, ব্যাবসা করতে গিয়ে মুখ থুবরে পড়া। পত্রিকা সম্পাদনার বাসনা হোঁচট খেয়েছে দু’বার। এহেন ভগ্নাংশে খন্ড-বিখন্ড এবং অনালোকিত জীবনের দাবীদার যে প্রেমেও ব্যর্থ হবে, বলা বাহুল্য। অথচ স্কুল-কলেজের অনেক পিছিয়ে থাকা সহপাঠি ইদানিং সাফল্যের মগডালে জাঁকিয়ে বসে আছে। হোটেল ইমারতি প্রমোটারি চিটফান্ডের ব্যবসায় ফুলে একেবারে মানি-ম্যান। যেমন, চুটিয়ে পয়সা করেছে কুমার। কেউ পিতৃ দত্ত ‘কুমার দে’ নামে ডাকে না ওকে। বলে ‘মানি দে।’ হিলির ছেলে ‘বক্সার রতন’, ওর আধুনিক নাম ‘মালদার রতন।’ রতন বা কুমার রাস্তাঘাটে দেখা হলে বলে, ‘আর কত দিন বেকার থাকবি ঢেঙা? আমার অফিসে খাতা-পত্র দেখলেও তো পারিস!’
আমি ওসব পারিনি। সামান্য উপার্জন, কুণ্ঠিত জীবন-যাত্রা। সরকারী পাঠাগারে নিখরচায় বই পড়ি। আর প্রত্যেক দিনই পদ্য-গদ্য-প্রবন্ধ যা’হক কিছু লিখি। কেন লিখি, লেখক হবার বাসনা কত ডিগ্রী খাঁটি, ভাবি না। অল্প কিছু লেখা ছেপেছে স্থানীয় পত্রিকায়। বেশির ভাগ লেখাই না-ছাপা। বাবার পুরানো কাঠের আলমারিতে ডাই করা পাণ্ডুলিপি।
মা অনেক সময় বলেন, ‘আর কত লিখবি? পয়সা না পেলে এ সবের কী দরকার!’ দরকার নেই আমি জানি। তবু লিখি। হয়ত হাঁ-করা সমস্যা অভাব আর জীবন সংগ্রামের আঘাত থেকে পালাবার জন্যই লিখি। মাঝে মাঝে যখন অক্ষমতা গুলো প্রকট হয়, রাতে বিছানায় শুয়ে বাচ্চা ছেলের মত চোখের জল ফেলি।
যেমন মায়ের অসুখটা। হাঁটু দু’টো পাল্টালে মা আবার আগের মত হাঁটতে পাড়বেন। কতই বা বয়স, একষট্টি। মেধা-স্মৃতি-অনুভুতি সবই টান টান। অঙ্গন নাট্য মঞ্চে বহু অভিনয় করেছেন। পরিচালক রামমাধব বাবু খুবই তারিফ করতেন মায়ের অভিনয়। সেই মা, বাবার মৃত্যুর পর থেকেই চলশক্তি হীন। যদিও গত মাসেই কলকাতার ডাক্তার বলেছেন, হাঁটুর অপারেশন করাতে পারলে আবার চলাফেরা সম্ভব। কিন্তু প্রয়োজনীয় দু-লাখ টাকার বিশাল অঙ্কটা ভাবতেই মাথা বন বন করে ওঠে।
ঘোর কাটল বিপুলের ধাক্কায়। ও একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে আমার পিঠে আরেকটা ঠেলা মেরে বলল, ‘তারপর কী বললি তপাদার কবিতা পড়ে?’
বিপুলের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন থম মেরে থাকলাম। ভাবনা গুলো এতক্ষন অন্য খাতে বইছিল। ধাতস্ত হয়ে বললাম, ‘কবিতাটা পড়ে চট করে মুখ দিয়ে কিছু বেরোল না। তপাদাকে দেখতে থাকলাম। ভরাট মুখ, ভোঁতা দৃষ্টি। শরীরী ভাষা বলছে, ‘আমি লিখেছি বাবা, ভালো তো হবেই।’ আমি আর কী বলি! ভাঙাচোরা মানুষ। আর বললেই সমালোচনা শুনছে কে? পয়সায়ালা কেউকেটা হলে না-বুঝে না-শিখে যা-খুশি লেখা যায়। আর ওদের লেখারই কাটতি, পাবলিক গদ গদ মুখ করে খায়। ফেস বুকে হাজার মানুষ লাইক পাঠায়।’
বিপুল অস্থির। আমার ঘাড় ঝাকিয়ে দিয়ে বলল, ‘তো কবিতাটা পড়ে তুই কী বললি?’
-বললাম, দারুন লিখেছেন তপাদা। অসাধারণ, গভীর, মনস্তাত্বিক।’
হাসতে হাসতে আড্ডা ভেঙ্গে দিয়ে উঠে গেল বিপুল। আমিও মায়ের একটা ওষুধ কিনে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম।
বাড়িতে লেখার টেবিলে বসবার পরই আবার ফোনটা বাজলো। তপাদার ব্যস্ত গলা, ‘কিরে কখন আসবি? লেখাটা আনবি কিন্তু?’
‘একটু পরে যাবো। বাড়িতে কাজ আছে’ বলে লক্ষ্য করলাম আমার দূরমনস্ক স্বরে অন্য রকম অভিব্যক্তি। কেমন যেন তাচ্ছিল্যের ছোঁয়া! মনে মনে তপাদার উদ্দেশে বললাম, ‘লেখা কি এতই সস্তা?’
যে ভাবে মুঠির উপর থুতনি রেখে ভাবতে বসি, আমি তেমনি বসে রইলাম। মনের সাথে প্রশ্নোত্তর চলছিল। আগে তো তপাদা ডাকলেই ছুটে যেতাম। আজ উপেক্ষা করছি? হঠাৎ কী হোল? ইদানীং কি আমার বিধ্বস্ত মরুমনের কোনায় আত্মবিশ্বাসের সবুজ ঘাস গজাচ্ছে? জানিনা, তবে পরিবর্তনের কিছু একটা সুর বোধ হয় টুং টাং বাজছে ভিতরে। নিস্তরঙ্গ শহরে দেওয়ালে পিঠ দেওয়া বদ্ধ জীবনে ঢেউ-তোলা ঘটনা একটা হয়ত ঘটেছে। অথচ কাউকে বলতে পারছি না। চেপে থাকার কারণে ভেতরে একটা হাঁস-ফাঁস ভাব।
মা-কে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে কলকাতার বড় পত্রিকা দফতরে চুপচাপ একটা গল্প দিয়ে এসেছিলাম। তেমন নিটোল চমকে দেবার মত গল্প নয়। তবে ভিত্তিটা সত্যি।
এই শহরের এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ—মধ্যবয়সী রত্নেশ্বর দাস, মন প্রাণ ঢেলে কাপড়ের ব্যবসায় টাকার পাহাড় বানিয়ে ফেলেছেন। হাওড়ার শিক্ষিতা মেয়েকে বিয়ের পর প্রবল একটা বাসনা খোঁচা মারল মাথায় –- শিল্পপতি হোতে হবে। উদ্যোগী মানুষ, হিউম পাইপের ফ্যাক্টরি বানাতে রুপার হাটে জাতীয় সড়ক লাগোয়া এক লপ্তে তিন একর জমি ঝট করে কিনে ফেললেন। নিজের টাকা সাথে ব্যাঙ্কের ঋণ। সব দিয়ে হাসি মুখে মালিককে জমির চড়া দাম মেটালেন। দফায় দফায় নেতা-পুলিস-দালাল সবার খাঁই মিটিয়ে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন রায়গঞ্জ এসডিজেম আদালতে জমির রেজিস্ট্রেশান করালেন। অফিস ঘর, কারখানার শেড তৈরির পরিকল্পনা সব চূড়ান্ত। প্রকল্প শুরুর আগে প্রয়োজন ব্লক অফিসের মিউটেশন। ওখানেই নির্মম একটা সত্য আচমকা বজ্রপাতের মত বিচক্ষণ উদ্দোগপতির মাথায় ভেঙে পড়লো। লড়াকু মানুষটা জানলেন জমির মালিক নকল, পর্চা বেঠিক, দলিলটা জাল। দেখলেন বিস্তর আবেদনের পরও নির্বিকার প্রশাসন, অভিযোগ জমা নিতে থানা নারাজ। মুখে কুলুপ এঁটেছে রাজনীতি। ধনী মানুষটা রাতারাতি নিঃস্ব। নির্বান্ধব রত্নেশ্বর আকাশে মুখ তুলে প্রবল শোকে বুকভাঙা ক্ষোভ উগরে দিলেন। মুখের স্বতঃস্ফূর্ত ভাষায় ক্রমাগত আর্তনাদ, ‘সালা অসভ্য জংলি দেশ এটা। আইন-আদালত-ব্যাঙ্ক-পুলিশ সব ইতরের দল।’
পরের অংশে অনেকটা জুড়ে কঠোর জীবন সংগ্রামের করুণ বর্ণনা। একদম শেষে বালুরঘাট কাছারি মাঠে চা ফেরি করছেন রত্নেশ্বর। টিআরপি বাড়াতে নগর পরিক্রমায় কলকাতার টেলিভিশন চ্যানেল। রত্নেশ্বরের দিকে প্রবল গতিতে ধেয়ে এল মহিলা কণ্ঠের প্রশ্নবাণ, ‘আপনি তো খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে। আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে না?’
রত্নেশ্বরের দুমড়ানো মুখে আলো ফেলছে ক্যামেরা। কাঁধের গামছায় মুখের ঘাম মুছলেন রত্নেশ্বর। শিরদাঁড়া টানটান, ক্যামেরার লেন্সে দৃষ্টি। বললেন, ‘বুদ্ধি-দোষে সব হারিয়ে আজ আমি অট্টালিকা থেকে পথে। কিন্তু নিঃস্ব হলেও বাজারে আমার সুনাম ষোল আনা। ওটাই মূলধন। ওর জোরে আবার আমি উঠবো।’
আবার ধেয়ে এল চোখা সওয়াল, ‘কত টাকার মূলধন নিয়ে আপনি শুরু করছেন?’
দোলাচলহীন কণ্ঠে রত্নেশ্বরের চটজলদি জবাব, ‘টাকা নয়, আসল মূলধন সততা আর সুনাম। ওটা হারাই নি। ওর জোরে ঠিক উঠবো। আপনারা খবর নিতে আবার আসবেন। তখন কিন্তু সদর বাজারের কাপড় গলিতে আমার ঠিকানা খুঁজে পাবেন।’
গল্পটা মনোনীত হবে, ভাবি নি। কিন্তু গত সপ্তাহে আধ মিনিটের একটা ফোন আমার একঘেয়ে জীবনে বুকের সরু খাঁচাটার ভিতর উত্তেজনার ধুকপুক তুলে দিয়েছিল। মহিলা কণ্ঠে সুস্পষ্ট উচ্চারণ, ‘দক্ষিণদেশ থেকে বলছি। আপনার গল্প অপরাজিত মনোনীত হয়েছে।’ আনকোরা আনন্দ আর আবেগে কোন রকমে হাঁ-হু উত্তর দিয়ে তখন ফোনটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। পরে খেয়াল হল, কবে ছাপা হবে জানা হ’ল না তো! পরদিন অনেকবার চেষ্টা করে পত্রিকা দফতর থেকে জানলাম, সম্পাদিকা বিদেশ ভ্রমণে, পনের দিন পর ফিরবেন। এরপর জলদ গম্ভীর স্বরে এক পুরুষ কণ্ঠ জানালো, ‘লেখা সম্পর্কিত কোন প্রশ্ন আর করবেন না। পত্রিকা প্রকাশ হলেই সব জানতে পারবেন।’
অগত্যা চুপচাপ বসে থাকা। কাউকে এমনকি মাকেও কিছু বলতে পারছিনা। অসংখ্য তিতকুটে সব অভিজ্ঞতা জীবনে! চাকরি হচ্ছে, একদম পাকা খবর, তা-ও দু’বার মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেল! তাই সামান্য একটা ভালো খবরও কাউকে জানাতে ভয় হয়। আবার চেপে থাকায় ভিতরে একটা ছটফটানি চলছে। পরীক্ষার ফল ঘোষণার আগে অপেক্ষা-ক্লান্ত ছাত্রদের যেমন হয়। বুঝতে পারি আমার লেখার মান খুব খারাপ নয়, কিন্তু প্রমাণ করতে তো প্রশংসাপত্র চাই। ভালো পত্রিকায় ছাপলেই তো কদর।
হঠাৎ রান্না ঘর থেকে সন্ধ্যাদির উঁচু গলা, ‘দাদা, মাসিমা ডাকছেন।’ আমার ভাবনায় পূর্ণচ্ছেদ। বিছানায় বসতেই মা আমার মুখের দিকে তাকালেন। মায়ের স্বাভাবিক মলিন মুখে স্নিগ্ধ হাসি, মোলায়েম স্বরে একরাশ দরদ, ‘অপু তোর কী হয়েছে রে! কিছু লুকোচ্ছিস? আমার কাছে বলা যায়না!’
গম্ভীর থাকার চেষ্টা করলাম কিন্তু বুকের ভিতর দলা পাকানো কথা গুলো জিভের ডগায় এসে সুরসুরি দিচ্ছে। ধীরে ধীরে বললাম, ‘পাকা খবর না পেয়ে তোমাকে জানাই কী করে?’
মায়ের মনের রাডারে কী যে সব ধরা পড়ে? আমাকে অবাক করে দিয়ে বিছানায় বসে বললেন, ‘ভালো পত্রিকা তোর কি কোন কবিতা ছাপছে?’
উত্তরটা দেবার জন্য আমি তো মুখিয়ে আছি। কিন্তু ভয়, শেষ অবধি যদি না ছাপে? অভিজ্ঞতার ভাঁড়ারে তো মিঠে রসের ছিটে ফোঁটা নেই। এ সব ভেবে নিস্পৃহ কণ্ঠে বললাম, ‘কবিতা নয়, গল্প’।
মা এবার চমকে উঠলেন, ‘গল্পের চাইতে কবিতাই তো ভালো লিখিস তুই! আমাকে পড়াসনি তো? গল্পটা ওরা ছাপবে, তাও গোপন করছিস?
–ঠিক ঠাক শুনলাম কিনা সন্দেহ হচ্ছে। ওদের এডিটর ছুটিতে। পত্রিকা দফতর ফোন করতে বারণ করছে। নিশ্চিত না হয়ে….
– ঠিক আছে। ছাপা হোক বা না-হোক, গল্পটা আমাকে একবার শোনা। তোর কাছে তো কপি আছে।
এক কাপ চা দিয়ে গেল সন্ধ্যাদি। হাল্কা চুমুক দিতে দিতে মাকে ‘অপরাজিত’ পড়ে শোনালাম। ।
ধ্যানস্ত হয়ে পুরোটা শুনলেন মা। মুখে উপচে পড়ল আনাবিল হাসি। বললেন, ‘তোর লেখা বিশ্বাসই হচ্ছে না। দক্ষিণদেশ পত্রিকা লেখা ছাপলে টাকা দেয় তো?
-দেয়, তবে আমাকে কত দেবে জানিনা।
-আমার কথা শোন। তুই আর কোথাও বিনা পয়সায় লেখা দিবিনা’।
আমার স্বরে দ্বিধা। বললাম, ‘অনেক বন্ধু এমনকি মাস্টার মশায়রাও বিনা পয়সায় লেখা চান। না বলতে পারিনা। ওদের তো বোঝা উচিত আমি বেকার’।
-বেকার বলে কেউ অনুদান দিক আমি বলছিনা। সাহিত্য-নাটক-জীবনী তো কিছু পড়েছি। লেখক হল কলম পেষা মজুর। বিনা পয়সায় কোন্‌ মজুর খাটবে?
আমার উত্তরের অপেক্ষা না-করে উঁচু গলায় মা বললেন, ‘কখনও আর বিনা মূল্যে লেখা দিবিনা। ওতে তোর নয়, লেখক জাতের অপমান।

    অনেক দিন পর গরমের পড়ন্ত দুপুরে ফ্রেন্ডস ইউনিয়ন ক্লাবে আড্ডাটা বেশ জমেছিল। বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছিল না। অনেক সকালে বেড়িয়েছি। খালি গায়ে টেবিল টেনিস খেলছিল দেবু আর অভয়। দেবু দুর্দান্ত কব্জি ঘুরায়। ওর স্পিনের সামনে দাঁড়ানো মুস্কিল। বিপুল আর আমি চা-এর ভাঁড় হাতে খেলা দেখছিলাম। হঠাৎ তপাদা এসে নরম-গরম ঝাড়তে আরম্ভ করলো। আজকাল আবার রাজনীতির যোগাযোগে ক্ষমতার মই-এ তরাক করে লাফ মেরেছে তপাদা। শুধু ওর ফোনের আহ্বান উপেক্ষা করাতেই রেগে কাঁই। ভাবছি, এরপর লেখা না দিলে তো মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে!
তপাদার গরম মেজাজের দাপটে খেলা বন্ধ। ছোট বড় অসংখ্য নির্বাক সাক্ষী। একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেবু আমাকে মুখ না-খুলে কব্জি ঘুরাতে ইশারা করছে। তাণ্ডাই মাণ্ডাই-এর উত্তরে আমার ঠাণ্ডা গলা। বেশ গুছিয়ে আবেগ মিশিয়ে বললাম, ‘তপাদা, তুমি তো কবি। জানো,  একটা গল্প লিখতে শিরদাঁড়া বেঁকিয়ে স্পনডিলাইটিসে শুয়ে পড়ে লেখক। গল্প কি এমনিই বেরোয়? দিন-রাত শুধু ভাবা আর লেখা।’ 
একটু থেমে আবার বললাম, ‘অনেক কাজ ফেলে শুধু তোমার লেখার জন্য খাটছি গোটা গোটা দিন। বীজ পুঁতে জল ঢালা, অঙ্কুর, কচি গাছ, বৃক্ষ -- তারপর ফল। একটু সময় দাও’।
তপাদা আবার হিস হিস করে উঠলো। ‘বড় বড় কথা বলছিস! কত বড় লেখক রে আমার! চুল পেকে গেল, এ-ক্লাস পত্রিকায় কিছু ছাপাতে পারলি? 
আমি নিশ্চুপ। তপাদা গজ গজ করতে করতে ওর গাড়িতে চাবি ঘুরাল। দেবু আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘অপুদা, তুমি আর তপাদাকে লেখা দিওনা। ওটা পত্রিকা না সরকারি বিজ্ঞাপন গাপাবার ব্যবসা’? বিপুল আমাকে বাড়ির দিকে ঠেললো, ‘তুই এবার ওঠ। মাসীমা সারা দিন একা।’  
আমি বুক ভরা অপমান আর এক পেট খিদে নিয়ে চকভৃগুর দিকে সাইকেল ছুটালাম। এলোমেলো গরম বাতাস, আমার প্রশ্বাসে আগুন ঝরছে। মনে ঘুর পাক খাচ্ছে, ছ’ ছটা মাস পেরিয়ে গেল, আমার গল্পটা কি দক্ষিণদেশ ছাপাবে না?    
দুপুরে এ সময় সন্ধ্যাদি রান্নার পর স্নান-খাওয়া সেরে একটু জিরিয়ে নেয়। আমার কড়া নাড়ার শব্দে দরজাটা খুলেই আবার সটান মায়ের ঘরের মেঝেতে গুটিসুটি মারে। কিন্তু আজ দরজা খুললেন মা। আমি অবাক চোখে তালিয়ে রইলাম। আমার বাঁকা ভ্রু লক্ষ করে মা বললেন, ‘আজ ভালো আছি। ব্যথা কম। সন্ধ্যা রান্না চুকিয়ে হিন্দোলে ওর মেয়ের বাড়ি গেছে। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে আয়’। 
মায়ের কথায় আমার অপমান আর বুকের জমাট দুঃখ গলে জল। গায়ে জল ঢালছি। চলছে ভাবনা। কতদিন পর মায়ের মুখে ‘ভালো আছি’ কথাটা শুনলাম! সন্ধ্যাদি হয়ত যাবার আগে গত মাসে হিন্দোল থেকে আনা নতুন-পীরবাবার মন্ত্রপুত চ্যাট চ্যাটে তেলটা জম্পেশ করে দু’হাঁটুতে মালিশ করে দিয়েছে।    
একটু অবেলা হলেও বেশ তৃপ্তি করে খেলাম। মা ঘরে ডাকলেন। স্বরে একরাশ খুশি, মুখে মাত্র দুটো শব্দ ‘এই দেখ’। একটা খাম এগিয়ে ধরলেন। 
আমার নামে দক্ষিণদেশ পত্রিকা দফতর থেকে চিঠি। জানিয়েছে, আগামীকাল এ-মাসের দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশ হবে আর দশ থেকে বারো পৃষ্ঠা জুড়ে থাকবে আমার গল্প। ওদের ওয়েবসাইটে আজই দেখা যাবে। চিঠির সঙ্গে খামে দু-হাজার টাকার চেক। একটা গল্পের জন্য এত টাকা! বিপুল দেবু অজয় জানলে শহর জুড়ে হৈ হৈ ফেলে দেবে। এ মুহূর্তে আমিও আত্মহারা কিন্তু আনন্দ উচ্ছাস চেপে মায়ের সামনে শান্ত মুখে বসে রইলাম। 
আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মা বললেন, ‘লেখা চালিয়ে যা, তোর হবে।’ 
আমার জলে টল টল চোখ। বাচ্চা ছেলের মত কাঁদতে ইচ্ছে হল। কোন রকমে সামলে নিয়ে বললাম, ‘এ বয়সে নোতুন করে কী আর হবে।’  
মায়ের স্বরে আত্মবিশ্বাস। বললেন, ‘শরীর ঠিক থাকলে বয়স কিছু না। রামমাধবদা তো এখনো নতুন পালা নামিয়ে ষ্টেজ কাঁপাচ্ছেন। বয়স আশি। আর আমি পঞ্চান্ন থেকেই কাত।  ছ’ বছর ধরে কেবল শুয়েই আছি’।
বুকটা টন টন করে উঠলো। সাজা শোনার পর নতমুখ অপরাধীর মত আমি তখন স্ট্যাচু। টাকা না থাকাই এ-যুগের সবচেয়ে বড় অপরাধ। ব্যর্থতা আর অক্ষমতার ধিকি ধিকি আগুনে খাক হয়ে যাচ্ছি।  
মা মুখ খুললেন, আত্মগত কথা। ‘ভালো গল্প বা নাটক কি মুখের কথা! ভাবছি তোর এ-গল্পটার যদি নাট্যরূপ দেওয়া যায়!’ 
আমার মুখে অবিশ্বাসের দমকা হাসি। গলা অনেকটা সহজ করে বললাম, ‘তুমি পাগল হোলে নাকি? এই বাঁকা আঙুলে কলম ধরবে?’  
মায়ের স্বরে প্রত্যয়, ‘ধরতে তো পারি। সম্পূর্ণ বিকলাঙ্গ একটা মানুষ শুধু মগজ সম্বল করে বই লিখছেন, মহাকাশ চেনাচ্ছেন। আমিও লিখবো, কলম ধরতে না পারলে কি-বোর্ড তো আছে! 
তারপর একটু থেমে আবার বললেন, ‘তোর গল্প একটা রসদ, আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে রে! নাটকীয় উপাদানে ঠাঁসা বৈচিত্রময় জীবন-যুদ্ধের টানটান একটা গল্প। কাহিনিটা রামমাধবদারও মনঃপুত হবে। ভাবছি এর নাট্যরূপ লিখে ওনাকে পড়াবো।’  
- খুব খাটুনির কাজ মা। দুর্বল শরীরে তুমি পারবে?
-পারবো। আমার মনে হয় রামমাধবদা নাটকটা উৎরে দেবেন। একবার ভাবতো, যদি নাটকটা মঞ্চস্থ হয়!
-হলে কী হবে? 
-অনেক কিছু। লেখক-শিল্পীর দরকার সামান্য অর্থ আর স্বীকৃতি। সেটা পেলে তোর  অনেক কিছু হবে।
-আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়ো। 
-না রে! হতেও পারে। ধর, নাট্যরূপ দেবার পর রামমাধবদার সফল পরিচালনায় দিল্লী থেকে সর্ব ভারতীয় পুরস্কার জিতে আনল নাটকটা? কমসে কম রাজ্য একাডেমীর পুরস্কার! 
একটু থেমে চকচকে চোখ তুলে এবার বললেন, ‘অপু তুই আরো লেখ। সামনে অনেক কাজ – বাড়ি সারানো, আমার হাঁটুর অপারেশন, তোর বিয়ে।
- ওঃ একটা গল্প ছাপতেই তুমি শূন্যে উড়ছো? 
-না-রে! সম্ভাবনা আছে। তুই লেগে থাক, কলমের জোর আন। কলম পেষা মজুর সব পারে...। 
মুঠো ফোনটা বাজলো, মা থামলেন। ফোনের ওপারে তপাদা, ‘ইন্টারনেটে তোর গল্পটা পড়লাম। অতি বাস্তব, আমাদের শহরের পটভূমি।’    
ভেতরে খুশির কুলকুল ধ্বনি। তপাদার অপমান ভুলে গেছি। আমার স্বরে সফল মানুষের ঔদার্য, ‘তপাদা একটু সমালোচনা ক’রো, অনেক দুর্বলতা আছে লেখায়।’ 
-ও সব থাক এখন। তুই একবার দেখা কর। এবার মোটা টাকার সরকারি বিজ্ঞাপন পাচ্ছি। তোকে আর বাইরে লেখা দিতে হবেনা। 
মুখ নিচু করে ফোনটা রাখতেই গভীর একটা শ্বাস ফেলেলন মা। বললেন, ‘অন্যের খাঁই মেটাতে লিখিস না। অন্তরের ভালোবাসা আর কান্নায় কলম ডুবিয়ে লিখবি। ওই কলমই লেখকের মূলধন।’ 

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ড.সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা-700 026. প্রকাশিত গ্রন্থ- বিজ্ঞানের জানা অজানা (কিশোর উপযোগী বিজ্ঞান), আমার বাগান (গল্পগ্রন্থ), এবং বিদেশী সংস্থায় গবেষণা গ্রন্থ: Anticancer Drugs-Nature synthesis and cell (Intech)। পুরষ্কার সমূহ: ‘যোগমায়া স্মৃতি পুরস্কার’ (২০১৫), জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায় বছরের শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য। ‘চৌরঙ্গী নাথ’ পুরস্কার (২০১৮), শৈব ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাসের জন্য। গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরষ্কার (2019), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও জৈবপ্রযুক্তি দফতর থেকে), পঁচিশ বছরের অধিক কাল বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার জন্য)।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!