কীটনাশক প্রয়োগের ঝামেলা না থাকায়, নাটোরের কৃষকরা ঝুঁকছেন বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি চাষে। জেলায় অন্তত শতাধিক কৃষক স্বল্প খরচের এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে, ভালো ফলন পেয়ে লাভবান হচ্ছেন।
নাটোর জেলার উৎপাদিত সবজি চলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।আর জেলা কৃষি বিভাগ বলছেন, নিরাপদ সবজি উৎপাদনে কৃষকদের সব ধরণের সহযোগিতা করা হচ্ছে।কীটনাশক প্রয়োগের ঝামেলা না থাকায়, জেলাজুঁড়ে দিন দিন বাড়ছে নিরাপদ সবজির আবাদ।
একসময় এক বিঘা জমিতে কাকরোল আবাদে, কীটনাশক প্রয়োগ বাবদ খরচ হত অন্তত ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। কিন্তু বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের প্রচেষ্টায় সেক্স ফেরমেন ট্র্যাপ ব্যবহার কোরে, কীটনাশক মুক্ত সবজি উৎপাদন করছেন নাটোরের অনেক কৃষক।
এক বিঘা জমিতে ২৪ থেকে ৩০টি সেক্স ফেরমেন ট্র্যাপ স্থাপন করলে, সেই জমিতে কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয়না। ফলে, কৃষকরা একদিকে কীটনাশক প্রয়োগে স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে যেমন রেহাই পাচ্ছেন, তেমনি স্বল্প খরচে উৎপাদিত নিরাপদ খাদ্য বাজারজাত কোরে লাভের মুখ দেখছেন।
নাটোর সদর উপজেলার লক্ষীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউনিয়নের কাদিম সাতুরিয়া গ্রামের কৃষক আমজাদ হোসেন জানান, ‘জেলা কৃষি বিভাগের পরামর্শে ১০ কাঠা জমিতে বিষ প্রয়োগ ছাড়াই কাঁকরোলের আবাদ করেছি, উৎপাদনও ভালো হয়েছে, আগামীতে এই পদ্ধতিতে বেশি জমিতে আবাদের পরিকল্পনা রয়েছে।’
নাটোর সদর উপজেলার বড় হরিশপুর ইউনিয়নের ধলাট গ্রামের কৃষক তাইজুল ইসলাম জানান, ‘ইতিপূর্বে কাঁকরোল চাষ করতে রাসায়নিক ও কীটনাশক সার কিনতে, অনেক টাকা ব্যয় হতো তারপরেও পোকার উপদ্রব কমানো যেত না। কৃষি অফিস থেকে কি যেন এক ওষুধের ব্যবস্থা করেছে, তাতে ফলন ভালো হয়েছে, তবে করোনার কারণে বাইরের ব্যাপারীরা না আসায় বাজারমূল্য অনেকটাই কম।
নাটোর সদর উপজেলার ছাতনি ইউনিয়নের কৃষক ফারুক খান জানান, গ্রামের অনেকেই বিষমুক্ত সবজি চাষ করছেন এবং উৎপাদন ভালো হচ্ছে, কীটনাশক ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকছে না তাই আগামীতে আমি নিজেও বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করার মনস্থির করেছি।
নাটোর সদর উপজেলার লক্ষীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউনিয়নের ঔষধি গ্রামের কৃষক মো.শাহিন হেসেন জানান, ‘একসময় এক বিঘা জমিতে কাকরোল আবাদ করতে, কীটনাশক প্রয়োগ বাবদ খরচ হত অন্তত ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। কিন্তু বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের প্রচেষ্টায় সেক্স ফেরমেন ট্র্যাপ ব্যবহার কোরে, কীটনাশক বাবদ কোন খরছ নেই।’
নাটোরের দত্তপাড়া আড়তের বেপারী মো. ফয়সাল হোসেন জানান, ‘দীর্ঘদিন যাবৎ আমি কাঁচামালের ব্যবসা করি, চলতি বছরে কাকরোলের বাম্পার ফলন হয়েছে, প্রতিমণ এক হাজার থেকে বারোশো টাকা কৃষক দাম পাচ্ছেন। এই আড়তে কৃষকের কাছ থেকে কিনে সরাসরি ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় আমি পাইকারি বিক্রি করি।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারন বিভাগের উপ-পরিচালক, সুব্রত কুমার সরকার জানান, ‘বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণ যে কয়েকটি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তার অন্যতম কারণ হিসাবে আমি মনে করি, খাদ্য উৎপাদনে রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহার।
শাকসবজি, ধান, ফলমূল, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগী, মৎস্যসহ খাদ্য উৎপাদনের যে স্থানগুলো রয়েছে সেইখানে রাসায়নিক ও কীটনাশক সার এলোপাতাড়িভাবে ব্যবহার হচ্ছে। দিনের-পর-দিন মাসের-পর-মাস এই সমস্ত খাদ্য মানুষ খাচ্ছেন ফলে ঘুরেফিরে তা মানবদেহে বাসা বাঁধছে এবং ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন।
সুতরাং এই বিষয়টি প্রতিরোধ করার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ নাটোর জেলায় তিনটি প্রকল্পের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করছে। কৃষকদের নিরাপদ সবজি উৎপাদনে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।
নাটোরের কৃষকদের কৃষক প্রশিক্ষণ, মাঠ প্রদর্শনীর মাধ্যমে উৎসাহিত করা হচ্ছে এবং দিন দিন তারা এই নিরাপদ সবজি উৎপাদনে উৎসাহিত হচ্ছেন। তাদের উৎপাদনের পরিমাণও বৃদ্ধি হয়েছে। কৃষকরা বাজারজাত করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
সুতরাং এই কৃষকদের উৎসাহিত করার জন্য আমরা যদি বাজারব্যবস্থা উন্নয়ন করতে পারি, পাশাপাশি ভোক্তাদেরকে যদি সচেতন করতে পারি, তাহলে একদিকে যেমন কৃষক অধিক লাভবান হবেন, অপরদিকে ভোক্তা পাবেন বিষমুক্ত সবজি।
আমরা জানি নাটোরের উৎপাদিত সবজি জেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি হয়। আমরা মনে করি নিরাপদ সবজি উৎপাদনে দেশের মধ্যে নাটোর জেলা মডেল হিসেবে আখ্যায়িত হবে এবং সুনাম অর্জন করবে বলে আমি মনে করি।
নাটোর জেলায় চলতি বছর ১হাজার ৫শ হেক্টর জমি থেকে, ৩০ হাজার মেট্রিকটন নিরাপদ সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।নাটোরের কৃষকদের উৎপাদিত বিষমুক্ত সবজির আলাদা বাজার এবং মূল্য নির্ধারণ করে সরকারিভাবে প্রচার প্রচারণা ও দেখভাল করা দরকার বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষক ও নাটোরের সচেতন মহল।