১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স রমনা ময়দানে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে জেনারেল এ.কে. নিয়াজির নেতৃত্বে প্রায় নব্বই হাজার পাকিস্তানী সেনা আত্মসমর্পণ করে।
বাংলাদেশের তৎকালীন অস্থায়ী সরকার চেয়েছিল বিশেষ আদালত স্থাপন করে এসব যুদ্ধবন্দী সেনাদের বাংলাদেশে গণহত্যার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করার। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ বিষয়ে ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর ভারতকে আহ্বান জানান ও পাকিস্তানী সেনাদের বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তরের কথা বলেন। কিন্তু যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে তা সম্ভব নয়। ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেশন অনুযায়ী যুদ্ধবন্দী সেনা ও অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী সহ তাদের পরিবারের সদস্য নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর জন্য আন্তর্জাতিক চাপ থাকায় ভারত যুদ্ধবন্দীসেনাদের স্থল ও বিমানপথে ভারতে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে আপাতত বন্দী করে রাখে।
পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য এ নব্বই হাজার পাকিস্তানী সেনা হয়ে ওঠে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জন্য মোক্ষম অস্ত্র। ভারত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে বার্তা পাঠায় যে শেখ মুজিবকে যতো দ্রুত মুক্তি দেয়া হবে ততো ভাল হবে- এসব পাকিস্তানী সেনাদের জন্য। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারী শেখ মুজিব মুক্তি পান। ১০ জানুয়ারি তিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরেন। যুদ্ধবন্দীদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হলে শেখ মুজিব বলে দেন যে তার কুটনৈতিক আলোচনার টেবিলে বসার পূর্বশর্ত হল: পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশের কাছে যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে পাকিস্তানের ভেতরে ইসলামি দলগুলো আর বন্দী সেনাসদস্যদের পরিবারের সদস্যরা বিক্ষোভ করছে। এ কারণে তখন খোদ পাকিস্তান সেনাবাহিনীও ফুঁসছিল পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর। ভুট্টো দিশেহারা হয়ে ১৯৭২ সালের পুরোটা সময় জুড়ে ইরান, মরক্কো, লিবিয়া, তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, মিশর, সিরিয়া সহ পৃথিবীর বিভিন্ন ইসলামী দেশ সফর করেন। চীন-আমেরিকার সঙ্গে আলাপ করেন যাতে বাংলাদেশ ও ভারত কালক্ষেপণ না করে দ্রুত বন্দী সেনাদের মুক্তি দিতে সম্মত হয়।
২ জুলাই ১৯৭২ পাকিস্তান-ভারতের মাঝে শিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যেখানে দীর্ঘমেয়াদে শান্তি বজায় রাখার ওপর জোর দেয়া হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তান তার বন্দী সেনাদের মুক্তির বিষয়ে এক ধাপ এগিয়ে যায়। অন্যদিকে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ দেয়ার বিরোধিতা করলে বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের সদস্য হতে পারেনি। তখন শেখ মুজিব সহ তার মিত্ররা বুঝতে পারেন যে যুদ্ধবন্দীদের ফিরিয়ে না দিলে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হতে পারবে না ও আন্তজার্তিক স্বীকৃতিও পাওয়া যাবে না। ফলে বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে ত্রাণ, অনুদান, ঋণ পাওয়া সহ সবক্ষেত্রে বাঁধার সম্মুখীন হতে হবে।
১৮ এপ্রিল ১৯৭৩ পাকিস্তান সরকার ভারতে বন্দী পাকিস্তানী সেনাদের নিয়ে একটি প্রপাগাণ্ডামূল ডাকটিকিট প্রকাশ করে। এটির মূল্যমান ছিল ১.২৫ রূপি। ডাকটিকিটে লেখা ছিল: “Prisoners of War in India, Challenge to World Conscience.”ডাকটিকিটে ছিল কাঁটাতারের ওপাশে থাকা পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের ওপর হাতে আঁকা ছবি; সৈন্যদের কারো মাথায় ব্যান্ডেজ, কেউ গুরুতর আহত, কেউ সহযোদ্ধাদের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ডাকটিকিটের বাম পাশে এক দুঃখিত বালকের প্রতিকৃতি ছাপানো হয়েছে, তার পিতার ফেরার অপেক্ষায় আছে–এমন একটি মানবিক আবেদন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অথচ এসব সৈন্যরাই বাংলাদেশে মাত্র কয়েক মাস আগে ঠাণ্ডা মাথায় ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা, তিন লক্ষ নারীকে ধর্ষণ করেছে, সম্পদ জ্বালিয়ে দিয়ে সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানকে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত পোড়াভূমিতে পরিণত করেছে। ডাকটিকিটে৯০০০০ সৈন্যসংখ্যাটি ইংরেজিতে লেখা ছিল। ‘পাকিস্তান’ শব্দটি ইংরেজি ও উর্দুতে লেখা রয়েছে। বন্দী সৈন্যদের মুক্তির বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্বের জন্য ডাকটিকিট, উদ্বোধনী খাম ও ডাটাকার্ড সবকিছুই ইংরেজিতে প্রকাশ করা হয়। উদ্বোধনী খামেলেখা ছিল:“90,000 Pakistani prisoners of war languishing in Indian camps for over 15 months.” এ উপলক্ষে প্রকাশিত শাদা-কালো ডাটাকার্ডের প্রচ্ছদে যেসব বিদেশী সংবাদমাধ্যমে বন্দী সেনাদের নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তা দিয়ে কোলাজ তৈরি করা হয়েছে সেগুলো হলো: The New York Times, The washington Post প্রভৃতি। সংবাদ শিরোনামগুলো হলো: ‘Six Killed: 14 in 10 days–India guns more POWs’ ‘9000 prisoners’, ‘Indo-Pak Prosner issue Nag’, Tension raising in India POW Camps.
ডাটাকার্ডে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এর ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দেয়া বিবৃতির উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে তিনি বলেছিলেন যদি পাকিস্তানী সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে তাহলে তাদের নিরাপদে ফিরে যেতে দেয়া হবে। ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে প্রচারিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ’র বক্তব্যেরও উদ্ধৃতি আছে, যেখানে মানেকশ প্রায় একই প্রতিশ্রুতি দেন। তারপর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ অধিবেশনে গৃহিত একাধিক রেজ্যুলেশনের অংশবিশেষ ছাপা হয়েছে। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ তারিখে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত রেড ক্রসের রিপোর্ট থেকে যে অংশবিশেষ ছাপা হয়েছে; তাতে বলা হয়েছে যে: নির্যাতনের কারণে পালানোর চেষ্টা করার কারণে ভারতীয় সেনাবাহিনী কুকুর দিয়ে আটজন পাকিস্তানী সৈন্যদের নিপীড়ন করেছে ও তাদের পিটিয়েছে। এ রিপোর্টে রেডক্রসের এক ডাক্তারের সূত্র দিয়ে বলা হয়েছে যে, সাফকাত হোসাইন নামের একজন যুদ্ধবন্দীকে পালিয়ে যাবার পরে পুনরায় গ্রেফতার করা হয় এবং অমৃতসর সেনা হেডকোয়ার্টারে তাকে নির্যাতন করা হয়। তাকে প্রায় দেড় ঘন্টা পায়ে রশি বেঁধে মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়, তার বাম হাতের তর্জনী আঙুলের নখটি পুরোপুরি আর ডান হাতের তর্জনীর নখটির অর্ধেক উপড়ে ফেলা হয়, তার দু’পায়ের গোড়ালিতে সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ পাওয়া গেছে। তাছাড়া যুদ্ধবন্দীদের সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত ব্যারাকে অবস্থান করতে বাধ্য করা হচ্ছে, এ সময়ে তাদের বাথরুমে যেতে দেয়া হচ্ছে না। এলাহবাদ ক্যাম্পে কিছু পাত্র দেয়া হয়েছে প্রসাবের জন্য, কিন্তু সেগুলো অন্যদের সামনে তাদের ব্যবহার করতে হচ্ছে। ব্যারাকগুলোতে ধারণক্ষমতার থেকে মাত্রাতিরিক্ত যুদ্ধবন্দীদের রাখা হয়েছে এবং তাদের গাদাগাদি করে ঘুমোতে হচ্ছে। ক্যাম্পগুলোতে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। বৈদ্যুতিক ফ্যানগুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে, সব দরজা-জানালাও বন্ধ রাখা হয়েছে। আত্মরক্ষার কথা বলে ছয়জন যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করা হয়েছে, যদিও তার মধ্যে অন্তত দুই-তিনজনকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে। বন্দী পাকিস্তানী সৈন্যদের মুক্তির আহ্বান জানিয়ে ২৫ আগস্ট ১৯৭২ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বেলজিয়ামের প্রতিনিধি Edourad Longerstaey এর বক্তব্যের অংশবিশেষ ছাপা হয়েছে ডাটাকার্ডে। সেখানে প্রকাশিত আমেরিকার হাউজ অব রেপ্রেজেন্টিভের সদস্য Bob Skies এর বক্তব্যও মুদ্রিত হয়েছে যেখানে তিনি বলেছেন যে, “এসব যুদ্ধবন্দীদের মাঝে প্রায় কুড়ি হাজার সাধারণ মানুষ রয়েছে যাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাও অনেক। ভারত এসব দুর্ভাগ্যের শিকার ব্যক্তিদের প্রতি কোনো সমবেদনা দেখাচ্ছে না এবং এটা আশ্চর্য যে পৃথিবীর দেশগুলো এ বিষয়ে সচেতন নয়। এমনকি আমেরিকাও। ভারত মূলত এদের গত এক বছরেররও বেশি সময় ধরে বন্দী করে রাখছে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য। বন্দিশিবিরে অনেক শিশুরা জন্ম নিয়েছে।”প্যারিস থেকে প্রকাশিত লা মন্দে পত্রিকার ২১ মে ১৯৭২ এর সংখ্যা থেকে উদ্ধৃতি ছাপা হয়েছে, “আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানের যেসব ছবি প্রকাশিত হয়েছে তাতে তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর কোনো প্রতিনিধিকে দেখা যায় না। ভারত একাই পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের খরচ বহন করছে, যা ভারতে আশ্রিত বাঙালি শরণার্থীদের খরচের তিন ভাগের এক ভাগ।
অর্থনীতির উপর বোঝা কমাতে ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব পাকিস্তানে সেনা অভিযান চালান।” এছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম The Weekly Spcetator, Times of India, The London Times, The New York Times প্রভৃতি থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। লিথোগ্রাফে পাঁচ লক্ষ ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিল পাকিস্তান পোস্ট অফিস। ইস্যুকারী হিসেবে ডাটাকার্ডের শেষে ডিরেক্টর জেনারেল, পাকিস্তান পোস্ট অফিস, করাচি লেখা ছিল। ডাকটিকিট, উদ্বোধনী খাম ও ডাটাকার্ডটি আমি পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডি থেকে আনিয়েছি। এ ডাকটিকিটটি যে মাসে প্রকাশিত হয় সে মাসে অর্থাৎ এপ্রিল ১৯৭৩ যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির বিষয়ে কথা বলতে ভারতের বিশেষ দূত পি.এন হাকসার ঢাকায় আসেন, এরপর বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন-ও ভারত যান। এরপর বাংলাদেশ-ভারত যৌথভাবে ঘোষণা দেয় যে বন্দী সেনাদের ফেরত পাঠানো হবে। ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের গুরুতর অভিযোগ আছে তাদের বাদে বাকীদের ফেরত পাঠানো হবে, পাকিস্তানে আটকে থাকা বাংলাদেশীদের ফিরিয়ে দেয়া হবে এবং বাংলাদেশ থেকে উর্দুভাষী বিহারীদের পাকিস্তান নেবে–এসব বিষয়েও তিন দেশ সম্মত হয়। এরপর ভুট্টো তৎপরতা শুরু করে কিভাবে এই ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনাকর্মকর্তাদেরও মুক্তি নিশ্চিত করা যায়। তিনি ১৯৭৪ এর ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের লাহোর শহরে অনুষ্ঠিতব্যOrganisation of the Islamic Cooperation (OIC) এর সম্মেলন উপলক্ষে শেখ মুজিবকে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু শেখ মুজিব সাফ জানিয়ে দেন পাকিস্তান যদি বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলে তিনি যাবেন। কিন্তু ভুট্টো বলেন যে ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাকে মুক্তি দিলে তিনিও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন। সম্মেলন শুরুর কয়েকদিন আগে ওআইসির সেক্রেটারি জেনারেল সহ কুয়েত, সোমালিয়া, লেবানন ও সেনেগালের প্রতিনিধিরা শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠক করতে ঢাকায় আসেন। শেখ মুজিব রাজি হন বাকী ১৯৫ যুদ্ধবন্দীকেও ছেড়ে দিতে। অতঃপর ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের উপস্থিতিতে দিল্লীতে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু পাকিস্তান কথা রাখেনি, উর্দুভাষী বিহারীদের কোনদিনই তারা বাংলাদেশ থেকে ফেরত নেয়নি। এমনকি ১৯৭১ এর মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমাও চায়নি।