ডা. বিধানচন্দ্র রায়। ইনি শুধু পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রীই ছিলেন না, ছিলেন এক কথায় ধন্বন্তরি ডাক্তার। যিনি রোগীর ঘরের চৌকাঠে পা রেখেই বলে দিতে পারতেন কী রোগ হয়েছে।
জন্মেছিলেন ১৮৮২ সালের ১ জুলাই। পাটনায়। ১৯০১ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন।
১৯১১ সালে ইংল্যান্ড থেকে এমআরসিপি এবং এফআরসিএস উপাধি অর্জন করার পরে কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে, যার নাম এখন নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ, সেখানে শিক্ষকতা ও চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
সেই সময় ইংরেজ শাসন চলছে। বিধানচন্দ্র রায় জাতীয় কংগ্রেসের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং রাজনীতিতে যোগ দিয়েই বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করেন। সাক্ষাৎ হয় গান্ধীজির সঙ্গে।
রাজনীতিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে এ রকম বিপুল সাফল্য পাওয়ার পরেও শিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি কিন্তু বাংলার বাঘ, তথা স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফেলো’ হওয়ার সরাসরি প্রস্তাব দিয়েছিলেন তৎকালীন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু বিধানচন্দ্র সে পথে না হেঁটে সেনেট নির্বাচনে দাঁড়ান এবং মন্মথনাথ রায়চৌধুরী, চারুচন্দ্র বিশ্বাসের মতো ব্যক্তিদের হারিয়ে বিপুল ভোটে জয়ী হন।
এর পর থেকেই আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে বিধানের। একদিন গভর্নর লর্ড লিটন তৃতীয় বারের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে চিঠি দেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে। সঙ্গে ছিল বেশ কয়েকটি শর্ত। বিধানকে তিনি এতটাই ভরসা করতেন যে, সেই চিঠি দেখিয়ে তাঁর মতামত জানতে চান আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।
বিধানচন্দ্র বলেন, যে শর্তগুলো রাখা হয়েছে, সেগুলো অত্যন্ত অপমানজনক। এর পর লাটসাহেবের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে পাল্টা চিঠিতে আশুতোষের সেই বিখ্যাত জবাব— ফ্রিডম ফার্স্ট, ফ্রিডম সেকেন্ড অ্যান্ড ফ্রিডম অলয়েজ।
আশুতোষের সংস্পর্শে এসেই বিধানচন্দ্র আরও নির্ভীক ও আপোষহীন হয়ে উঠেছিলেন।
জানা যায়, আশুতোষই বিধান রায়কে পরামর্শ দিয়েছিলেন ১৯২২ সালে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য। নির্দল প্রার্থী হিসাবে বিধানচন্দ্রকে উত্তর কলকাতা মিউনিসিপ্যাল মানে বারাকপুর কেন্দ্রটি বেছে দেন তিনিই।
বিধান রায়ের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সে বার ওই কেন্দ্রের নির্বাচন ছিল বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
রাজনীতিতে নবাগত বিধানচন্দ্রকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কংগ্রেস স্বরাজ্য দলের হয়ে দাঁড়ানোর প্রস্তাব দেন চিত্তরঞ্জন দাশ। দেশবন্ধুর সেই প্রস্তাব বিধান রায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন একটাই কারণে। পাছে মানুষের কাছে ভুল বার্তা যায়। তবে, বিধানচন্দ্রের এই সিদ্ধান্তে রুষ্ট হলেও বাইরে থেকে সমর্থন করেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ।
সেই সময় এই কেন্দ্রের ফলাফল নিয়ে কৌতুহল ছিল গোটা দেশের। কারণ, লড়াইটা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল জাতীয় স্তরে। একদিকে স্বয়ং রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অন্য দিকে দেশবন্ধু-বাংলার বাঘ সমর্থিত বিধানচন্দ্র।
শেষমেশ বিপুল ভোটে জেতেন বিধানচন্দ্র রায়। প্রায় ৩ হাজারেরও বেশি ভোটে হারতে হয়েছিল সুরেন্দ্রনাথকে। বলা যায়, সে দিন থেকেই মূল রাজনীতির সরণি থেকে সরতে শুরু করেন রাষ্ট্রগুরু। আর সেই রাজনীতির রাজপথে অভিষেক ঘটে নবাগত বিধানচন্দ্রের।
বিধানচন্দ্রের জীবনে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় একটা বিরাট জায়গা জুড়ে থাকায় তাঁর ছেলে শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত স্নেহের ও বন্ধুত্বের।
১৯৪২ সালে ফজলুল হক সাহেবের মন্ত্রিসভায় শ্যামাপ্রসাদ যখন অর্থমন্ত্রী, একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। শ্যামাপ্রসাদ মৃতপ্রায় বলে বিভিন্ন খবরের কাগজে লেখালেখি হয়। তাঁর কর্মময় জীবনী শোকপ্রস্তাব হিসাবে ‘কম্পোজ’ও করে ফেলেছিল কলকাতার বেশ কিছু খবরের কাগজ।
যেটা মাদার টেরিজার ক্ষেত্রেও হয়েছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে, মাদার টেরিজা তখন মৃত্যুশয্যায়। যে কোনও সময় মারা যেতে পারেন আশঙ্কা করে প্রথম শ্রেণির প্রায় সমস্ত সংবাদপত্র, হ্যাঁ, সংবাদপত্রই, কারণ তখন দূরদর্শন ছাড়া আর কোনও ইলেকট্রনিক্স সংবাদ মাধ্যম ছিল না। তারা তাবড় তাবড় স্বনামধন্য স্বামীজি এবং বিখ্যাত সব লোকজনদের দিয়ে লিখিয়ে আর্টপুল রেডি করে রেখেছিল। প্রথম শ্রেণির একটি দৈনিক পত্রিকা তো একদম পাতা তৈরি করে রেখেছিল। কিন্তু দেখা যায়, সেই অসুস্থতা কাটিয়ে তিনি আবার আমাদের মধ্যে ফিরে এসেছেন।
সে যাই হোক, শ্যামাপ্রসাদ অসুস্থ খবর পাওয়া মাত্রই বিধানচন্দ্র রায় ছুটে গিয়েছিলেন বন্ধুর পাশে এবং একটানা তিন দিন সেখানে থেকে মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন শ্যামাপ্রসাদকে।
তবে, বন্ধুত্বের নজির এখানেই শেষ নয়। জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কিছু দিন আগে দিল্লিতে তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিল্প ও সরবরাহ মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে দেখা করতে যান বিধানচন্দ্র রায়।
তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ। যাঁকে নিয়ে দেয়ালে দেয়ালে তখন ছড়া লেখা হচ্ছিল— আয় প্রফুল্ল খেয়ে যা কানা বেগুনের ঝোল… কংগ্রেসের অন্দরে প্রবল অন্তর্কলহের জেরে তখন নড়বড় করছে প্রফুল্ল ঘোষের চেয়ার। সেই পদে তখন অন্যতম দাবিদার বিধানচন্দ্রই।
শ্যামাপ্রসাদ তাঁকে বললেন, তিনি এখনও বিধানসভার সদস্য। বিধানের জন্য তাঁর কেন্দ্রটি তিনি ছেড়ে দিতে রাজি আছেন। বিধানও রাজি হয়ে যান। তবে শর্ত একটাই— অসুস্থতা কাটিয়ে বঙ্গ রাজনীতিতে শ্যামাপ্রসাদ যদি আবার ফিরে আসেন তা হলে তিনি ওই পদ থেকে পদত্যাগ করবেন। এতটাই নিবিড় ছিল বিধান-শ্যামাপ্রসাদের বন্ধুত্ব।
১৯৩০ সালে বিধানচন্দ্র কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হন। তিরিশের দশকে তিনি দু’-দু’বার কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র হয়েছিলেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট সদস্য, রয়্যাল সোসাইটি অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন এবং আমেরিকান সোসাইটি অফ চেস্ট ফিজিশিয়ানের ফেলো নির্বাচিত হন।
১৯৩১ সালে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন। ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন এবং সেই সময়েই তিনি প্রথম সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা কোর্স চালুর উদ্যোগ নেন। ১৯৫১ সালে সেটি চালু হয়।
সে দিন সাংবাদিকতার ডিপ্লোমা কোর্সের উদ্বোধন করে বিধানচন্দ্র রায় বলেছিলেন, সাংবাদিকদের চিন্তার স্বাধীনতা অবশ্যই থাকতে হবে। সেখানে যেন রাজনৈতিক বিবেচনা ও মতাদর্শ বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। ঘটনা লেখার সময় কোনও সাংবাদিক যদি রাজনৈতিক বিবেচনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন অথবা গড্ডালিকা স্রোতে ভেসে যান কিংবা কাগজের বিক্রি বাড়ানোর জন্য লেখেন, তা হলে সেই সাংবাদিকের স্বাধীনতা সেখানেই শেষ হয়ে যায়।
১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে আইনসভায় নির্বাচিত হন বিধানচন্দ্র।
১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট স্বাধীনতার দিনই পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ। কিন্তু কিছু দিন পরেই নানান সমস্যার জন্য তাঁকে সরে যেতে হয়। তখন মহাত্মা গান্ধীর কথায় বিধানচন্দ্র নিজের কাঁধে তুলে নেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব।
সেই দিনটা ছিল ১৯৪৮ সালের ২৩ শে জানুয়ারি, মানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন। আমৃত্যু তিনি ওই পদেই ছিলেন।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে সাংবাদিকদের জন্য মহাকরণে তাঁরই ঘরের কাছে ও তাঁর যাতায়াতের পথে প্রেস কর্নার তৈরি করে দেন ডা. বিধানচন্দ্র রায়। তাঁরই উদ্যোগে ভারতের মধ্যে একমাত্র কলকাতাতেই রাজ্য সচিবালয়ে প্রথম প্রেস কর্নার চালু হয়েছিল।
পাঁচটি নতুন শহরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। সেগুলো হল— দূর্গাপুর, বিধাননগর, কল্যাণী, অশোকনগর-কল্যাণগড় ও হাবড়া।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর দেশভাগের যন্ত্রণা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কমিউনিস্ট পার্টির বিদ্রোহ ভাবিয়ে তুলেছিল বিধান রায়কে। তার মধ্যেও বাংলায় শিল্পবিস্তার নিয়ে তাঁর মনোবল এতটুকুও চিড় খায়নি। আর তাঁকে সে সময় প্রভূত সাহায্য করেছিলেন বন্ধু তথা কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। চিত্তরঞ্জনে রেলইঞ্জিন কারখানা থেকে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন, দেশের প্রথম কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় খড়গপুর আইআইটি-সহ একাধিক ক্ষেত্রে শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।
ডা. বিধানচন্দ্র রায় বাংলার উন্নয়নে যে কাজ করেছিলেন তার স্বাক্ষর আজও আছে। তিনি কিন্তু উন্নয়নের জন্য বিদেশি পুঁজি আনার জন্য কখনওই ছটফট করতেন না। কেন্দ্রীয় সরকারকে চাপ দিয়ে চিত্তরঞ্জন, আসানসোল এবং দুর্গাপুরে অনেক কারখানা বসিয়েছিলেন। আবার দেশীয় শিল্পপতিদের ধরে তারাতলা-হাইড রোড, শ্রীরামপুর, হুগলি, হাওড়া, ব্যারাকপুর এলাকাতেও অনেক কারখানা তৈরি করিয়েছিলেন।
১৯৫০-৫১ সালে রাজ্য সরকারের বাজেট ছিল মাত্র ৩৮ কোটি টাকা। সেই টাকার মধ্য থেকেই কিছু টাকা বাঁচিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন হরিণঘাটায় সেন্ট্রাল ডেয়ারি, কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগম।
তাঁর মাথায় একটাই চিন্তা ছিল, ছেলেমেয়েদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। হরিণঘাটার দুগ্ধ বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে তিনি শুধুমাত্র মহিলাদেরই নিয়োগের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বাংলাকে সাজিয়ে তোলার জন্য তাঁর এই কর্মকাণ্ড দেখে তাঁকে ‘বাংলার রূপকার’ আখ্যা দেওয়া হয়।
অত্যন্ত সফল মুখ্যমন্ত্রী হলেও তিনি কিন্তু চিকিৎসক হিসেবেও বিপুল খ্যাতিমান ছিলেন। মুখ দেখেই রোগ নির্ণয় করার এমন এক ‘অলৌকিক বিদ্যা’ রপ্ত করেছিলেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় যে, হতদরিদ্র থেকে রাজা-উজির— সবার কাছেই তিনি ছিলেন ধন্বন্তরি চিকিৎসক।
লোকেরা বিশ্বাস করতেন, মৃত্যুপথযাত্রীকেও তিনি যমের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন। তাই তাঁকে নিয়ে তাঁর জীবিত কালেই প্রবাদ তৈরি হয়ে গিয়েছিল— নিদান কালে বিধান রায়।
১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই বর্তমানে বিহার রাজ্যের অন্তর্গত পাটনার বাঁকিপুরে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের জন্ম। তিনি ছিলেন পিতা প্রকাশচন্দ্র রায় ও মা অঘোরকামিনী দেবীর ছয় সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। প্রকাশচন্দ্রের আদি নিবাস ছিল বর্তমান বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে। (সুত্র: উইকিপিডিয়া)
ধন্যবাদ সিদ্ধার্থ সিংহ দা আপনাকে, বিধান রায় সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম আপনার লেখার মাধ্যমে , গর্ববোধ করছি তিনি আমাদের একজন পূর্ব বাংলা সন্তান ছিলেন।