রাম কুমার ঠাকুর বসবাস করতেন নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার মাধনগর গ্রামে। জগন্নাথ দর্শনে পুরীতে যাবেন বলে মনস্থির করেছিলেন। পরবর্তীতে দিনক্ষণ দেখে রওনা দেন তিনি। পথিমধ্যে বিশ্রামের জন্য এক অশোক গাছের নিচে শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি।
হঠাৎ স্বপ্ন দেখেন তিনি, কেউ একজন বলছেন পুরীতে কষ্ট করে যেয়ে কি হবে? আমাকে নিয়ে চল। রাম কুমার উত্তর দেন কিভাবে নিয়ে যাব। জবাব আসে আমাকে তুলে দেখ আমি একেবারে হালকা। ঘুম ভেঙ্গে যায় রাম কুমার ঠাকুরের।
স্বপ্নে নির্দেশ পাওয়া জায়গায় খুঁজতে গিয়ে তিনি সরিষা ক্ষেতে দেখা পান মদনমোহন বিগ্রহের। অবশেষে মদনমোহন বিগ্রহটি নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। প্রতিষ্ঠা করেন সেই বিগ্রহ। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে এই কাহিনী। এই কাহিনী পৌঁছে যায় পাবনার দিলালপুরের জমিদার যামিনী সুন্দরী বসাকের কানে।
যামিনী সুন্দরীর পরগনা ছিল মাধনগর। এদিকে যামিনী সুন্দরী তাঁর দুই মেয়ে শৈল বালা দাসী ও কালী দাসীকে বিয়ে দেন নাটোরের পূর্ণ চন্দ্র বসাক ও মাখন লাল বসাকের সঙ্গে। মাধনগরের মদনমোহন বিগ্রহের কথা শুনে যামিনী সুন্দরী মদনমোহন বিগ্রহ পাবনা নিয়ে যেয়ে প্রতিষ্ঠা করতেন চেয়েছিলেন।
এক পর্যায়ে নাটোরের হালতি বিল পর্যন্ত যাবার পর আর নিয়ে যেতে পারেননি বলে জানা যায়। মদনমোহনের মাহাত্ম দেখে যামিনী সুন্দরী মাধনগরে ১৭’শ শতকে মদনমোহন বিগ্রহের মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেন।
মন্দির পরিচালনার দায়িত্ব নেন তিনি। এখানকার যাবতীয় খরচ পাবনার দিলালপুরের জমিদারী স্টেট থেকে আসতো। পরবর্তীতে যামিনী সুন্দরীর মেয়েরা পান তার পরগনার দায়িত্ব। এরপর ১৮৬৭ সালে যামিনী সুন্দরী নির্মাণ করেন পিতলের রথ।
মাধনগরের এই বিশেষ পিতলের রথের বেশ কিছু বৈশিষ্ট রয়েছে। রথটির উচ্চতা প্রায় বিশ ফুট । রথটি বারো ফিট স্কয়ার। বারোটি চাকা। চাকার ভেতরে রয়েছে বারোটি পাত যেগুলো পিতলের। রথটিতে রয়েছে বারোটি কোণ বা কর্ণার এবং একশত বারোটি পিলার।
মাধনগরের এই রথটি উপমহাদেশের বৃহৎ ও প্রাচীনতম। ১৮৬৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত যামিনী সুন্দরী বসাক এই ব্যায় ভার বহন করেছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে চুরির কবলে পড়ে রথটি।
রথের নকশা, বিভিন্ন অংশ এবং রথের সারথি যেগুলো পিতলের তৈরী ছিল সব চুরি হয়ে যায়। এরপর ২০১২ সালে নতুন করে সংস্কার করা হয় রথটি। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের তিথি অনুসারে রথযাত্রা উপলক্ষে এখানে মাস ব্যাপী রথের মেলা ও পুজা অর্চনা হত।
বীরকুৎসা ও গোয়ালকান্দির জমিদারের হাতি এসে রথ যাত্রায় অংশ নিত এবং রথ টানার কাজ করতো। এছাড়া অনুষ্ঠান হত দোল পূর্নিমাতে। যা এখনও চলে আসছে।রথের নামে বর্তমানে ১৫ বিঘা জমি আছে। যে জমির অনেকাংশই স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করেছে। বেশকিছু অংশ দলিল তৈরি করে বিক্রিও করা হয়েছে।
রথটি রক্ষণাবেক্ষন, পূজা অর্চনা করছেন পিন্টু অধিকারী। তিনি রাম ঠাকুরের বংশধর। দেড়’শ বছরের পুরনো এই রথটি নাটোরের একটি বিশেষ ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম। এখন আর আগের মত জাকজমক না থাকলেও চলে নিয়মিত পূজা অর্চনা।