ঢাউস পেট নিয়ে একটা মাদি কুকুর ওখানে ঘাঁটি গেড়েছিল। পাঁচ–ছ দিন আগে দেখেছিলাম। বাড়ির দরজা খোলা পেয়ে কখন যেন ঢুকে পড়েছে। আমি দেখেও কাউকে বলিনি।
এ জায়গাটা কেউ দেখতে পায় না। বাড়ির পেছন দিক তো! আগাছা আবর্জনায় ভর্তি একটা বাগান। কোণের দিকে একটা পেট মোটা ধানের গোলা। কুমড়ো পটাসের মত দেখতে। মাথায় মরচে পরা টিনের ছাদ। ইটের দুই ছোট প্রাচীরের উপর বাঁদিকে একটু কাত হয়ে দাঁড়িয়ে। দুই প্রাচীরের মাঝে হাঁটু মুড়ে লুকিয়ে থাকবার মত অনেকটা জায়গা।
ওখানেই ধুলো মাখা নাদুস নুদুস কুকুর ছানাটা আজ চোখে পড়ল। ভেলভেটের মত নরম তুলতুলে গায়ে ধুলোটে রোঁয়া। গোলার নীচে বাতাবি লেবুর মত শরীরটাকে একা একা ডিগবাজি খাওয়াচ্ছিল। ওকে একলা ফেলে মায়ের পিছু পিছু বাকি ছানা গুলো হয়ত কোথাও চলে গেছে।
দাদাও অনেক সময় আমাকে একলা ফেলে টাউন ক্লাবের বড় মাঠে খেলতে চলে যায়। আমিও একা একা ডিগবাজি খাই। আজ কুকুর ছানাটার সাথে আমারও ইচ্ছে করছিল ওরকম খেলতে। কিন্তু বাগানে অনেক কাঁটা গাছ। সরলা মাসি বাগানে ছাই ফেলতে এসে বলেছিল, ‘ওগুলান খুরিয়ার শাক। কাঁটা হব ক্যান’। যাই বলুক, বড় বড় কাঁটা গাছের উপর গড়াগড়ি খেলে জামায় এক ডজন খোঁচা ফুটবে। তখন দিদির চটাস চটাস চড় পরবে আমার গালে।
আমি ডিগবাজি গড়াগড়ি বাদ দিয়ে দু-হাত দিয়ে কুকুর ছানাটাকে আমার মুখের কাছে তুলে চুক চুক শব্দ করলাম। কোথায় খুশিতে লেজ নাড়বে, না আমার জামায় ছিরিক করে একটু হিসি করল। মুখে কুঁ কুঁ আওয়াজ। হঠাৎ বাগানের দরজায় ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ। তারপর ধুপ ধাপ পা ফেলার আওয়াজ। চমকে পেছন ফিরতেই দেখি ঝড়ের গতিতে রাগে আগুন দিদি এগিয়ে আসছে। লাল চোখ, গলায় গর্জন, ‘ফেলে দে, ফেলে দে ওটাকে। ঘেন্না পিত্তির বালাই নেই। তোর জামাটা ভেজা কেন রে, কুত্তার হিসু? মাগো কি নোংরা’!
তখনকার মত ছানাটাকে গোলা ঘরের নিচে রেখে ঠোঁট ফুলিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকলাম। ঘাড়ে চটাস করে দিদির সরু আঙ্গুলের চড় আর কানের কাছে বকুনি। ‘বাইরে ফোস্কা-পড়া তাত, সারা দুপুর বাবুর চোখে এক ফোঁটা ঘুম নেই! নে, গামছা দিচ্ছি, বাথরুমে ঢোক, চৌবাচ্চায় জল আছে। স্নান করে বেরবি কিন্তু। জামা প্যান্ট ছেড়ে আসবি, আমি কেচে দেবো’।
‘খুকু, এই অবেলায় কান্তকে চান করতে পাঠাচ্ছিস কেন? দিদির আওয়াজে মায়ের ঘুম-চটা বিরক্তি। উঁচু গলায় দিদি বলল, ‘দরকার আছে’। ব্যাস, মা-র মুখে আর কথা নেই। বোধহয় ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরলেন মা।
শীত হোক কি গরম, দুপুরে মা ঘুমাবেই। আর আমিও সুযোগ বুঝে ঘরের বাইরে। দাদার উঁচু ক্লাস, দুপুরে স্কুল। বাবা কেস টেস করে কোর্ট থেকে বাড়ি ফিরতে বিকেল গড়িয়ে যায়। দাদু-ঠাকুমা না-ঘুমিয়ে গ্রামাফোন রেকর্ড কিম্বা ট্রানজিস্টারে সারা দুপুর গান শোনেন। বলেন, ‘দিবানিদ্রা অনাচার’।
দিদি ভেজা গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে মায়ের ঘরের পাশে কলেজের পড়া মুখস্ত করে। আবার ঘুমের কারসাজিতে চোখ বুজে এলেই পড়া বন্ধ। আমার সকালে প্রাইমারি স্কুল, দুপুরে মা-র পাশে ঘুমাতে হয়। কড়া শাসন। অন্য দিনের মত আমি চোখ বন্ধ করে মায়ের দিকে মুখ করে শুয়েছিলাম।
মা শুয়ে, ছাতের দিকে ভাঁজ করা দুই হাঁটু। হাতে গল্পের বই। মাথার দু-পাশে ধব ধবে বালিশে গোছা গোছা কালো চুলের ঢেউ। পানের রসে লাল ঠোঁট। দুর্গা প্রতিমার মত মুখে হাল্কা হাসি। হঠাৎ হাতে ধরা বইটা পাকা ফলের মত টুপ করে খসে পড়ল। মা বাঁ-পাশে কাত হলেন। হাঁটু দুটো এবার জানালার খশখশের দিকে। স্থির শরীর। শুধু বুকের ওঠা নামা আর নাকের ফোঁস ফোঁস। বুঝলাম ঠাকুমা যেমন বলেন, ঠিক দুপুরবেলা ঘুম পাড়ানি সব মাসি-পিসি বাতাসে ভর করে চুপটি করে নেমে আসে। ওরা আধো অন্ধকার নিঝুম ঘরে ঘুমের কাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছে মায়ের ডাগর চোখের পাতায়।
আমার চোখে ঘুম নেই, নামবে সেই সন্ধ্যেবেলা, পড়তে বসলে। এ সময় ঘর ছায়াচ্ছন্ন, বাড়ি নিঝুম। আমি সাবধানে উঠে বসলাম। মায়ের বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে পা টিপে টিপে ঘরের বাইরে। কুয়োতলা পেড়িয়ে বাড়ির পিছনে হযবরল বাগান। বাঁ-দিকের কোণে ভেরান্ডা গাছ। তার পাশে বিছুটি। সরলা মাসি গাছটা চিনিয়ে সাবধান করে দিয়েছিল, ‘হাত দিবা না। চামড়া ছাবরা ছাবরা ফুইলা যাবে কিন্তু। দিনমান খালি জ্বলন’।
আকন্দ ফুলের গাছটাও সরলা মাসির চিনিয়ে দেওয়া। একদিন প্রাচিরে একটা লতানো গাছ দেখিয়ে বলেছিল, ‘এটা চিনে লও, ভুঁই চাপা। ফুলের রং হইব নীল, গয়না পরা গড়ন’। বাগানের মাঝখানে একটা বেলগাছ, মাঝে মাঝে ধুপধাপ করে পাকা বেল খসে পড়ে। একটু দূরে গায়ে কাঁটাওয়ালা ঢ্যাঙা একটা শিমূল গাছ। পশ্চিম কোণে প্রাচীর ঘেঁষা পেটমোটা খয়েরি রঙের গোলা। প্রাচীরের ওপারে সুবল কাকার একতলা বাগান বাড়িতে ওনার মা একলা থাকেন।
আমাদের বাগানে এক সময় গোয়ালও ছিল। গোরুকে খাবার দেবার ঢাউস একটা নাদ শক্ত পোক্ত গৌড়িয়া ইটের কাঠামোর উপর এখনও টান টান দাঁড়িয়ে আছে। ঠাকুরদা নাকি গরু পুষতেন। এখন কেন গোয়াল ফাঁকা, একটাও গরু নেই? পড়া থামিয়ে দাদুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম একদিন। চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে উত্তর দিলেন ঠাকুমা, ‘আমি আর জীবজন্তু পুষতে দি’নি। একটা গরুকে সাপে কাটল। সকালে উঠে দেখি মুঙ্গেরি গাইটার পেট ঢোল। পা ছড়িয়ে মরে পড়ে আছে। দু-চোখের কোণে শুকনো কান্না। গরুর ডাক্তার রতন কোলে টেপাটিপি করে দশ টাকা পকেটে ঢুকিয়ে বলল, কাল কেউটের জব্বর কামড়। পাড়ার আরেকটা গরুকেও বাঁটে ছোবল মেরেছে’।
এরপর দাদু-ঠাকুমার যুগলবন্দি, ‘আমাদের আরেকটা দুধেল গাই ছিল, নাম লক্ষ্মী। সাহাপুরের একনম্বর দালাল আনিসুর মারফৎ কেনা, বুঝলি। দুধ দিত দিনে দশ সের। দু-নম্বর কলোনির মাঠে লকলকে ঘাস খেতে গিয়ে মারণ পেরেক গপাত করে গিলে ফেলল একদিন। অবলা জীব! পশু হাসপাতালে ভর্তি করলাম’।
একটু থেমে ধরা গলায় ঠাকুমা বললেন, ‘সবাইকে কাঁদিয়ে লক্ষী মরে গেল। তোর বাবার তখন দশ-এগার ক্লাস। লক্ষীর গলা জড়িয়ে তোর বাবার সে কী কান্না’! ঠাকুমা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘এ বাড়িতে সেই থেকে পশু-পাখি পোষা নিষেধ’।
দাদুর দোতলার ঘরে পশ্চিম দিকের জানালাটাও খোলা নিষেধ। খালি গোয়াল দেখলে এখনো ঠাকুমার বুকটা নাকি আনচান করে। দাদাকে ঠাকুমা আলাদিনের গল্প বলতে বলতে আরেকটা কথাও বলেছিলেন, গভীর রাতে বেল বাগানে নাকি মামদো ভূত, শাঁকচুন্নি দাপা দাপি করে। মাঝে মাঝে নাকি সুরেলা গলায় খেতে চায় আবার হাম্বা হাম্বা ডাক ছাড়ে। সেদিন কথাটা শুনে ভেবেছিলাম, রাতের বেলা যা-খুশি হ’ক, দিনের বেলা দাপাদাপি করলে তো ভয় নেই। সরলা মাসিকে গাছের মগ ডালে উঠে চুপি চুপি হলুদ রং ধরা বেল পেড়ে দিই। বেল ব্যাগে পুড়ে নিচে দড়ি নামিয়ে দিই। সাবধানে সব কাজ সাড়তে হয়। রাম বিহারি ঠাকুর জানলে আবার মা’র কানে লাগাবে। মা’র মুখ থেকে দিদির কানে গেলেই সর্বনাশ! তখন নাগাড়ে থাপ্পড় পড়বে আমার গালে মাথায়।
বাড়িতে ভয়ে ভয়েই থাকতে হয়। সরলা মাসি দুপুর বেলা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘ভয় খায়ো না বাপধন। রাম বিহারি জাগবো না। বজ্জাতটা রাতে আফিং খায় বুঝছ। মোদকানন্দের গুলি, ভাং। কত রকম নেশা! রাতে নেশা কইরা দিনমান খালি বেহুদ্দার মত ঘুম মারে। অহন কড়্ কড়্ বাজ ডাকুক, বিহারি উঠব না’। তারপর আমার কানের কাছে মুখ এনে বলে, ‘বিহারিটা রাতে বাড়ির উঁচু পাঁচিল টপকায় জানিস! নেশার টান। সরাফা বাজারের কোনায় ওদের ঠেক। আমার বর তো খাদির দোকানটায় হেড পাহারাদার, সব জানে। তোর বাবা পাঁচিল ডিঙানোর খবরটা যদি শুনছে, বিহারিটারে একদম কচু কাটা করব’। আমার গলা একদম খাদে, ‘নেশা করে বলে কেটে ফেলবে? বাবাও তো নেশা করে। চা পান সিগারেট দোক্তা জর্দা। মা তামাকের নেশা ছাড়তে বললে বাবা প্রতিবাদ করে। বলে, নেশা ছাড়লে বুদ্ধি খুলবে’?
‘ও সব হল হালকা নেশা। আসল কথা হল, বিহারিটা পাঁচিল টোপকে চোরকে পথ দেখাতেছে কিনা? গেল বচ্ছর সিন্দুক ভেঙে চুরি হোল। তাইতো পাঁচিলটা উঁচা করি দিল তোমার বাবা’!
সব শুনে আমি ভাবলাম রাম ঠাকুরের প্রাচীর টপকানোর কথাটা বাবাকে জানানো উচিৎ। কিন্তু ভয়ে আর বলতে পারিনি। যদি বাবা উকিলের গম্ভীর গলায় জেরা করেন, ‘অভিযোগ করছো, এভিডেন্স কোথায়’? দাদাকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘এভিডেন্স মানে কি’?
-কোথায় শুনলি তুই?
-বাবা এক মক্কেলকে বলছেন, হোয়ার ইস দ্য এভিডেন্স?
-তুই বাবার ঘরের দরজায় কান পাতিস নাকি?
-মাঝে মাঝে। অনেক কিছু জানা যায় কিন্তু। কাউকে বলিস না দাদা।
দাদা পড়াশুনায় তুখোড়। একটু হেসে অঙ্ক স্যার বিধু বাবুর মত বলল, ‘এভিডেন্স মানে প্রমাণ। বাবার সাথে প্রমাণ ছাড়া কথা বলবি না, রেগে যাবে কিন্তু’।
বাবা রাগী মানুষ কিন্তু আমাকে আদর করে বেড়াতে নিয়ে গেল। জায়গাটার নাম নিমতিতা। ট্রেনে বসেছি বাবার পাশে। গদি আটা সেকেন্ড ক্লাস। কু-ঝিকঝিক আওয়াজ শুনছি আর মনটা তা-ধিন তা-ধিন চিতপটাং নাচছে। বাবা বোধহয় বুঝতে পেরে ঠোঁটের দুপাশে একটু হাসি ছড়ালেন, ‘কি ভালো লাগছে তো? জানলার বাইরে মুখ বের করো না কিন্তু। চোখে কয়লার গুঁড়ো পড়বে’। আমি ঘাড় নেড়ে বাবার আরেকটু কাছে ঘেঁসে বললাম, ‘নিম মানেই তো তিতা। জায়গাটার নাম নিম হলেই হতো’। বাবা হো হো করে হাসলেন। অট্টহাসি। তারপর বললেন, ‘তোমার কথায় যুক্তি আছে’।
চার-পাঁচ দিন পর মাথায় ঠাঁসা গল্প আর বহু কথা নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। তার উপর দুপুরে আস্ত একটা কুকুর ছানা পেয়েছি বাগানে। ভিতরে খুশির ঢেউ, পেটে ভুর ভুর করছে কথা। কখন বোলবো সবাইকে, ভাবছি। ভিতর বারান্দায় পিড়ি পেতে রাতের খাওয়া দাওয়া চলছে। দাদু হাঁটু মুড়ে বসতে পারেন না। তাঁর জন্য চেয়ার-টেবিলে।
রামঠাকুর মুড়ি ঘণ্ট রাঁধতে শিখে গেছে। বাবা তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাচ্ছেন। আমি গোপালভোগ আমের পিছনে একটা বড় কামড় বসিয়েছি। চাঁপা-আঙুলে ভাতে আলু-পোস্ত মাখতে মাখতে দিদি বলল, ‘কান্ত, বাবা নিমতিতা কেন গেছিলেন’? আমি আঙুল থেকে কনুইয়ে গড়িয়ে পড়া আমের রস চাটতে চাটতে বললাম, ‘নিসপেকসন করতে’।
‘মানে’? সবাই হাসতে লাগলো। দাদা ঠাকুমা মা। দিদি তো গড়িয়েই পড়ল। দাদু এক ঢোক জল গলায় ঢেলে বললেন, ‘ছোটদের বুলি করতে নেই। পিছনে লাগলে ওরা বিগরে যায়’। দাদা দাঁত দেখানো হাসি থামিয়ে বলল, ‘ইন্সপেকশন, মানে পরিদর্শন বুঝলি! নিসপেকশন বললে হাসবে না’? আমি বিগরে গিয়ে আমের আঁঠি হাতে গলা তুললাম, ‘সরলা মাসিকে মা যে সলা বলে’? দাদা মহাজ্ঞানী। বলল ‘ওটা প্রপার নাউন। যা খুশি বলা যায়’। আমার মাথায় কিছু ঢুকলো না। শুধু বাগানটা ঘুর ঘুর করছে মাথায়। কুকুরটাকে জল আর খাবার দিয়ে আসতে হবে তো! বাবা ভাত খেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছেন। ঘর-ভর্তি মক্কেল বাইরের ঘরে।
আমিও তাড়াতাড়ি উঠে টর্চ হাতে সরলা মাসির সাথে বাগানে ভলটুকে খাবার দিতে যাবো, ভাবছি। হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে দিদি বলল, ‘তো আজ বাগানে কি কি নিসপেকশন করলি’?
মনে মনে বললাম, অনেক কিছু। একটা ভাঙা পাইপের মাথায় কালো ছোপওয়ালা হলুদ বোলতা চাক বেঁধেছে। আকন্দ গাছে ঠোঁট চেপে ফুটে আছে সাদা ফুল। গোয়াল ঘরের পাশে উইয়ের ঢিবিটা চার আঙুল লম্বা হয়েছে। ভ্যারেণ্ডা গাছের ডালে ডেয়ো পিঁপড়ের সারি। কালো বড় বড় চোখ, কামড়ালে মাংস খুবলে নেয়। কাঠ পিঁপড়ে লেগেছে আমড়া গাছে। গোলার কাছে মাটিতে লাল পিঁপড়ে থিক থিক করছে। সরলা মাসি দেখলেই বলে, ‘সাবধান, নালসোর খুব বিষ, কামড়ালে শুধু জ্বলুনি, তিড়িং বিরিং লাফাইবা খালি’। তাই দেখে দেখে পা ফেলেছি। সাবধানে চলতে গিয়ে ফনি মনসার ঝোপের কাছে মেঠো টিকটিকি দেখেছি। দেখলে গা গুলায়। আর কেয়া গাছের ঝোপে তিনটে গিরগিটি। দাদা তো গিরগিটি দেখলে ভিরমি খায়। বলে ওরা বহুরূপী রক্ত চোষা, ওদের দিকে তাকাবিনা। আমি তো চোখ খুলেই দেখি। দূর থেকে কেমন করে রক্ত চুষবে? সরলা মাসি বলে, ‘আমিও শুনছি কিন্তু রক্তচোষা বইলে তো পতিতি হয়না’।
-কি এত ভাবছিস রে’? এবার দিদির সরাসরি প্রশ্ন, ‘কুকুর বচ্চার খবর কি’?
-কুকুর বাচ্চা বলবি না। ওর নাম ভলটু। আমি পুষবো।
ঠাকুমা দু’হাতে দুধের বাটি তুলে চুমুক দিচ্ছিলেন। একটু বিষম খেয়ে বললেন, ‘পল্টু তো আমার মামাতো বোন রূপার বড় নাতি’।
-পল্টু নয়, ভলটু। পুঁচকে কুকুর। ওটাকে নাকি পুষবে তোমার ছোট নাতি’। দিদির সি শার্পে সাধা গলা ঠাকুমার ভোঁতা কানে চোখা তিরের মত সেঁধিয়ে গেল।
খাওয়ার পর খচমচ করে থেতো পান চিবাচ্ছিলেন ঠাকুমা। খনখনে গলা, ‘জীব-জন্তু পোষা মোটেই সহজ নয়। ওরা বড় মায়ার জিনিষ, বুয়েচো। ওদের অযত্ন হলে অভিশাপ লাগে’।
দাদুর নরম গলা, ‘কুকুর-টুকুর মাথা থেকে তাড়িয়ে পড়ায় মন দাও। দুপুর বেলা একটু আমার কাছে অঙ্ক নিয়ে বসলে তো পার’। সম্মতিতে ঘাড় নাড়তেই আমার চুলে দিদির হ্যাঁচকা টান, বড় বাধ্য ছেলে রে!
মা অবশ্য দাদু-ঠাকুমার সামনে বেশি কথা বলেন না। মা-র বড় বড় চোখের ভাষায় আমি সম্মতির ঝিলিক দেখলাম। রাত্তিরে মা বাবাকে বলছিলেন, ‘এত বড় বাড়ি। এক কোনে এঠো কাঁটা খেয়ে একটা কুকুর থাকবে তো অসুবিধা কি’ ?
পর পর ক’দিন সরলা মাসি একটা দুধের বোতল থেকে ভলটুকে যত্ন করে দুধ খাওয়ালো। হাতে একটা সাবান দেখিয়ে বলল, ‘এটা ডগ সোপ। খুকু দিয়েছে বুঝলি। তোর দিদির মুখ খানায় যত রাজ্যের ঝাল আর ভিতরটা? মাখন বুঝছস, বুকে ভালবাসা টসটসায়। টিফিন খাবার টাকা জমায়ে কুকুরের সাবান কিনসে খুকু’।
কথা থামিয়ে মুখে চুক চুক আদর করতে করতে কুয়োর ঠাণ্ডা জলে সাবান মাখিয়ে ভল,টুকে স্নান করলো সরলা মাসি। গরমে স্নানের আরাম আর সুরসুরি খেয়ে ভউ ভউ শব্দে সারা বাড়িতে খুশির বার্তা ছড়াল ভলটু। সরলা মাসি ওর মাথায় আঙুল বুলিয়ে বলল, ‘কী গলা দেখেছস, কী ত্যাজ’?
ক’দিন পর আমি একটা মায়ের ছেঁড়া শাড়ির নীল পাড় ভলটুর গলায় পেঁচিয়ে বিকেলে পাড়ার মাঠে খেলতে নিয়ে গেলাম। পাড়ার অনেক হাড্ডিসার রোঁয়া ওঠা নেড়ি কুত্তা ওর পেছনে ঘেউ ঘেউ করছিল। ভলটুর ডাঁটিয়াল গটমট চলনের দিকে তাকিয়ে দাদা বলল, ‘তোর পাপ্পিটাকে একদম বুলডগের মত লাগছে। চল, আজ ওকে হাই জাম্প শেখাবো’। দাদা ভলটুর সাথে ইংরাজিতেই কথা বলে, ‘কাম অন পাপ্পি, রা্ন, জাম্প’। ভলটু দেখি সব বুঝতে পারে।
এর পর অনেক ঘটনা। খিচুরি আর মাংসের ছাঁট খেয়ে ভলটুর একেবারে চিতার মত দাপট। আমি হাই স্কুলে ভর্তি হলাম। ফুল হাতা সাদা জামার উপর মায়ের হাতে বোনা আপ্লিকের ফুল গাঁথা হাফ সোয়েটার চাপিয়ে স্কুলে যাই। স্কুল ফেরত ভলটুকে দেখতে বাগানে ঢুকি। বাগানে শীতের নাচন। শিমূল গাছের ডালে ডালে মোরগ ঝুঁটি। বড় লাল লাল ফুল ঝুলছে। গাছের নীচে আমাকে দেখে ভলটু আনন্দে লাফ দেয়, চিৎকার করে। ক’দিনের মধ্যে হঠাৎ পশ্চিমা বাতাসে শীতের কনকনানি বেড়ে গেল। ভলটু বাগানের খোলা হাওয়া ছেড়ে কুয়োতলার পাশে চুন সিমেন্ট রাখার ছোট ঘরে একটা কাঠের বাক্সে থাকবার অনুমতি পেল।
আমার মনটা ভালো হয়ে গেল। খুশী মনে দাদুর ঘরে ইংরাজি পড়তে গেলাম। বানান জিজ্ঞেস না করে উনি বললেন, ‘তোর কুকুরটার কি ব্যাধি হয়েছে? রাত্তিরে এত ভোউ ভোউ করে কেন রে’? মুখ নিচু হয়ে গেল আমার। সত্যি কথা, ভলটু গলা ফাটিয়ে চেঁচায়। বাড়িতে সবার ঘুম নাকি দফা-রফা করে দিচ্ছে। মা বলেন ‘ভালো করছে, আরও চেঁচাক। চোর ডাকাত ভয়ে আর ঢুকবে না বাড়িতে’। বাবা একদিন ওর প্রবল চিৎকারে মাঝ রাত্তিরে ব্যাজার মুখে ঘুম ভেঙে উঠে পড়লেন। তারপর দিদি আমাকে ডেকে বলল, ‘দেখিতো, তোর ভলটু এত চেঁচায় কেন’?
কুয়ো তলার দরজা খুলতেই দিদি ভয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। বাবার গলায় গর্জন, ‘কে কে’? সরলা মাসি হাততালি দিল, ‘ঠিক হইসে, ঠিক হইসে’। এবার আমি সবার পেছেন থেকে সামনে এগিয়ে এসে চাঁদের আবছা আলোয় দেখি, রাম ঠাকুরের ধূতি কামড়ে ওর পেটে থাবার মত দু-পা তুলে গর্জাচ্ছে ভলটু। আমি ভলটুকে দু-হাতে সরিয়ে আনবার পরও ভয়ে কাঁপছে রাম ঠাকুর। কথা সরে না মুখে, বোবা লেগেছে। বাবা বললেন, ‘প্রাচীর টপকে কোথা থেকে এলে তুমি? চোরকে পথ দেখাচ্ছো? ভবিষ্যতে আর একবার দেখলে তোমাকে জেল খাটিয়ে ছাড়বো’।
রাম ঠাকুরের ঠক ঠকানি থামছে না। ওকে এত ভয় পেতে কেও দেখেনি। পরদিন সরলা মাসি খাটো গলায় বলল, ‘আমার খুব ভয় লাগতেসে। রাম বিহারি হইল এক নম্বর অসভ্য, বদরাগী। তার উপর লোকটার নেশা বন্ধ। রাগের চোটে ভলটুরে বিষ টিস দিয়া মারব নাতো? পাঁচ দিন আমি থাকবো না। বরের মানত আসে, পুরী যাইব। তুমি ভলটুরে চোখে চোখে রাখবা’।
আমি মাথা ঝুঁকিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা’। তারপর মনে মনে বললাম, আমার তো ভালই লাগে রাম বিহারি ঠাকুরকে। মতিহারি আর দ্বারভাঙ্গার গল্প বলে। মজঃফরপুরের লিচু নাকি রসগোল্লা সে মিঠা। দুপুরবেলা একেক দিন চোখ নাচিয়ে নিজের মনে গান গায়, ‘একটা গান লিখিও আমার জন্য’। আমি যতই বলি লিখিও না, লেখ। ও একই ভুল করে। আর হাসতে হাসতে রান্নাঘরের দরজায় পিঠ ঘসে। আমাকে একদিন ছট পূজার লাড্ডু খাওয়ালো আর কাশীর পেয়ারা। আরেকদিন আমার পছন্দের বড় বড় সফেদা এনে হাসতে হাসতে বলল, ‘খোকা বাবু সাপাটু খা’লো, বহত মিঠা’।
আমি স্কুল থেকে ফিরে হাসি মুখে ভলটুকে দেখে আসি। বিকেল না হোতেই বেশ ঠাণ্ডা। এসময়টা ও ঘুমায়। একটা পুরাণো কাঁথা ওর বিছানা। তিন হাত কম্বলের নীচে গুটি সুটি মেরে পরে থাকে ও। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে রান্না ঘরে খেতে ঢুকি। মায়ের সামনে আরেকবার হাত ধুতে হয়। জাম বাটিতে দুধ, তাতে আতপ চালের ভাত। তার মধ্যে মানিক কলা আর কানসাটের সন্দেশ নরম আঙুল দিয়ে চটকে মাখছেন মা। আমার জিভে জল ঝরছে। ঠোঁট চাটছি কেবল। নাড়িভুঁড়ি জুড়ে খিদের মোচড়। পেট থেকে মাথা বুক পায়েও ছড়িয়ে পড়েছে। পেট সাঁটিয়ে খাওয়ার পর বড় একটা ঢেকুর উঠলো। মায়ের ঘুম ভাঙা শান্ত মুখে উথলে উঠলো হাসি। এর মধ্যে বাবা এলেন। আমার হাতে কাগজের একটা প্যাকেট দিয়ে বললেন, ‘এই নাও। তোমার ভলটুর জন্য’।
খুলে তো আমি থ। খুশিতে শূন্যে অরুময় নাইগমের মত শট মারলাম। প্যাকেটের মধ্যে কুকুরের গলার বেল্ট, রূপালি ঝকঝকে বকলেস আর লম্বা চেন। আমি এক ছুটে ভলটুর গলায় ওটা পড়িয়ে পিঠে ঠ্যালা মারলাম, ‘চল চল বেড়িয়ে আসি’। মহানন্দার ধারে বাঁধের উপর গট মট করে ঘুরলাম। কয়েক দিন ধরে খুব হুটোপাটি চলল ভোলটুর সাথে।
এরপর এক অদ্ভুত কাণ্ড। আমাদের স্কুলে শুক্রবার লম্বা টিফিন। মাঠে চুটিয়ে খেলছি, দাড়িয়া বাঁধার পর খো খো খেলা। হঠাৎ দেখি ভলটু দৌড়াচ্ছে আমার পাশে। গলার শিকল খুলে স্কুলের তারকাঁটা আর পাহারাদার মিছরি লালের আগুন চোখ ডিঙিয়ে ঢুকলো কি করে ও? আমি আবক।
মাষ্টার মশায়দের কানেও নিমেষে পৌঁছে গেল কথাটা। বাঁদিকে তাকিয়ে দেখলাম ক্লাস টিচার বিধুবাবু দাঁড়িয়ে। উনি আবার বাবার মক্কেল। খুব রাগি কিন্তু নরম গলায় বললেন, ‘তোমার পোষা কুকুর? আশ্চর্য ব্যাপার। গায়ের গন্ধ পেয়ে এক মাইল দূর থেকে চলে এসেছে? কী ঘ্রাণ শক্তি, বোঝ! তুমি ওকে নিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ি চলে যাও। আমি হেড স্যারকে বলে দেবো’।
আমি চনচনে রোদ মাথায় নিয়ে বাড়ি পৌঁছে গেলাম। মা ঘুমে। রান্নার ঠাকুর ঘুম জড়ানো লাল চোখে দরজা খুলে দিল। দাদু-ঠাকুমার ঘরে গ্রামাফোন রেকর্ডে গান বাজছে—‘কে যাস রে ভাটি গান বাইয়া…’। ওঁরা জিজ্ঞেস করবার আগেই আমি উত্তেজিত মুখে ভলটুর কীর্তি-কাহিনী বললাম। দাদু বললেন, অবাক কাণ্ড! এত দূরে গায়ের গন্ধে ঠিক তোকে খুঁজে নিল! খুব যত্নে রাখ ওকে’।
ওকে যত্নে রাখতে গিয়ে আমার লেখাপড়া মাথায় উঠেছে। সকাল বেলা সরলা মাসি ভলটুকে বাগানে ছেড়ে আসে। তারপর খেতে দেয়। আমিও স্কুলের পড়া শেষ করে দাদার সাথে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে স্কুলে যাই। কিন্তু ক’দিন ধরে ভলটুর দেখভাল করতে গিয়ে আমার পড়াশোনা একদমই হচ্ছে না। সারাদিনই আমার পায়ে পায়ে ঘুরছে ভলটু। দাদা বলল, ‘ডাহা ফেল করে যাবি কিন্তু’।
আমার সিক্স, দাদার নাইন। দাদা ইঞ্জিনিয়র হতে চায়। আমাকে অবশ্য অনেকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুই কি হবি’? একদিন মা বললেন, ‘এখন তো বড় হয়ে গেছিস। তোর দাদা ইঞ্জিনিয়র হবে, দিদি মাস্টারনি। আর তুই’? আমার মিনমিনে গলা, ‘কিছু একটা হোলেই হবে’। মা হেসে ফেললেন, ‘আর দু’দিন পর সলা ফিরবে। তখন বেশি করে পড়তে হবে কিন্তু’।
তিনদিন পর স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখি সরলা মাসি গম্ভীর মুখে মা-কে অনেক কথা বলছে। হঠাৎ আমার কানে ঢুকল মা-র গলা, ‘ভলটুটা খাচ্ছে না কেন’? আমি দৌরে ভলটুর কাছে গেলাম। ওর কালো চোখের মণি দু’টো কোটরে ঢুকে আছে। কেমন মায়াবি দৃষ্টিতে তাকাল ও। আমাকে দেখে কুঁই কুঁই আওয়াজ করে করুণ মুখটা উঁচু করলো। আমি ওকে জড়িয়ে কাঁদলাম। ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বললাম, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার? ডাক্তার দেখে ওষুধ দেবে, ভালো হয়ে যাবে’।
মায়ের গলায় একরাশ উৎকণ্ঠা, ‘সলা, কৃমি টিমি হয় নি তো? জলে গুলে একটু কালমেঘের রস খাইয়ে দাও’।
কালমেঘ খেয়ে মাংসের একটা টুকরো চিবিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ভলটু। মা বললেন, ‘আস্তে আস্তে ঠিক হোয়ে যাবে’।
পরদিন ভলটু মুখে কিছু তুললো না। মা বললেন, ‘বড় চিন্তার ব্যাপার হল তো’! দাদা বললো, ‘তোরা মাঠে যা দৌড়াস! কোন পাথরে লাগেনি তো’? রাম বিহারি বলল, ‘বহুত দুখ হচ্ছে ছোটা বাবু’। দাদু ঠাকুমা দুপুরে খাওয়ার পর ভলটুকে দেখে বললেন, ‘গোটা বাড়িটা ও জাগিয়ে রাখতো। ওর সাড়াশব্দ নেই। বাড়িটা একেবারে খাঁ খাঁ করছে’।
বাবা বিকেলের আগে বাড়ি ফিরে বললেন, ‘আমি এখনি পশু হাসপাতালে খবর দিতে যাচ্ছি’।
মা-র গলায় উৎকণ্ঠা, ‘যেতে তো হবেই। তবে এবার বাড়িতে একটা টেলিফোন নাও’।
সকালে পশু চিকিৎসক এসে ভলটুর চোখ জিভ দাঁত খুঁটিয়ে দেখে বললেন, ‘মনে হচ্ছে চোট আছে কোথাও’।
বাবার গলায় একরাশ উদ্বেগ, ‘তাহলে উপায়’?
-ব্যাথা কমাবার ওষুধ দিলাম। তিন-চার দিন খাক। ন্যাচারাল হিলিং হবে আশা করছি।
তিন দিনে আরও শুকিয়ে গেল ভলটু। শরীর কংকাল সার, চোখ একদম কোটরে ঢুকে গেছে। সরলা মাসি চোখের জল ফেলতে ফেলতে মায়ের কাছে বলছে, ‘রাম বিহারি হারামিটা ওকে মইরা ফেললো গো। ভলটুর তরাসে রাতের নেশা বন্ধ। তাই চেনে বাঁধা প্রাণীটারে পিটায়ে মারি দিল গো’! দাদা গম্ভীর গলায় বলল, ‘সরলা মাসি, প্রমাণ ছাড়া তুমি ওকে দুষছ কেন’?
পরদিন সকালে আবার ডাক্তার এলেন। গম্ভীর মুখে হাতে সাদা গ্লাভস পরে ভলটুর শরীরে এখানে অখানে খোঁচা মেড়ে বললেন, ‘উকিলবাবু বড় দুঃখের ব্যাপার। ডগটার কোমড় ভেঙে গেছে। ও জায়গায় তো প্লাস্টার হবে না’।
বাবার চিন্তিত মুখ, ‘তা হোলে’?
ডাক্তার অসহায় ভাবে মাথা নাড়লেন। একরাশ কান্না জমাট বেঁধে গেল আমার গলার কাছে। দিদি চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদছে। সরলা মাসির হাউ হাউ সরব কান্না। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে সরলা মাসি মাকে বলছে, ‘দিদি তুমি বিশ্বাস কর, রাম বিহারি চেলা কাঠ দিয়া ভলটুরে পিটাইসে। বিহারিটা সব পারে’। মা বললেন, ‘সলা তুমি পোয়াতি মেয়ে, এ সময় কান্না কাটি করে শরীর খারাপ ক’রোনা’।
পরের ঘটনা গুলো সুখের ছিলনা। না খেয়ে খেয়ে ভাঙা কোমড় নিয়ে দু-দিন পর শুকিয়ে মরে গেল ভলটু। লখাই ডোম ওর হাড্ডিসার শরীরটা চটের বস্তায় ভরে টানতে টানতে বাগানে নিয়ে গেল। একটা বড় গর্ত করে শুকনো শরীরটা ওতে ধপ করে ফেলে মাটি চাপা দিল। রাম ঠাকুর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভলটু কেয়া মুসলমান থা’?
বাবার শুকনো মুখ, একরাশ দুঃখ থম মেরে আছে। রাম বিহারির কথায় বাবার গম্ভীর মুখে এবার বিরক্তি, সঙ্গে একরাশ ঝাঁঝ ফুটলো। ভারী গলায় বললেন, ‘হিন্দুদেরও কবর হয়’। তারপর রাম বিহারিকে বাবা বাইরের ঘরে ডেকে অনেকক্ষণ জেরা করলেন। পরদিন থেকে আর কাজে আসেনি রাম বিহারি। মা রান্না করছেন। বাসন মেজে মায়ের সাথে রান্না চুকিয়ে সরলা মাসি ভলটুর কবরে একটা গাছ পুঁতে দিল। বলল, ‘কান্ত তোমার প্রিয় ফলের গাছ, সবেদা। দেখবা গাছ ভর্তি টোপা টোপা ফলে বাগান হাসবো। বড় বড় ফল হয়ে ভলটু ঠিক আবার ফিরা আইব’।
ভলটুর শোকে কয়েক দিন কান্নাকাটির পর বিধু বাবুর ধমক খেয়ে আমি পড়ায় মন দিলাম। নাইনে উঠে সায়েন্স নিয়েছি, দাদা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে কলকাতায়। সরলা মাসির ছেলে এক পা এক পা করে হাঁটছে। দিদির বিয়ের দিন পাকা। জমাইবাবু বালুরঘাট সাবডিভিশন আদালতের মুন্সেফ। রবিবার দুপুরবেলা দিদি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মুখে শুধু এক কথা – তোদের ছেড়ে কেমন করে আমি অত দূরে গিয়ে থাকবো? ছাব্বিশে অগ্রহায়ণ দিদির বিয়ে, মানে এক সপ্তাহ মাত্র বাকি। বাড়ি ভর্তি লোকজন। বাবা খুব ব্যস্ত। ভাঙা হাঁটু নিয়ে দাদুও উপর-নীচ করছেন।
হঠাৎ রিক্সা চেপে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল ঠাকুর রাম বিহারি। ওর গাঁট্টাগোট্টা ছেলে সুরেশ কোলে তুলে রাম বিহারিকে বাড়ির ভিতর নিয়ে এল। রাম বিহারির জীর্ণ শরীর, গর্তে ঢুকে গেছে দু-চোখ। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাফি মাংতে আসলাম মা-জী। আমার আয়ু অব খতম’। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মিন মিন করল, ‘মাফ করিয়ে খোকা বাবু। তোমার ভলটুকে রান্নার লকরি দিয়ে হামি জী-ভরকে পিটাই করেছি। এক সাল আগে গোলাপট্টিকা রাস্তায় হামি ভি পড়ে গেলাম। কোমড় বিলকুল টুটে গেল’।
আমার বুকে তখন ভরা বর্ষার গঙ্গা-গর্জন। বুকের মাঝখানে ঘূর্ণির মত ক্রমাগত পাক খাচ্ছে ভলটুকে হারানোর কষ্ট। শোকের শুকনো ক্ষতে নিঃশব্দ ক্ষরণ। রক্তাক্ত হৃদয়ে চোয়াল আর ডান হাতের মুঠো শক্ত করে ভাবলাম রামবিহারির আমচুরের মত শুকনো থুতনিতে ঝাড়ি একটা ঘুষি। সরলা মাসি আমার ক্রোধী মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ক্ষমা করি দাও। ভগবানের মার বড় মার’।
কোমড় ভাঙা মুমুর্ষ মানুষটা হাত জোড় করে করুণ চোখে বিদায় নিল। দুঃখের জমাট পরিবেশে নীরবতা ভাঙল সরলা মাসি। নিচু গলায় বলল, ‘ভগবানের দুনিয়া গো! অবলা জীবেরে মারিবা, আর শাস্তি পাবা না’?
শিতের দুপুর, পড়ন্ত রোদে আজ আবার বাগানে গেলাম। সফেদা গাছটা আমার মাথা ছাড়িয়ে লক লক করে বেড়ে উঠেছে। আমি গাছটাকে দু’হাতে জড়িয়ে ওর কাণ্ডে কপাল রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদলাম। তারপর আদর করে গাছের গোড়ায় এক বালতি জল ঢাললাম। মাটিতে সোঁদা গন্ধ। গাছের ঘন পাতার ফাঁকে ফাঁকে খুঁজলাম যদি কোন ফল ধরে থাকে।
সেই বাড়ি বাগান সফেদা গাছ আর নেই। এখন কেবল স্মৃতির সঞ্চয়। ভাগ-বাটোয়ারা-বিক্রির পর ভিন্ন মালিকানায় বাড়ির হাত বদল। দাদু-ঠাকুমা, বাবা-মার অধিষ্ঠান কেবল স্মৃতিতে। দাদা বিদেশে, দিদি দিল্লী, আমি কলকাতায়। মাটির পরশ থেকে অনেক উঁচুতে সাত তলায় আমার ফ্ল্যাট। ছেলের পড়ার ঘরে বইয়ের বেঁটে আলমারির মাথায় প্রমাণ সাইজের এক স্বাস্থ্যবান খেলনা কুকুর। তাকালে মনে হয় স্মৃতির সরণি বেয়ে ভলটু এই বুঝি আমার কোলে হামলে পড়বে। আমার ন’বছরের ছেলে ওকে কোলে নিয়ে আদর করে। আজ দেখলাম অঙ্কে কম নম্বর পেয়ে মায়ের প্রবল তিরস্কারে জর্জরিত আমার পুত্র খেলনা কুকুরকে বুকে আঁকড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
নিমেষে পঁয়ত্রিশ বছরের সময়-সিঁড়ি ডিঙিয়ে আমার বাগানে পৌঁছে দেখলাম ভলটুকে জরিয়ে এক বুক দুঃখে কাঁদছে দশ-বারো বছরের এক বালক।
বুক ভাঙা শোকে প্রিয় জনকে জড়িয়ে কাঁন্না ছাড়া মানুষের আর উপায় কী!