–লেখক রিঙ্কু রায়
‘দুম করে গাছে চড়ে পড়া।
গা বেয়ে গাছের চুড়োয়।
উঠে পড়া সহজই।
নামতেই মাথা ঘোরে।
তাই ভয়ে ওখানেই।
নামা আর হয় না।
কবি তাই ঢাকা পড়ে কবিতায়।’
বই এর ভূমিকা শুরু হয়েছে কবিতা দিয়ে। গাছের উপরে উঠিয়ে দিয়েছে কেউ জ্ঞানরূপ খাদ্য আস্বাদন করতে।কিন্তু নামার উপায় জানা নেই। ফলস্বরূপ খাদ্য খাদকের জাঁতাকলে বাঁধা পড়া বাঁধা ধরা পৃথিবীতে সৃষ্টির জন্যে বারবার ফিরে আসা কবিতায়। ভূমিকাতেই কবি এবং কবিতার অমলিন সমীকরণ বোঝানো। এই কবিতারই শেষে বলা হয়েছে,
‘মনের চোরাকুঠুরীর তালা খুলে গেছে হঠাৎই। চাবিটা তালার গায়ে ঝোলানো। কেউ কি তালাটা আর লাগাবে?’
বই এর প্রথম কবিতা কাব্যগ্রন্থের নামেই, সেখানেও উল্লেখের দাবী রাখে,
’প্রকৃতির পাঠশালা
ঘুম-ভাঙা বেকারের
গুমরানো নিরাকার মন।’
আবার আরেক জায়গায়
‘আলপিন শব্দ।
সময় থমকে চলে।’
এই সকল শব্দচয়ন যেন এই সময়ের স্তব্ধতাকেই বোঝাচ্ছে।
কবিতার শেষে আছে,
‘মানুষ তো একই আছে।
তবু।
অচেনা সময়।
আর কতদিন?’
প্রথম কবিতাতেই আমাদের সবার মনের সেই জমে থাকা করুণ প্রশ্ন তরুণ উদীয়মান কবি অমিতাভ সরকারের কলমে।
প্রকাশভঙ্গীর অভিনবত্ব লক্ষ্য করবার মত কবিতার নামকরণে,যেমন অর্থনীতির সূত্র, অদ্ভুত খেলা, মৎসাবতার, মনে পেরেক, ভাইরাস, বৃষ্টি-ছোঁয়া, বিষ, ডাস্টবিন, খবরে গণিত, কঠিন প্রশ্নপত্র, রোজানা ইত্যাদি তিপ্পান্নটি কবিতার প্রত্যেকটিই তাদের নিজের ভাবপ্রকাশের স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল।
আমি সাধারণ পাঠক। কবিতা বোঝা বা তার গুণাগুণ বিচার করা যে কোনো সময়েই খুব সহজ কাজ নয়। এই অচেনা সময়ে অচেনা মানুষের চিন্তাচেতনা, দৃষ্টিকোণ, মুখোশের দেখানদারি রূপের আড়ালে মানবমনের দেহসত্ত্বার চেনারূপের অন্বেষণ জারী রয়েছে বইএর অন্যান্য কবিতায়। অস্তিত্ব, অর্থনীতির সূত্র, পুঁজি, ভাইরাস, জরা, পৃথিবী গ্রহের ছবি প্রভৃতি নামগুলো দেখতে গিয়ে মনে হচ্ছে এক এক পাতায় এক এক ছবির বিচিত্র সমাবেশ,অধিকাংশই মূলত গদ্যকবিতা। সামান্য কয়েকটি সহজ ছন্দের দাবী রাখে যেমন ‘গণেশ পুজো।’ কবিতাগুলোর মনোজ্ঞ বিষয়বস্তু বিন্যাসও বেশ প্রশংসার দাবী রাখে।কোনো বিষয়ের সঙ্গে অন্য বিষয় মিলে যেন কাব্যমালিকা গাঁথা হয়ে চলেছে পাতার পর পাতা জুড়ে।
সুন্দর লাগলো ‘অদ্ভুত খেলা’, মানবাত্মার ভক্তিরসে জারিত হাতের চেটোয় ধরা ভক্তির এক ছোট্ট জলবিম্ব যেন।কবি প্রকৃতিকেও উপেক্ষা করতে পারেন নি এই কাব্যগ্রন্থে। মানবাত্মার সাথে প্রকৃতির যে অমলিন সম্পর্ক।আমরা সমস্ত দিনের পরিশ্রমান্তে প্রকৃতির বুকেই মাথা রেখে বিশ্রাম নেই। সেইরকমই একটি কবিতা ‘চাঁদ নেমেছে।’ ঘাসের মাদুরে বসে আসর জমার রাত্রিকালীন নৈসর্গ চিত্রণ অতুলনীয়।
চৌষট্টি পাতায় এই সংকলনে
মানবহৃদয়ের দুঃখ-যন্ত্রণা,জীবন-সংগ্রাম,
বিরহ,প্রেম,অন্তর্দাহ,দ্বন্দ্বের পাশাপাশি মাটির টানে মানুষের পাশে থাকার আহ্বান ধ্বণিত হয়েছে ‘মাটির টানে’ কবিতায় যেখানে বলা হয়েছে,
‘মেঘেই আবার আকাশ ভরাট।’
এক আকাশের নিচে জীব জড়ের দুঃখ যেন উপরের আকাশকেও বিচলিত করেছে।তাই তো বৃষ্টিধারার মাটিতে আসা।
আসলে আমাদের এই অসুখ সময়ে ঠিক কবে যে মেঘমুক্তি ঘটবে তা ঠিক করে কিছু বলবার অবস্থা নেই।সমকালীন ঝড়যাপনের ছবি ফুটে উঠেছে ‘বন্যা’ কবিতায় –
‘জীবন আজকে গাছের গুঁড়ি,
বইছে নিচে জীবন-নদীর জল।
ঘরবাড়ি সব শেষই কালের ঘরে;
হারিয়ে গেছে মাটিরই শেষ-তল।’
এইখান থেকে কবির আশাবাদে উত্তরণ,
‘সবারই তো মন যে আছে,
মনের আছে ভাষা,
তাতেই জীবন আবার বাঁচে,
মনেই বাঁচার আশা।’
দৈনন্দিন দুঃখময় জীবনে আমাদের বিভিন্ন শারীরিক, মানসিক অসুস্থতার মধ্যেও প্রতিনিয়ত আশা নিয়েই বাঁচতে হয়,আশাহত হয়ে মনের যুঝবার চাহিদাও কমে যায়, তাই আশা রাখতেই হয়।
‘আজব যুদ্ধ ‘ কবিতাটি একটি অনন্য কবিতা বলে মনে হয়েছে।সমকালকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা কিভাবে চিকিৎসা জীবিকার সাথে যুক্ত মানুষ জীবন হাতে করে কাজ করছেন ঘর-সংসার সামলে,কিভাবে মানুষ পেটের দায়ে বাসে বাদুরঝোলা হয়ে কর্মক্ষেত্রে পৌছানোর আর্তি,কিভাবে চিকিৎসা করতে গিয়ে চিকিৎসক নার্সদেরই জীবন নির্বাপিত, তার এক অনন্য প্রকাশ যেখানে সুন্দর লাগলো,
‘ঝাঁসীর রাণী অসুখ-যুদ্ধে লড়ে,
প্রাণকে ফোটায় প্রাণের বিনিময়ে। ‘
আলোচ্য বইএর বিভিন্ন কবিতায় ইতিহাসের প্রসঙ্গের বেশ সুন্দর অবতারণা রয়েছে।
‘পৃথিবীর কাব্যে
দিনের যুদ্ধ শেষে
ভীস্মের শরশয্যা।
কোথায় সাবিত্রী? ’
অথবা,
‘যুগে যুগে কতবার
ফিরে আসে দধীচি!
তাঁদেরও তো কাজ আছে।
বজ্র তো প্রস্তুত।
মানুষেরই হাতে সব।’
ইতিহাস-ভাবনা সমকাল যেন এই অচেনা সময়ে মিলে-মিশে একাকার।
এখনকার বাংলা কবিতায় গুরুগম্ভীর ভাব কঠিন শব্দের চমৎকারিত্ব উদীয়মান তরুণ কবির লেখনীতে যেন কিছুটা অনুপস্থিত। প্রশ্ন জাগে,কবিতা যত ভার বোধ্য হয়,তাতে কি কবিতার উৎকর্ষতা বাড়ে?
সমকালীন ভাবনায় মানুষের চিরাচরিত দোষ ত্রুটির বিশ্লেষণে আমাদের ‘কালো-সাদা,রোদ-মেঘ-জীবনে একটু দোষ থাকাটা’ কবির কাছে দোষের মনে হয় নি বরং স্তাবকতাকে কবি ভয় পেয়েছেন যে ‘স্বার্থসিদ্ধিলাভ ঘটলেই
অন্য পোশাক গায়ে উঠবে।’
কবি প্রশ্ন রেখেছেন,
‘উচিত-অনুচিত তবে কোনটা?
কীসে একদম সব ঠিকঠাক?
বাঁকা-ট্যারা সব্বার মুখোশই।
কিছুতেই সব ঠিক হয় না।’
সত্যিই সবদিক ঠিক কখনই থাকে না, ঠিক
রেখে চলাও মুস্কিল। আসলে ঠিক-বেঠিকের জাঁতাকলেই দিশেহারা মানবজীবন। মাছ খোঁজা কবিতায়
কবির আক্ষেপ,
’হৃদয়-গভীরে কেউ ঢোকে না।
বাইরেটা ভালো হলে সব ঠিক।
বেশি জানবার নেই দরকার।
ভুলটা দেখেও ঠিক লাগবেই।’
একই কবিতায়
‘ছিপ ফেলে বসি আজ পুকুরে।
এক-দুটো চারাপোনা উঠবেই।’
লাইনগুলো বেশ মনের কথা বলে দেয়।
‘মৎসাবতার’ কবিতায়
‘জীবন তো কয়েকটা সংখ্যা;
রোজ রোজ খবরেই শোনা যায়।’
এ তো বর্তমান কঠিন কালকে নির্দেশ করে।
বই এ কিছু রোমান্টিক প্রেমের কবিতাও রয়েছে যেখানে মানবজীবনে স্মৃতির অনুসঙ্গ প্রকৃতির মাঝে বারবার সাড়া দিয়ে গিয়েছে কোথায় যেন।
‘অস্তিত্ব’ কবিতায় যেখানে পুরানো সময়ের স্মৃতি রোমন্থনে কবি লিখছেন, ‘চলাচল কবেকার রিকশায়।’
‘পর্বত-প্রান্তরের ডাক’ সেইরকম ঘরবন্দী মানুষের বাইরে বেরিয়ে পড়ার অমোঘ আহ্বান,যেখানে বন্ধুত্ব ভালোবাসা হাত ধরাধরি করে যেতে চায়।
‘প্রেম’ কবিতা তো আমাদের মনের অব্যক্ত গহীন ভালোবাসাকেই ফুটিয়ে তোলে।
‘জলের ছোঁয়া’ যেন সমাজের স্পর্শ ভীতিকেই বোঝাচ্ছে যখন বলা হচ্ছে,
‘জলকে ছুঁলে ওর কি কিছু হবে?’
‘ঘরে ফেরা’ কবিতায় অন্ন সংস্থানের জন্যে ঘর ছাড়া মানুষদের পায়ে হেঁটে পৌঁছানোর স্মৃতিকেই উসকে দেয়।
হ্যাঁ, মানুষের জীবনে অনেক কিছুই পাওয়া হয় না সময় মতো, দেখা হয় না পার্থিব প্রিয়র সাথে, ভালোবাসাও অধরা থেকে যায়।
‘বৃষ্টিও থামে একদিন।
পৃথিবীর মাঠ-ঘাটে ব্যথা ঘর বাঁধে,
ধুলোবালি খেলা করে মেঠোমজুরের সাথে।
মাটিতে লুটিয়ে যায় তারপর;
চিরটা কালের মতো।’
এইভাবেই যেন দুঃখ শোক-যন্ত্রণা তাড়া করে এ জীবন।
‘বৃষ্টি-ছোঁয়া’ অসাধারণ রচনা। বর্তমান সময়,সমাজ,গৃহকোণে আবদ্ধ জীবন, প্রকৃতিচেতনা,নিসর্গের প্রতি অমোঘ আগ্রহ যেন মনের সমস্ত ক্ষুদ্রতাকে তুচ্ছ করে প্রকৃতির বিশালতায় সামিল হওয়ার ভাবনা কবিচেতনায় চিত্রিত হয়ে ফুটে উঠেছে।
অন্যান্য কবিতা ত্রুটির ফাঁদ,টুপি খোলা, বিষ, বিবাহ, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, তাপ এ তো আমাদের জীবনেরই কথা।
‘গীতবিতান’, ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’, ‘ধোনি’ তিনটি একটু ভিন্নধর্মী লাগলো যেখানে কবির ভাবনায় কবিগুরু, তাঁর গান যেভাবে জীবনকে আলোড়িত করে তার প্রাঞ্জল লেখনীর ঠিক পরবর্তী কবিতায় ক্রীড়াক্ষেত্র, খেলাধূলা এইসব উঠে এসেছে ‘ধোনি’ নামক কবিতায়, কবিতা পৃথিবী রৌদ্রবৃষ্টি স্নাত মুক্ত বাতাসের খোলা অঙ্গনে।
চমক যেন আরো কিছুটা পরে।
যেখানে পেলাম,
‘বিজ্ঞান খুঁজছে এত যে।
মনের হদিশ কেন অধরা!
মনেরই করোনা টেস্ট করো না।
রিপোর্ট পজিটিভই আসবে।’
‘হৃদয়ের বাস টোটো খালি যায়।’
প্রভৃতি লাইন।
অসাধারণ লেখা ‘পৃথিবীর অপেক্ষা’, ‘রিক্ত কুলায়’
‘দেখানো’ কবিতায় শেষের লাইন,
‘জীবনের বেশিটাই না পাওয়া।
পাওয়াটাই বেশি বেশি দেখানো।
বাইরের অভিনয় সেটাতেই।
পেলে আর দেখানোর কি মানে?
যতিচিহ্ন, বানানে কিছু জায়গায় প্রমাদ চোখে পড়লো, সেইটুকু উপেক্ষা করাই যায়।
‘এপার -ওপার’, ‘পথ চলা’, ‘মুক্তি’, ‘আড়ালে’ সত্যিই খুব ভালো লাগলো।
বই এর শেষ কবিতা ‘রোজানা’,যেখানে কবি লিখেছেন
আমাদের সবার সংসারের চালচিত্র যা কম বেশি একই।
‘বাসনে আসন ছাড়ে দোষারোপ।’
শেষ লাইনে আবার বলছেন,
‘রোজকার গল্পটা এই তো।’
সমগ্র কাব্যগ্রন্থ জুড়ে মানবমনের চেনা-অচেনারূপের খোঁজ চলেছে, যা আমাদের মনেও চলতে থাকে অবিরতভাবে। বইয়ের দামটাও খুব বেশি নয়, মাত্র পঞ্চাশ টাকা, বইটি আকারেও ছোটো। সহজ সরল ভাষায় লেখা। পাঠকেরা পড়তে পারেন। ভালো লাগবে।
বইটি প্রকাশক করেছেন ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, ৯ শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০৭৩।
প্রচ্ছদ এঁকেছেন শ্রী শঙ্খজিৎ জানা।