মৌ দাশ
আমার মাঝে মধ্যেই মনে হয়, টাকা কেনো গাছে হয় না! ফেসবুক মেসেঞ্জারে কেনো খাবার পাঠানো যায় না! অথর্ব উপাদানে ভরা অকেজো মন-মেজাজকে কেনো কম্পিউটারের মত রিফ্রেশ করে ফেলা যায় না! মন ভালো করার জন্য হয় বই পড়া লাগে, অথবা কারো সাথে কথা বলা লাগে। আর আমার বান্ধবী টিকলির মত কারো সাথে হলে তো কথাই নেই। একবার কথা শুরু করলে সে আর কোনদিন থামবে বলে মনে হয় না। যত বিষণ্ণতা থাকুক সে আপনার মন ভাল করেই ছাড়বে। গেমস খেললেও মন ভালো হয়। কিন্তু অনেক সময় বই, মুভি, গেমস কিছুই যেন আমার “ভাল্লাগে না” রোগের বিরুদ্ধে পেরে উঠে না। এসব ভাল না লাগা দিনগুলি আমার খুব অসহ্য লাগে, মনে হয় মনটাকে যদি কোনভাবে স্ক্যান্ডেনেভিয়ান রুপকথার প্রজাপতির মত হাতে নেওয়া যেতো তাহলে তাকে কোন এক সমুদ্রের নির্জন বালিয়াড়ির পাশে লতা-গুল্মের ঝোপে ছেড়ে দিয়ে আসতাম। সে বন্য গোলাপের বাগানে ঘুরে প্রশান্ত হয়ে ফিরে আসত।
আমার মাস্টার্স প্রোগ্রামের শেষ এসাইনমেন্টটা জমা দিয়েছি মাসের পহেলা তারিখে। সপ্তাহে দুদিন শুশিতে কাজের বাইরে এখন অখণ্ড অবসর। সারাদিন বাসায় থাকি। আমার বাসা গামেল কোজে এলাকায়। এটা ছিল ভাইকিংদের একটা পল্লী। কোপেনহেগেন শহরটাও গড়ে উঠেছে এই জনবসতিকে কেন্দ্র করে। ১,১০০ বছর আগের জেলে পল্লীটা এখন ছিমছাম সাজানো এক সুন্দর শহর। আজ দুপুরে হঠাৎ মনে হলো একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসছি না কেনো! আমার বাসার পাশেই গাজীপুরের শালবনের মতো সুন্দর ঘন শ্যামল একটা জঙ্গল আছে। মাঝে মাঝে আবার ছোট ক্যানেল এর মতো কিছু ক্ষীণ জলধারা আছে। এসবের উপর ছবির মত ছোট ছোট ব্রিজ। প্লে গ্রাউন্ডগুলিও বেশ লাগে; বসে বসে খেলা দেখি অনেক সময়। বেশিরভাগই সকার ম্যাচ। এদিকে ক্রিকেট খেলতে দেখি খুব কম। মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের বিশ-ত্রিশ জনের দল নানা রকম খেলা প্র্যাকটিস করে। অনেক মজার কিছুও করে তারা। যেমন একবার ছোট একটা মেয়েকে দেখলাম গাছে ওঠার মতো করে বন্ধুদের চার-পাঁচ জনের হাত পা বেয়ে উপরে উঠে গিয়ে একটা স্ট্যাচুর মত বানিয়ে ফেলল। ঘর থেকে বের হলে কোন একটা চাঞ্চল্যের দেখা পাই, মুখরতার সন্ধান মেলে। তবু আজকে আমার কেনো যেন কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না।
সমুদ্র আমার খুব ভাল লাগে। কিন্তু এই বাসার আশেপাশে কোথাও সমুদ্র নাই। ত্রিশ মিনিট ট্রেনে চেপে কাছের একটা সমুদ্র সৈকতে চলে যাওয়া যায়। যাবো কিনা ভেবে ঠিক করতে পারছি না। রান্নাও করা দরকার। সেটাও ইচ্ছা করছে না। আমার বাসার পাশে ছোট কিন্তু দারুন কিছু রেস্টুরেন্টও আছে। সুন্দর, নিরিবিলি। আচ্ছা, একটা ভাল রেস্টুরেন্ট থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে সমুদ্রে চলে গেলেই তো হয়! সারাদিন সমুদ্র দেখে, “ভাল্লাগে না” রোগ সারিয়ে না হয় বাসায় ফিরলাম! এখন দুপুর ২টা। ভোরের দিকে ঘুমালে আমি এমন সময়ই সাধারণত ঘুম থেকে উঠি। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলিতে আমি এমন করি। ঠিক ৩৫ মিনিট পর ১৩২ নাম্বার বাসটা বাসার সামনে থেকে পাওয়া যাবে। এই বাসের ড্রাইভাররা রোবোটের মত। ন্যানো সেকেন্ড দেরি করলেও এই বাস ধরা যাবে না। আজ অবশ্য অনেক সময় আছে। আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে বের হলাম। বাসার বাইরে পা দিতেই মন ভালো লাগছে। কি আশ্চর্য! বাসা থেকে বের হতে ইচ্ছা করছিল না। বের হয়েই সবকিছু অন্যরকম লাগছে। বাস আসার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে আমি বাস স্টপে পৌঁছেছি। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে হেলেদুলে ১৩২ আসছে। আমি মনে মনে হাসলাম। রকেটের গতিতে এলেও সে আর আমাকে রেখে যেতে পারবে না। গুনে গুনে তিনশ সেকেন্ড বাঁকি।
কিন্তু, একি, আমার বাস কার্ড কই! বাহাদুরি করে পনেরো মিনিটে রেডি হতে গিয়ে সব কিছু ঠিকঠাক না নিয়েই বের হয়ে গেছি। কার্ড, পার্স বাসায় রেখে এসেছি। আচ্ছা, মোবাইলে টিকেট কিনে ফেলা যাক। না, সে চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। এপ ওপেন করতে করতে রোবটিক বাস ভ্যানিশ। রাগে গা কটমট করছে। কি আর করা! বাসায় ফিরে গেলাম। যে কার্ডগুলো কোন কাজে লাগবে না সেগুলোও ব্যাগে গুঁজে নিয়ে বের হলাম। দশ মিনিট হেঁটে ২০০-এস বাস নিয়ে ‘টম ঈয়াম’ রেস্টুরেন্টে আসার পর কেমন শান্তি শান্তি লাগছে। এখন কিছু খেয়ে নিয়েই বের হয়ে যাব সমুদ্র মন্থনে। কেমন হয় কিছু খাবার কিনে নিয়ে সমুদ্রে চলে গেলে? সামুদ্রিক লোনা জলের প্রান্তহীন দূরত্ব পেরিয়ে বয়ে আসা বাতাসে নিঃসঙ্গ মধ্যাহ্নভোজ। কিন্তু, টম ঈয়াম এর পিজ্জা বয়ে নিয়ে যাওয়া ঝামেলার হবে ভেবে পাশের কেবাব (ডেনিসরা এভাবেই উচ্চারণ করে) সপ থেকে কেবাব বক্স নিয়ে নিলাম। টম ঈয়াম এর ঠিক পাশের দোকানটাই কেবাব সপ। আর তার ঠিক উল্টা দিকেই ১৩২ এর বাস স্টপ দেখে আমার গা জ্বলে গেলো। তবে সুখের কথা হল সমুদ্র দেখতে এবার আমার ১৩২ বাসটা নেওয়া লাগবে না। মনে মনে হাসলাম। ১৩২ এর দিকে অবজ্ঞার তীরটা তাহলে শেষমেশ ছুঁড়ে দেওয়া গেলো। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এই প্রতিশোধ নিতে পেরে আমি কেমন খুশি হয়েছিলাম।
এখন যে বিচে যাচ্ছি, সেখানে আমার খুব বেশি একটা যাওয়া হয় না, একটু দূরে বলে। শেষ গিয়েছি তিন মাস আগে। যতদূর মনে পরে ‘২৩-এ’ বাসটা ধরলেই ঠিক চলে যাওয়া যাবে। গুগলে একবার দেখে নেওয়া যায়। কিন্তু হাতে গরম কেবাব আর ড্রিঙ্কস এর প্যাকেট। আচ্ছা, বাসে বরং উঠে পড়া যাক। বাস চলছে। আমি পাশের সিটে ব্যাগ, কেবাব রেখে আরাম করে বসে ভাবছি, ঠিক কীভাবে ড্রিঙ্কস নিয়ে ছবি তুলে ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করা যায়। আমি কি খেতে খেতে ছবি তুলবো নাকি ছবি তুলতে তুলতে খাবো? নাকি আদিগন্ত সমুদ্রের সামনে শুধু ড্রিঙ্কসের বোতলটার একাকী একটা ছবি তুলে পোস্ট করে দেবো। সবাই তখন এর মালিককে খুঁজে হয়রান হবে। আচ্ছা, আমি এত কিছু ভাবি কেনো? মাথাটাকে একটু বিশ্রাম দেওয়া উচিত; অন্তত কিছু সময়ের জন্য। আচ্ছা, টোবিয়াসকে আসতে বললেও তো ভালো করতাম। কিছু ছবি তুলে দিতো। অস্থির সময়টা কেমন করে সমুদ্রের পানিতে মিশে যাচ্ছে তার ছবি। আর খাদ্যের খোঁজে বালিয়াড়িতে উঠে আসা একটা কাঁকড়ার সাথে আমার দৌড় খেলার ভিডিও। মানে আমাকে দেখে সে পালাচ্ছে, আর আমি তার কাছে যেতে চাচ্ছি, এরকম কিছু। কোন চিত্রনাট্যের দরকার নেই।
একি! বাস কোথায় যাচ্ছে? সমুদ্রে যাওয়ার রাস্তা তো এটা না! আমার বাসার এলাকাটা অতিক্রম করে সিটি হল পেরোলেই বাস চলে আসে পোর্ট সিটিতে। মিনিট দশেক পর চলে আসে বাল্টিক সাগর। কিন্তু আমি তো যাচ্ছি বিশাল এক হাইওয়ে দিয়ে; কোথায় সিটি হল, আর কোথায় পোর্ট সিটি? ঘড়ি বলছে, কাঁটায় কাঁটায় ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিট আমি বাসে। এতক্ষণ আমি কী করলাম? পরের স্টপে বাস থেকে নামতে নামতে ঝটপট গুগল করে ফেললাম। এখন নেমে ঠিক উল্টা দিকে গেলেই পেয়ে যাবো সিটি হলে যাবার সরাসরি বাস। সেখান থেকে চলে যাবো আমার মন ভাল করার স্থান, বহুল প্রতীক্ষিত সমুদ্রসৈকতে! কিন্তু চাইলেই তো অপর পাশে চলে যাওয়া যায় না। দুপাশে লাল বাতি জ্বলবে, সব গাড়ি থামবে; তারপরেই না অপর পাশের বাসের নাগাল পাওয়া যাবে। মাঝে মধ্যে এতো গুছানো নিয়ম যেন ঠিক সহ্য হয় না। আমাকে অস্থির করে রেখে সবুজ বাতিটা অনেকক্ষণ জ্বলে থাকল। অপর পাশের সিটি হলে যাওয়ার বাসটা এক টানে স্ট্যান্ড ছেড়ে চলে গেলো। অপর পাশ থেকে দশ মিনিট হাঁটার আগে কোনো বাস, ট্রেন নাই। হাঁটা শুরু করলাম। কাঁধের ব্যাগটা হঠাৎ অস্বাভাবিক ভারি লাগছে।
আচ্ছা, আমার কেবাব বক্স কই? কেবাব বক্স চলে গেছে বাসে। সমস্যা নাই। কিন্তু দশ মিনিট হাঁটার পরও আমি বাস পাচ্ছি না; কারণ আমার ফোনের চার্জ নাই। ফলে গুগল আঙ্কেলও সাথে নাই। এখন যদি আলাদিনের জীন আংকেল এসে বলতো, “আপনি আপনার তিনটা ইচ্ছার কথা বলুন; আমি পূরণ করবো”, তাহলে আমি বলতাম “আমার একটা ইচ্ছা পূরণ করলেই চলবে। প্লিজ আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন। আমি হারিয়ে গেছি।” ছোটবেলায় একবার হারিয়ে যাওয়ার কথা আমার মনে আছে। গ্রামের বাজারে ঘুরতে গিয়ে একটা দোকানের সামনে আমি দাঁড়িয়ে পড়ি এবং হারিয়ে যাই। আমি যে হারিয়ে গেছি সেটা বুঝতে পেরে ভয় পাওয়ার ঠিক দুই মিনিটের মধ্যেই আমার দল আমাকে পেয়ে যায়। আই উইশ, আজকেও আমাকে কেউ খুঁজে পেয়ে ফেলতো।
হঠাৎ করে স্নো ফল শুরু হয়ে গেল। রাস্তায় এখন আমি সম্পূর্ণ হারানো অবস্থায় আছি। এখানে রাস্তায় মানুষ জন এমনিতেই খুব কম থাকে। আমাদের দেশে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে রাস্তায় বের হলে যেমন অল্প কজন মানুষ দেখা যায় এখানে সারা বছর সেরকম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। দিনের আলো নিভে যাওয়ার ঠিক একটু আগেই লাইট পোস্টের বাতিগুলি জালিয়ে দেয়া হয়। স্নো ফল, হলুদ বাতি, ফাঁকা রাস্তা — সব কিছুতে কেমন অস্বাভাবিক সুন্দর একটা কিছু হয়ে গেছে। আমার ভয়ের উপর সুন্দরের প্রলেপ পড়ে ঢেকে গেছে, কেমন একটা শূন্য শূন্য শান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছা করে এই শূন্য শান্তিটা তৈরি করেছে।
হাঁটতে হাঁটতে কি মনে করে বাম দিকে টার্ন নিলাম। কয়েকজন জটলা করে ছোট একটা পার্টির মত কিছু করছে। আরো দুই মিনিট হাঁটার পর দেখলাম সামনে শান্ত বিশাল এক সমুদ্র যার নীলাভ জলটা অস্তাচলগামী সূর্যের রক্তবর্ণ চ্ছটায় ঝলমল করছে। অনেক পথ পেরিয়ে তাহলে এক বর্ণিল সমুদ্রের কাছে আসা গেছে! হঠাৎ মনে হল আমার মন ভালো হয়ে গেছে।
লেখক পরিচিতি
মৌ দাশ ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ডেনমার্ক থেকে সম্প্রতি ইংলিশ স্টাডিজে মাস্টার্স শেষ করেছেন। বাংলাদেশে থাকতে ভারতীয় ভিসা এপ্লিকেশন সেন্টারে কাজ করেছেন। তার গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলায়। মৌ মূলত চিত্রশিল্পী। তবে সাহিত্য, দর্শন, চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত বিষয়েও তার আগ্রহ ও পড়াশোনা আছে। ইমেইলঃ moudas871@gmail.com