আধুনিক ইতালীয় সাহিত্যে যাঁর লেখা প্রথম দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরেও সমাদৃত হয়েছিল, সেই গ্যাব্রিয়েল দান্নুনৎসিও তাঁর কপোনচিনার বাড়িতে গ্র্যান্ড মোগলের মতো বাস করতেন। কুড়ি জন চাকর-বাকর, খান তিরিশ-চল্লিশ কুকুর, শ’দুই পায়রা থেকে শুরু করে দামি দামি সব আসবাবপত্র— সবই ছিল সেখানে। শিল্পী বন্ধুদের দিয়ে অদ্ভুত সুন্দর করে সাজিয়েছিলেন গোটা বাড়ি। বাড়ি তো নয়, প্রাসাদ। বাগান দেখাশোনা করার জন্যই ছিল চার-চার জন মালি।
প্রত্যেক দিন অডিকোলন ব্যবহার করতেন প্রায় এক পিন্ট করে। দিনের মধ্যে জামাকাপড় বদলাতেন প্রায় তিন-চার বার। আর একবার যে জামাকাপড় পরতেন, সেটা আর দ্বিতীয় বার পারতেন না। লেখার সময় কলম হিসেবে ব্যবহার করতেন পাখির পালক। না, মরা পাখির পালক তিনি ছুঁতেন না। তাই তাঁর জন্য জীবিত পাখির পালক আনা হত রোজ। তাও আবার দু’-চারখানা হলে চলবে না। অন্তত খানতিরিশেক তো চাই-ই।
প্রতিদিন সন্ধে নামলেই বন্ধুবান্ধবেরা এসে হাজির হতেন বাড়িতে। উনি তাঁদের নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন শহরের সব চেয়ে লাগজারি রেস্তোরাঁর উদ্দেশ্যে। সেখানে হইহই করে কাটাতেন। ফিরতেন সেই মধ্যরাতে।
বাপ-ঠাকুরদার কাছ রক্তের সূত্রে থেকে পাওয়া এই বিলাসবহুল জীবন যাপন করতে গিয়ে তাঁর আয়ের প্রায় দশ গুণ ব্যায় হয়ে যেত প্রতি মাসেই। কাজেই ধার ক্রমশ বাড়ছিল। কিন্তু সেটা বাড়তে বাড়তে যে তার পরিমাণ এমন বিশাল অঙ্কে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তিনি। যখন টের পেলেন, তখন সব কিছুই তাঁর নাগালের বাইরে চলে গেছে।
যাঁরা তাঁকে ধার দিয়েছিলেন তাঁরা টাকার জন্য চাপ দিতে লাগলেন। কেউ কেউ আইনেরও দ্বারস্থ হলেন। আর যেই তিনি বিপাকে পড়লেন, অমনি একে একে সব বন্ধুরা তাঁর পাশ থেকে সরে যেতে লাগলেন। একদম একা হয়ে গেলেন তিনি। আইনি লড়াইতেও হেরে গেলেন। ফলে উনিশশো এগারো সালের এপ্রিল মাসে কোর্টের লোকজনদের উপস্থিতিতে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি নিলাম হয়ে গেল। আদালত তাঁকে দেউলিয়া ঘোষণা করল।
তখন তাঁর অবস্থা খুবই খারাপ। চারিদিকে কেবল শত্রু আর শত্রু। টাকা-পয়সার অভাব তো আছেই, সঙ্গে আছে ইতালির ক্যাথলিক সমাজের কটাক্ষ, তাঁর রচনাবলির উপর অশ্লীল ধারণা। তাই কোন উপায় না দেখে পালিয়ে গেলেন ফ্রান্সে। এর কিছু দিন পরেই উনিশশো চোদ্দো সালে শুরু হয়ে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
গ্যাব্রিয়েল মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, যুদ্ধ সুপারম্যানকে আত্মবিকাশের সুযোগ করে দেয়। কাজেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেই যুদ্ধে। তাঁর কাজকর্মের জন্য সেনানায়ক এবং রাষ্ট্রপ্রধানদের নজরে পড়ে গেলেন তিনি। এর কিছু দিন পরেই ফ্রান্স সরকারের আবেদনে সাড়া দিয়ে, আরও বড় গুরুদায়িত্ব নিয়ে তিনি ইতালিতে ফিরে যান। সেখানে গিয়ে নানা ভাবে দেশের জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগলেন এবং তিনি তাতে সফলও হলেন। ফলে ইতালির সরকার প্রায় নিরুপায় হয়ে জার্মান ও অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে উনিশশো পনেরোর ছাব্বিশে মে যুদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হল।
প্রথমে না পেলেও, শেষ পর্যন্ত তিনি জোগাড় করতে পেরেছিলেন যুদ্ধে যাবার অনুমতি। গিয়েছিলেন প্রায় পঞ্চাশটিরও বেশি অভিযানে। এমনকী, তখনকার দিনেও প্লেনে চড়ে যুদ্ধ করতে তাঁর বুক তো কাঁপেইনি, বরং দুর্ঘটনায় একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেলে, ডাক্তারের নির্দেশ উপেক্ষা করেই আবার রওনা হয়েছিলেন যুদ্ধে। লড়েছিলেন প্রাণপণ।
এর পর একদিন যুদ্ধ শেষ হল। তিনি একটু থামলেন। কিন্তু যিনি কিছু একটা করার জন্য সারাক্ষণ ছটফট করছেন, তিনি কি চুপচাপ বসে থাকতে পারেন! তাই তিনি এ বার মেতে উঠলেন কিউম বন্দর নিয়ে।
যুদ্ধের আগে এটা ছিল অস্ট্রিয়া আর হাঙ্গেরির ভেতরে। পরে মিত্র সৈন্যের আওতায় চলে যায়।ফলে শুধুমাত্র কিউম বন্দরের জন্য মিত্রপক্ষরা তাদের ওপর অসন্তুষ্ট হোক এটা তাঁর দেশের সরকার চায়নি। সুতারাং এ ব্যাপারে তারা কোনও মাথাও ঘামাল না। কিন্তু গ্যাব্রিয়ালও ছাড়ার পাত্র নন। তিনি ঘুরেফিরে নানান ভাবে কিউমের উপরে ইতালির দাবি প্রচার করতে লাগলেন এবং আকস্মিক ভাবে উনিশশো উনিশ সালের বারোই সেপ্টেম্বর মাত্র তিনশো জন লোক নিয়ে তিনি হাঁটা শুরু করলেন কিউমের পথে। পথে আরও অনেক লোক তাঁর সঙ্গী হয়ে উঠল। মিত্র সৈন্যের বেশির ভাগই ছিল ইটালির লোক। কাজেই স্বদেশবাসীর উপরে তারা আর সে ভাবে অস্ত্র ধরতে পারল না। এই সুযোগে গ্যাব্রিয়েলের নেতৃত্বে কিউম অধিকার হল।
এটা একটা অভাবনীয় ঘটনা। এ রকম যে কিছু একটা ঘটতে পারে, তা কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। এমনকী, এ সংবাদ যখন ইতালির মাটিতে এসে পৌঁছল, তখন দেশের প্রধানমন্ত্রীও এ খবর বিশ্বাস করতে পারেননি।
এর পর ইংরেজ আর ফরাসি সৈন্যরা যখন কিউম ছেড়ে চলে যায়, তখন সেখানে গ্যাব্রিয়েলের একাধিপত্য সুদৃঢ় হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত নানান কারণে তিনি আর তা ধরে রাখতে পারেননি। তাঁর হাত থেকে চলে গিয়েছিল কিউম।
তাই অনেকেই বলেন, তাঁর এই বিচিত্র জীবন নাকি তাঁর সৃষ্টি করা বিভিন্ন চরিত্রের চেয়েও অনেক অনেঅ বেশি রোমাঞ্চকর এবং বিস্ময়কর।