নাটোরে সিংড়া উপজেলার চামারী ইউনিয়নের বিলদহরে মোতালেব হোসেন নামে এক ভূমিদস্যুর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন এলাকাবাসী। চামারী ইউনিয়নে যেখানেই জমি-দখল বা জমি নিয়ে ঝামেলা সেখানেই যার নামটি ঘুরে ফিরে জড়িয়ে আছে।
জমিদখল, ঠকবাজি, প্রতারণা ও মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ভূমি মালিকদের সর্বস্বান্ত করায় ভূমিদস্যু মোতালেব হোসেন এখন এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। একাধিক ভুক্তভোগী জেলা পুলিশসহ বিভিন্ন জায়গায় লিখিত অভিযোগ করেছেন।
তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা শতাধিক।নিরীহ জনগণ মোতালেব হোসেনের মত ভূমিদস্যুর কারণে জানমালের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।এলাকাবাসীর অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, এক সময় মোতালেব হোসেন ক্ষেতমজুরি করে কোনমতে জীবীকা নির্বাহ করতেন ।
পরবর্তীতে তার চাচা চামারী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন এবং ভাগিনা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি মনিরুল ইসলাম মনির ছত্রছায়ায় সরকারী রাস্তার গাছ কাটা, গরু চুরির টাকা ভাগাভাগি থেকে শুরু করে হাট বাজারের সরকারী জায়গা,
পানি উন্নয়ণ বোর্ডের জায়গা, মরা নদী, খালবিল থেকে শুরু করে করে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দখল করে জাল দলিল তৈরী করে বিক্রি করে অঢেল ধণসম্পদের মালিক বনে গেছেন। বাগিয়ে নিয়েছেন ৮ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ।
গড়ে তুলছেন নিজস্ব দখলদার বাহিনী। মতলববাজ এই ভূমিদস্যু এবারও ভোলপাল্টে অর্থ ছিটিয়ে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কতিপয় নেতাকর্মীদের সাথে গড়ে তুলেছেন বিশেষ সখ্যতা। এই হাইব্রিড নেতার দাপটে মাঠ পর্যায়ের আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা কোণঠাসা।
ক্ষমতার দাপটে বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে।ভূমিদস্যুতায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ায় মাঠপর্যায়ে চাপা ক্ষোভ রয়েছে বলে জানালেন, ক্ষুব্ধ তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। সম্প্রতি বিলদহর বাজার বেরিবাঁধ সংলগ্ন পানি উন্নয়ণ বোর্ডের অধিগ্রহণকৃত ১৬ শতাংশ জায়গা জাল দলিল তৈরী করে অর্ধকোটি টাকায় ১৭ জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেছেন।
ব্যবসায়ীরা ঘর তৈরী করতে গেলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বাঁধা দিলে বেরিয়ে আসে মোতালেব হোসেনের দখল এবং জাল দলিল তৈরী ও বিক্রির কথা। বিলদহর হাটের কাপড় ব্যবসায়ী জানান, একই কায়দায় বিলদহর হাটে ৫০ বছর ধরে কাপড় ব্যবসার সাথে জড়িত ২০ ব্যবসায়ীকে মারপিট করে চালাঘর ভেঙ্গে কাপড়হাটা দখল করে নেয়।
সরকারী জায়গা দখলের প্রতিবাদ করায় আজগর আলীকে কুপিয়ে আহত করে।এদের মধ্য আজগর আলিকে রক্তাক্ত জখম করে। তার কাছ থেকে ২ লক্ষ টাকা নিয়ে একটি পজিশন দেয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্ত অন্তত দশজন কাপড় ব্যবসায়ী জানান, ওই জায়গার পজিশন ক্রয় সূত্রে ৪০ বছর ধরে ব্যবসা করে আসছেন তারা।
মোতালেব বাহিনী মারপিট করে তাদেরকে তুলে দিয়ে সরকারী জায়গায় ১৪ টি দোকান দিয়ে মার্কেট নির্মাণ করে পজিশন আকারে বিক্রি করে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। তারা টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় তাদের পজিশন দেয়া হয়নি বলে জানান।
রফিকুল ইসলাম নামে এক ভুক্তভোগী জানান, এই ভূমিদস্যু মোতালেব এখন একটি নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। তিনি আদালতে বাঁটোয়ারা মামলা দায়ের করে ওই মামলায় তাদের কিছু নিজস্ব লোকের নাম ও জমির দাগ উল্লেখ করার পাশাপাশি যারা এলাকার নিরীহ লোক, তাদের জমির দাগও উল্লেখ করে।
ওই বাঁটোয়ারা মামলা দায়ের করে ওই নিরীহ লোকের জমিটি দখল করে নেয়। বাঁটোয়ারা মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হতে আদালতে পাঁচ-সাত বছর সময় লাগে। এই সুযোগে সে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দিলে সে জমির দখল ছাড়বে না।
থানায় এ ব্যাপারে অভিযোগ করলে তারা বলে, আদালতে মামলা চলছে, আমাদের কিছু করার নেই।এলাকাবাসীরা অভিযোগ করেন, বিলদহরের দুলুর মোড়ে খাস জায়গা দখল করেছে মোতালেব হোসেন।একমাস আগে ১৯৫০ দাগের ১নং খাস খতিয়ানের জায়গা শহিদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির কাছে এক মাস আগে ৬লাখ টাকায়বিক্রি করে দেয়।
যেখানে এখন দোকানঘর নির্মাণ চলছে। এছাড়া মরানদী দখল করে কলাবাগান করেছেন। গোটিয়া মহিষমারী নদী ভরাট করে কলা বাগান এবং গোটিয়া বিল দখল করে বর্ষার সময় অবৈধ সুতিজাল ও বানা দিয়ে মাছচাষ করছেন। ফলে, প্রতি বছর শত শত কৃষকের বিপুল পরিমাণ আমন ধান নষ্ট হচ্ছে।
এতো গেল সরকারী জায়গা দখলের কথা। অনেক নিরীহ মানুষের জায়গায় জবর দখল করে রেখেছেন। বিলদহরের হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ী দিলীপ কর্মকারের ১৩ শত জমি জোর করে দখল করে বিক্রি করে দিয়েছেন মোতালেব হোসেন। এ বিষয়ে আদালতে মামলা চলমান রয়েছে।
ডাঃ নুর-নরী ফারুক (তাঁরা) জানান, ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মোতালেব আমাদের বাসায় কৃষাণীর কাজ করতেন। তাঁর চাচা শাহাদাত হোসেন চেয়ারম্যান হওয়ার পর রাতারাতি সে আমার পৈত্রিক জায়গা জবর দখল করে বিক্রি করে দিয়েছে।
ভুক্তভোগি ডাক্তার মিনহাজুল মিনু জানান, ৩ বছর যাবৎ তার জমি ও পুকুর জবর দখল করে রেখেছে ভূমিদস্যু মোতালেব।চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারী তার জমির উপরে অনুমতি না নিয়েই ইটের ঘর নির্মাণ করা শুরু করে।
ঘর নির্মাণ কাজে বাধা দিলে মোতালেসহ ৪/৫ জন ভুক্তভোগি ও ভুক্তভোগির স্ত্রীর ওপর আক্রমণ করে এবং বাঁশের লাঠি, কাঠের বাটাম দিয়ে তার সমস্ত শরিরে জখম করে রক্তাক্ত করে দেয়। পরে ভুক্তভোগি অভিযোগ করার পর পুলিশ মোতালেবকে আটক করে।
অভিযোগে জানা যায়, জমি দখল করার পদ্ধতিটাও তার ভিন্ন। তিনি যে জমি দখল করতে ইচ্ছা পোষণ করেন, প্রথমেই সেখানে স্থানীয় প্রভাবশালী ও প্রশাসনের ছত্রছায়ায় রাতে ঘর তুলে ফেলেন। বাধা দিলে ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের মামলার হুমকি দেয়।
ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। এ জন্য যে মামলার প্রয়োজনীয় মালমসলা তার নিয়ন্ত্রণে আছে। বিলদহরের শুধু ডাঃ নান্নু, দিলীপ বা তাঁরা ডাক্তার নয়, অসংখ্য ভূমি মালিক মোতালেবের খপ্পরে পড়ে জমি বেদখল, মিথ্যা মামলা ও হয়রানীর শিকার হয়ে অর্থনৈতিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কেউ কেউ পথে বসেছেন।এই হাইব্রিড আওয়ামী লীগ নেতার অত্যাচার নির্যাতন ও হয়রানী থেকে মুক্তি পেতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং স্থানীয় সাংসদ ও মাননীয় আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক এমপির সুদৃষ্টি কামনা করেছেন ভুক্তভোগী অসহায় চামারী ইউনিয়নবাসী ।
অভিযোগ প্রসঙ্গে মোতালেব হোসেন বলেন, এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা, আমি জমি কেনাবেচার ব্যবসা করি। নিজের জমি বিক্রি করেছি, জমিতে ঘর তুলেছি, কারো জমি দখল করিনি। কাপড়হাটা দখল করে সরকারী জায়গায় মার্কেট নির্মাণ করার বিষয়টি আমার চাচা সাবেক চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন ভালো বলতে পারবেন।
চামারী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন বলেন, মোতালেব হোসেনের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি এ ধরণের লোকদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলি। যে কাজগুলো সে করছে তা মোটেও ভালো করছেনা। তার অপকর্মের দায়-দায়িত্ব দল নেবেনা।
চামারী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বর্তমান চেয়ারম্যান রশিদুল মৃধা বলেন, মোতালেব হোসেনের বিরুদ্ধে ভূমিদস্যুতার অনেক অভিযোগ রয়েছে। তার কর্মকান্ড দলের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে।দলীয়ভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মুঠোফোনে বলেন, তদন্ত করে সত্যতা মিলেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা মোতালেব বিক্রি করে দিয়েছে।মোতালেব বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানালেন তিনি।
সিংড়া থানার অফিসার ইনচার্জ ওসি নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, মতলেবের নামে গরু চুরি সহ, জায়গা দখল, মারপির অভিযোগ পেয়েছি, তার নামে একাধিক মামলা আছে। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দেওয়া হবে।
সিংড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সামিরুল ইসলাম বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা দখলের অভিযোগ পেয়েছি।সরকারি হাটের জায়গা দখল করার এখতিয়ার কারো নেই। তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ ব্যাপারে সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. অহিদুল হক জানান, মোতালেবের বিরুদ্ধে এত দুর্নীতির অভিযোগের কথা আমাদের জানা নেই। বিষয়গুলো তদন্তের জন্য ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হবে।
ইউনিয়ন আওয়ামী লীগে যদি তদন্ত প্রতিবেদন দিতে গড়িমসি অথবা গাফিলতি করে তাহলে উপজেলা পর্যায় থেকে তার বিষয়ে তদন্ত করে দলীয়ভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।