ঢেউ আসে আবার মিলিয়েও যায়, জীবনটাই তো জোয়ার-ভাটার খেলা
এমন একটা পৃথিবী কি তৈরি করা যায় না যেখানে নিজের মতো করেও সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকা যায়? কিন্তু কিভাবে? মানুষ কষ্ট পেলে আশ্রয় খোঁজে, সত্যিই কি জীবনে একজনকে প্রয়োজন যার কাছে কষ্ট বা মন খারাপগুলোকে তুলে ধরা যায়? মানুষ চায় এমন একজনকে যার সঙ্গে কষ্টগুলোকে ভাগ করা যায়। আর তখন সে আশ্রয় খোঁজে। এই আশ্রয়ের জায়গাটা সবাই কিন্তু পায় না। আর না পেলেই সে তার কষ্টগুলো মনে চেপে রাখে, এক সময় দেখা যায় সে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে।
আসলে প্রতিটি মানুষের একটা আশ্রয় দরকার। কেউ ঘরের মানুষের কাছে আশ্রয় চায়। কেউ বাইরের কারও কাছে আশ্রয় খোঁজে একটু ভালো থাকার জন্য। আবার এমনও হয় যে, আশ্রয় পায় ঠিকই, কিন্তু একসময় যে আশ্রয় দেয় সেই আশ্রয়দাতাই একদিন সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়। মানুষের জীবন যে বড্ড বিচিত্র। জীবনে সবচেয়ে সঠিক আশ্রয়দাতা হলো নিজে। মানুষ নিজেই তার সবচেয়ে বড় আশ্রয়। এর চেয়ে ভাল জায়গা আর কিছুতে নেই।
কষ্ট পেলে, যন্ত্রণা হলে একজন মানুষের মধ্যেই মানুষ শুধু আশ্রয় খোঁজে তাও নয়। কাজের মধ্যেও অনেকে আশ্রয় খোঁজে। যখন নিজের কাছে নিজেকে খুব একা লাগে, মনে হয় চারপাশে কেউ নেই, তখন অনেকে ডুবে যেতে চায় কাজের মধ্যেই। নিজেকে ব্যস্ত রাখে। তখন তার কাছে সেই কাজটাই আশ্রয় হয়ে ওঠে।
যারা অনেক অনেক দূরে থাকে বা একদম একা থাকে প্রতি মুহূর্তে তারা এ বিষয়টি উপলব্ধি করে। বিশেষ করে যারা পরিবার ছাড়া একা জীবনযাপন করে, যে কোনো পরিস্থিতিতে সে নিজেই নিজেকে সামলে রাখে। অসুস্থ হলেও সে নিজেই নিজেকে দেখে রাখে।
একটা ভুল ধারণা আছে কিছু মানুষের। অনেকেই ভাবেন যাদের কেউ নেই, তারাই শুধু একা। এমন অনেকে আছেন পরিবারের সঙ্গে থাকেন ঠিকই; কিন্তু ভেতরে-ভেতরে মানুষটা খুবই নিঃসঙ্গ। এই নিঃসঙ্গতাকে আশ্রয় করেই সে পথ চলে। বাইরে থেকে তাকে দেখে বোঝার উপায় থাকে না।
মানুষের জীবনটাই তো আসলে ঘাত আর প্রতিঘাতের খেলা, অনেকটা জোয়ার-ভাটার মতো। ঢেউ আসে, আবার তা মিলিয়ে যায়। অনেকে এই ঘাত-প্রতিঘাতের ঢেউয়ের মধ্যে তলিয়ে যায়, উঠে দাঁড়ানোর শক্তি থাকে না। মনোবল ভেঙে পড়ে, তখনই সে আশ্রয় খোঁজে। জীবনে কষ্ট ধারণ করার ক্ষমতা সবার এক না। কেউ কষ্টের পাথর বুকে চাপা দিয়ে জীবন পার করে দিতে পারে। এই যে কষ্ট বুকে লালন করে সবার কাছ থেকে আড়াল করে থাকা, এটাই তো তার কাছে তার আশ্রয়। নিজেকে নিজে আশ্রয় দেওয়া। এ যে তার পরম আশ্রয় স্থল, বড্ড নিরাপদ যে।
এমন অনেক মানুষ আছেন, যে অন্যকে প্রচণ্ড রকম উদ্বুদ্ধ করতে পারে, অন্যকে প্রচুর সাহস যোগাতে পারে; অন্যরা তার কাছে আসে একটু সাহস নিতে, একটু মনোবল বাড়াতে, একটু নতুন পথের সন্ধান পেতে; অথচ দেখা যায় সেই মানুষটিই ভেতরে-ভেতরে একা। এই যে একাকিত্বের সঙ্গে তার বসবাস, এতেই সে অভ্যস্ত হয়ে যায়। সে নিজেই নিজেকে এর মধ্যে বন্দী করে ফেলে। নিজের একটা পৃথিবী সে তৈরি করে, যা তার একান্ত আশ্রয়।
জীবনে চলার পথে অনেকেই আবার অন্যের ওপর নির্ভর করে, বিশ্বাস করে নিজের থেকেও বেশি অন্যকে, মনে হতে পারে সেই ব্যক্তিটিই তার একমাত্র পৃথিবী। কিন্তু হঠাৎ দেখা যায়, যাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছে এতোটা কাল, সেই তাকে সবচাইতে বেশি ঠকিয়েছে। সেটা মেনে নিতে তখন কতোটা কষ্ট হয় একবার ভাবুন তো। সবচেয়ে বেশি যে সমস্যাটা হয় এক্ষেত্রে তা হলো আর কোনোদিন কোনো পরিস্থিতিতেই অন্য কাউকে আর বিশ্বাস করা যায় না। ধাক্কাটা এসে লাগে প্রথম এই ‘বিশ্বাস’ নামক শব্দটির ওপর। জীবনটা তখন ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকে। পশ্চিমাকাশে ডুবন্ত সূর্যের মতো আলোটা মিলিয়ে যায় ধীরে ধীরে, অন্ধকার হাতছানি দেয়। তখন নিজেই হয়ে ওঠে নিজের আশ্রয়দাতা, এছাড়া আর যে কোনো উপায় থাকে না।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনও হয় যে প্রতিষ্ঠিত মানুষেরা জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে গিয়ে এত বেশি ত্যাগ করে, এত বেশি কষ্ট করে যে তখন তার এই প্রতিষ্ঠা তার নিজের কাছে তুচ্ছ মনে হয়। প্রতিষ্ঠিত মানুষটিও একসময় অনেকের ভিড়ে একা হয়ে যায়। কিন্তু কেউ তা বুঝতে পারে না। নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে রাখে। তাই একবার যে একা চলতে শিখে যায়, একাকীত্বকে বন্ধু বানিয়ে ফেলে তার আর কোনো সমস্যাই হয় না। এই একাকীত্ব নামক বন্ধুটিই তাকে আগলে রাখে পরম স্নেহে। তাই যে মানুষটি যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নেবে বলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন, অবহেলা পেতে পেতে নিজেকে শেষ করে দেবার কথা ভাবছিলেন, সেও এক সময় ঘুরে দাঁড়ায়। তার মৃত স্বপ্নগুলো অল্প অল্প করে জীবন্ত হতে থাকে। সে বেঁচে ওঠে নিজের কাছে নিজেই। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর সে নিজেকে নিজেই বলে দেয় একের পর এক। হ্যাঁ, সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে নিজের কাছে নিজেই, শুধুমাত্র নিজেকে আশ্রয় করেই।
(চলবে)