আগামী ২১ জুন অনুষ্ঠিতব্য প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে ফের অশান্ত হয়ে উঠেছে বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়ন।
নির্বাচনী প্রচারণা শেষে ফেরার পথে স্বতন্ত্র প্রার্থীর গাড়িবহরে হামলা চালিয়ে দুটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় বিক্ষোভ প্রদর্শনসহ প্রতিদ্বন্দ্বী দুই গ্রুপ মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ায় জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে।
এরফলে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা এবং অনিশ্চয়তা। চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে সাধারণ ভোটাররা। প্রার্থীরা সংযত না হলে নির্বাচন বন্ধ করে দেয়ার হুশিয়ারি দিয়েছে প্রশাসন।
বরিশাল জেলার এক সময়ের সর্বহারা অধ্যুষিত আতঙ্কের জনপদ হিসেবে পরিচিত বাবুগঞ্জ উপজেলার আগরপুর ইউনিয়নের নাম পরিবর্তন করে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নামানুসারে জাহাঙ্গীরনগর করা হলেও এখনো নির্বাচন আসলে সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক দেখা দেয়।
জনমনে এই আতঙ্কের কারণ হচ্ছে নির্বাচন এলেই আগরপুর তথা জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নে অস্থানীয় ও অপরিচিত অস্ত্রধারী লোকজনের আনাগোনা এবং মহড়া দেখা যায়। শুরু হয় নির্বাচন কেন্দ্রিক বিভিন্ন সহিংসতা।
এবারের আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। গত ১০ জুন রাত সাড়ে ৮ টার দিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান হিমু খানের গাড়িবহরে হামলা চালায় প্রতিপক্ষরা। নির্বাচনী প্রচারণা শেষে ফেরার পথে শিলনদিয়া বাজারের অদূরে মেইন রোডে তার পেছনে থাকা দুটি মোটরসাইকেল টেনে ধরে আটকে রাখে প্রতিপক্ষের আওয়ামী লীগ প্রার্থীর অনুসারীরা।
এসময় তারা ওই দুই মোটরসাইকেলে থাকা ৪ নেতাকর্মীকে মারপিট করে মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে অভিযোগ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান হিমু খান।
ওই অগ্নিসংযোগে একটি পালসার ও একটি প্লাটিনা মোটরসাইকেল সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হওয়ার পরে ঘটনাস্থলে যায় আগরপুর তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ।
তবে এ ঘটনায় পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি।
এদিকে ওই হামলার ঘটনার প্রতিবাদে পরদিন বিক্ষোভ মিছিল করে স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান হিমু খানের অনুসারীরা। এ ঘটনার বিচার চেয়ে সমাবেশ করে তারা।
মোটরসাইকেল পোড়ানোর ঘটনায় ৩৩ জনকে অভিযুক্ত করে বাবুগঞ্জ থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়।
তবে পুলিশ সেটাকে মামলা হিসেবে গ্রহন না করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান হিমু খান।
তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমি আনারস মার্কায় ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পাবো। সেটা বুঝতে পেরেই মানুষ যাতে ভোটকেন্দ্রে না যায় সেজন্য জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে আমার কর্মীদের মারপিট করে দুটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাকে অবরুদ্ধ করে প্রচারণা ও গণসংযোগে বাঁধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। আমি প্রশাসনের কাছে ন্যায়বিচার চাই এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানাই।’
এদিকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সরদার তারিকুল ইসলাম তারেক সাংবাদিকদের বলেন, ‘কাউকে বাঁধা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। হিমু খানের লোকজন বরং আমার নির্বাচনী প্রচারণার দুটি মাইক ভাংচুর করে একটি মেশিন নিয়ে গেছে। আমার নৌকা মার্কার কর্মী-সমর্থকরা কেউ ওদের মতো সন্ত্রাসী নয়।’
বাবুগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহবুবুর রহমান জানান, শিলনদিয়া বাজার এলাকায় নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনায় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কাছ থেকে পাল্টাপাল্টি দুটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেগুলো তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জাহাঙ্গীরনগরে সহিংসতামুক্ত সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পুলিশ বদ্ধ পরিকর।
তবে কিছুতেই যেন আশ্বস্ত হতে পারছে না জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ। নির্বাচনকে ঘিরে তাদের মধ্যে সীমাহীন উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ ভোটার আইয়ুব আলী বলেন, ‘বিগত ৩ নির্বাচনে কেন্দ্রে যাইয়াও নিজের পছন্দের প্রার্থীকে কখনো ভোট দিতে পারি নাই। একবার গিয়ে শুনি আমার ভোট আগেই দেওয়া হইয়া গেছে। পরের দুইবারে ব্যালট পেপার দেখাইয়া ভোট দেওয়া লাগছে। পোলাপান দাঁড়াইয়া ছিল পাহারায় যাতে অন্য মার্কায় ভোট না দেই। এবার নাকি মেশিনে ভোট হইবে। শুনতেছি এবারও নাকি দেখাইয়া ভোট দেওয়া লাগবে।’
কৃষক আইয়ুব আলীর মতোই অভিন্ন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের ভোটার জসিম উদ্দিন, রণবীর মিয়া ও ফাতেমা বেগমসহ অনেকেই।
এদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনার পর সোমবার পর্যন্ত ঘটনাস্থল এবং জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
নির্বাচনী সহিংসতা বন্ধ করতে প্রতিদ্বন্দ্বী উভয় প্রার্থীকে ডেকে সতর্ক করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। প্রার্থীরা সংযত না হলে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নে নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার হুশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চাই। কিন্তু প্রার্থীরা যদি তা না চান এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে নির্বাচনের পরিবেশ ব্যাহত করেন তবে ভোট স্থগিত করতে বাধ্য হবে নির্বাচন কমিশন।’
নির্বাচন প্রসঙ্গে বাবুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট আমীনুল ইসলাম বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি রয়েছে। প্রথম ধাপে বাবুগঞ্জের ৪ ইউনিয়নের মধ্যে শুধুমাত্র জাহাঙ্গীরনগরে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহন করা হবে। তাই সেখানে আমাদের বাড়তি নজরদারি থাকবে। তাছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রসহ সকল ভোটকেন্দ্রেই ভোটাররা যাতে নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারেন সেলক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে মোবাইল টিম মাঠে থাকবে। নির্বাচনে কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা কিংবা অরাজকতা সহ্য করা হবে না।’