ব্যাঙ্ক থেকে এডুকেশন লোন নিয়ে যারা পড়াশোনা করেছে, অথচ এখনও সরকারি বা বেসরকারি কোনও চাকরিই পায়নি, রেশন থেকে বিনে পয়সায় চাল-গম পাচ্ছে বলে কোনও রকমে বেঁচেবর্তে আছে, ব্যাঙ্ক এখন এই লকডাউনের মধ্যেই তাদের ওপর চাপ দিচ্ছে যে ভাবে হোক ব্যাঙ্ক লোন শোধ করার জন্য। একবারে না পারলেও ভাগে ভাগে শোধ করুন। যারা পারছেন না, তাদের বাড়িতে মাসল ম্যান পাঠিয়ে দিচ্ছে। উকিলের চিঠি ধরাচ্ছে।
কিন্তু কথা হচ্ছে, যাদের এক বেলা খাবার জোগাড় করতেই জীবন ওষ্ঠাগত, তারা ব্যাঙ্ক লোনের কিস্তি মেটাবেন কী করে? আবার কিস্তি মেটাতে না পারলে সেই টাকার ওপরে সুদ জমে জমে টাকার অঙ্কটা পাহাড় প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে।
ক’দিন আগে আমার এক বন্ধু এসেছিলেন আমার কাছে। তাঁর ছেলে আমার ছেলের সহপাঠী। প্রায় ৯ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা খরচা করে তিনি ছেলেকে পড়িয়েছেন।
লোন নিয়েছিলেন চার লাখ টাকা। যেহেতু তাঁর রোজগার কম, তাই পড়া চলাকালীন ওই চার বছরের সুদ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। তাঁর ছেলে পাশ করে বেরিয়ে আসতেই ওই চার লাখ টাকা বাড়তে বাড়তে সুদ-সহ সেটা এখন ৫ লাখ ৩১ হাজার ৬৭৯ টাকা হয়ে গেছে।
ব্যাঙ্ক থেকে বহুবার ফোন করেছে। তিনি বারবার জানিয়েছেন, আমার ছেলের এখনও চাকরি হয়নি এবং এই লকডাউনের জেরে আমার চাকরিও চলে গেছে। তবু ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ তাঁর কথায় কোনও কর্ণপাত করেনি। উলটে বলেছে, আপনি দেরি করলে কিন্তু আপনার ছেলের সিবিল খারাপ হয়ে যাবে। শুধু তাইই নয়, ক’দিন আগে উকিলের চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছে। লিখেছে সত্বর দেখা করার জন্য।
সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম। আমার সেই বন্ধুকে ব্যাঙ্ক এমন ভাবে চাপ দিয়েছে যে, আমার সামনেই উনি সেই ব্যাঙ্ক কর্মীকে বলেছেন— আচ্ছা, লোন নেওয়ার সময় তো এই ব্যাঙ্কে আমাকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়েছিল। অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আমার একটা জীবন বীমাও করে দেওয়া হয়েছিল। প্রতি বছর একশো টাকা করে কাটে। আমার মৃত্যু হলে তো দু’লক্ষ টাকা পাওয়ার কথা। আচ্ছা, আমি যদি কাল মারা যাই, তা হলে কি ওই দু’লক্ষ টাকা এই টাকা থেকে মাইনাস হয়ে যাবে?
ওই ব্যাঙ্ক কর্মী বলেছিলেন, এমনি মরলে হবে না। একমাত্র অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলেই ওই টাকা পাওয়া যায়।
ফেরার সময় আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে আমার সেই বন্ধু স্বগতোক্তির মতো বিড়বিড় করে বলছিলেন, গলায় দড়ি দিয়ে কিংবা বিষ খেয়ে মরলে তো টাকা পাওয়া যাবে না! এখন বাস চলছে না। ট্রেনও চলছে না। না হলে তার সামনে ঝাঁপ দিতে পারতাম! লোকে ভাবত, অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। কী যে করি।
এই রাজ্যে কেউ বিষাক্ত মদ খেয়ে মারা গেলেও তাঁর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় দু’লক্ষ টাকা। সমাজের প্রতি যে ক্লাবগুলোর কোনও দায়বদ্ধতা নেই, তাদেরও দেওয়া হয় ৫০ হাজার করে। ইয়াসের দাপটে যাঁদের বাড়ি থেকে গাছের একটি পাতাও উড়ে যায়নি, শুধুমাত্র যোগাযোগের খাতিরে তাঁরাও পেয়ে যাচ্ছেন দু’লাখ, তিন লাখ, চার লাখ।
অথচ এক একটা তরুণ ছেলেমেয়ে দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে এডুকেশন লোন নিয়ে যারা পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছে, দুর্ধর্ষ সব রেজাল্ট করেছে, এই সরকার তাদের কোনও সরকারি চাকরি দিতে তো পারেইনি, বেসরকারি সংস্থাকে এনেও এ রাজ্যে কোনও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেনি।
অত্যন্ত ভাল রেজাল্ট করা সত্ত্বেও ছেলেমেয়েগুলো চাকরি পায়নি মানে এটা কিন্তু তাদের অপদার্থতা নয়, সরকারেরও ব্যর্থতা।
ফলে যারা পাঁচ বছর বা তারও বেশি আগে থেকে পাশ করে বসে আছে, কোথাও কোনও চাকরি পায়নি, পাশাপাশি যাদের অভিভাবকদেরও কোনও রোজগার নেই, লোন পরিশোধ করা বা কিস্তি দেওয়ার বিন্দুমাত্র সামর্থ্যও যাদের নেই, এই সরকার কি তাদের একটা তালিকা তৈরি করে সেই সব এডুকেশন লোন মুকুব করার জন্য অর্থ বরাদ্দ করতে পারেন না?