প্রাক কথন:
দেশের সীমানা টোপকে ভিন দেশে চলে যাওয়ার ঘটনা ইতিহাসে নোতুন কিছু নয়। প্রাণ বাঁচাতে বহু মানুষকে অন্য দেশে আশ্রয় খুঁজে নিতে হয়েছে। নেপথ্যে লুকিয়ে আছে বহু কারণ। ক্ষমতা দখলের রাজনীতি, ধর্মীয় উন্মাদনা এবং আরও অনেক বিষয়। যেমন যুদ্ধ বিগ্রহ। যুদ্ধে বিজয়ী মানুষের পাশে বিজিত ঠাই পায় নি। পরাজিত মানুষ যুদ্ধবন্দী, কখনও বা বিধর্মী। অতএব চলে যেতে হবে অধিকৃত দেশের সীমানার ওপার। অলঙ্ঘ আদেশ। অমান্য মানেই কামান গোলা বন্দুক ফৌজি বেয়নেট। এফোঁড়ওফোঁড় হবে বিধর্মী বা বিজিতের দেহ।
সীমানার ওপারে অর্থাৎ অন্য দেশে পা-রাখা মানুষগুলো রিফুউজি। উদ্বাস্তু। সব খোয়ানো মানুষের দল। ভিন দেশে বিরুদ্ধ পরিবেশে প্রাণ বাঁচানোর কঠিন লড়াইয়ে জর্জরিত প্রাণ। সামান্য খাদ্য আর আত্মপরিচয় খুঁজে নেবার দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে মনুষ্যতর জীবন যাপনে বাধ্য তারা।
ইতিহাসে তেমনি ঘটেছে বারবার। সাত দশক আগে পাকিস্তান থেকে ভারতে পালিয়ে এসেছে কোটি কোটি মানুষ। ইরাকে আমেরিকার বোমা বর্ষণ বাস্তুচ্যুত করেছে কোটি কোটি মানুষকে। কিছু মানুষ আশ্রয় পেয়েছে গ্রীস বা তুরস্কে।
বর্তমান এই দশকে সিরিয়া থেকে উৎখাত মানুষের সংখ্যা ষাট লক্ষেরও বেশী। আফগানিস্থান, সুদান থেকেও পঞ্চাশ লক্ষ লোক বিতাড়িত হয়েছে। উদ্বাস্তু নামের ঘৃণার তকমা নিয়ে আজও দাঁতে দাঁত চেপে পৃথিবীর বহু দেশে আশ্রয় পাওয়া মানুষগুলো প্রাণ বাঁচানোর সংগ্রাম করছেন। আশ্রয়ের প্রত্যাশায় এক দেশ থেকে গলা ধাক্কা খেয়ে ডিঙি নৌকায় সমুদ্র পারি দিয়ে পা রাখবার চেষ্টা করছেন ভিন দেশের মাটিতে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও – ইউনাইটেড নেশন্স, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন ইত্যাদি গঠন হলেও উদ্বাস্তু সমস্যায় এখনও জর্জরিত অধুনা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। উদ্বাস্তু সমস্যার বিষয়টি মূলত রাজনৈতিক বা ধর্মীয়। সমস্যা কণ্টকিত এবং বহু ব্যাপ্ত এক আন্তর্জাতিক মানবীয় সঙ্কট। অবশ্য এ সব প্রসঙ্গ বর্তমান নিবন্ধের অন্তর্গত নয়।
অধুনা বিশ্বের নোতুন সমস্যা:
বর্তমান নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় বর্তমান পৃথিবীর এক অন্য ধরনের উদ্বাস্তু কাহিনী। ধর্মের নিরিখে, রাজনীতি বা যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে সৃষ্ট নয়। সৃষ্টি আবহাওয়া বা জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে।
‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’, ইংরাজিতে ‘ক্লাইমেট রিফিউজি’ বর্তমান বিশ্বে ক্রমবর্ধমান এবং বেশ জটিল এক সমস্যা। আন্তর্জাতিক এই সমস্যাটি হাল আমলের হলেও এর ব্যাপকতা বহু বিস্তৃত। আন্তর্জাতিক রেডক্রস ফেডারেশনের সমীক্ষা অনুযায়ী, বর্তমান দুনিয়ায় জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা কয়েক কোটি।
উদ্বাস্তু কারা? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ (1951 Geneva Refugee Convention ) বলল, ‘নিজের দেশের বাইরে স্থান পাওয়া একজন মানুষ যার স্বদেশে ফিরলে জাতি ধর্ম রাজনীতি বা মতাদর্শের কারণে প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে’।
এই যুক্তি অনুযায়ী আবহাওয়ার কারণে বাস্তুচ্যুতদের উদ্বাস্তু বলতে নারাজ অনেকে। কারণ, আবহাওয়া উদ্বাস্তুদের দেশে ফিরলে শাস্তির মুখে পড়তে হয় না। কিন্তু এখানেই এক গভীর সংকট। দেশে ফিরতে পারাটাই যে সমস্যা! এক রকম আসম্ভব। দেশটাই যে বসবাসের অনুপযুক্ত। কোথাও দেশের মানচিত্র গ্রাস করেছে মরুভূমি, কোথাও আবার তলিয়ে গেছে জলের তলায়। অতএব, মানুষ নিজ ভূমি থেকে বিতারিত।
কম নয় এই আবহাওয়া উদ্বাস্তুর সংখ্যা। বর্তমান বিশ্বে প্রায় পাঁচ কোটী। প্রতি বছর– 2008 সাল থেকে 2017 অবধি — দুই কোটি পনের লক্ষ মানুষ আবহাওয়া বদল হেতু দেশ ছারতে বাধ্য হয়েছেন। বছরে বছরে লাফ দিয়ে সংখ্যাটা বেড়ে চলেছে। বিশ্বব্যাপী ঘটেছে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন। কোথাও সামুদ্রিক ঝড়, জলোচ্ছ্বাস। কোথাও খরা, নিদারুন জলাভাবে চাষবাস বন্ধ। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, হিউস্টোন বা ফ্লোরিডার হঠাৎ বিধ্বংসী ঝড় বাস্তুচ্যুত করেছিল বহু মানুষকে
কোথাও ধ্বংস নেমে আসছে ধীর গতিতে। ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে সমুদ্র তীরের গ্রাম শহর নগর। গোটা একটা দেশ ঢুকে যাচ্ছে সমুদ্রের জঠরে। কখনও বাস্তুচ্যুত মানুষের প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ বা সরকারী বদান্যতায় আশ্রয় মিলছে। কিন্তু রুটিরুজির সংস্থান বিহীন বড় কষ্টের সে জীবন! কোথাও মানুষ সরকারী সাহায্য বিনা যেথায় যেমন সুযোগ পাচ্ছেন, চলে যাচ্ছেন। নোতুন এক হিসাব মতে, সমুদ্রতল (sea surface) উঁচু হয়ে যাবার কারণে 2100 সালের মধ্যে কুড়ি কোটি মানুষ গৃহ হারা হবেন ভারত ও বংলা দেশে।
এই স্থানান্তরিত মানুষদের রিফুজি ছাড়া আর কী বলতে পারি’? এমন প্রশ তুলেছেন বহু বিজ্ঞানী ও সমাজকর্মী। এরা জলবায়ু রিফুজি না স্থানান্তরিত মানুষ? বিতর্ক বহমান।
যেমনি হোক আইনি সংজ্ঞা, জলবায়ু উদ্বাস্তুরা ঘর ছাড়া মানুষ। ভিটেমাটি খুইয়েছেন। নিজের গ্রাম, নিজের বেড়ে ওঠা শহর ছারতে বাধ্য হয়েছেন। যে শহরে লেখা পড়া শিখেছেন, ভোট দান করে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করেছেন তারা, সেই শহরটার অস্তিত্বই নেই। কোথাও বা স্বদেশ ছেড়ে ভিন্ন দেশের অজানা পরিবেশে প্রাণ বাঁচানোর লড়াই করছেন এই উদ্বাস্তুরা।
বিশ্ব উষ্ণায়ণ
ভয়ঙ্কর ঝড়ে তছনছ হয়ে যাওয়া গ্রাম শহর, একটা গোটা দেশের ক্রমশ জলের নিচে তলিয়ে যাওয়া, এসবই বর্তমান বিশ্বের নিত্যকার ঘটনা। কারণ, বিশ্ব উষ্ণায়ন। বহু আলোচিত এবং মহা উদ্বেগের বিশ্বব্যাপী চর্চিত এক বিষয়।
বিশ্ব উষ্ণায়ন ব্যাপারটি কতটা মারাত্মক বোঝাতে কয়েক বছর আগের (2009) মালদিভ রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের একটা কথাই যথেষ্ট। মালদ্বীপ সমুদ্র গর্ভে ক্রম বিলিয়মান। দ্বীপ রাষ্ট্র তার 1200 দ্বীপ, সারে তিন লক্ষ অধিবাসী, দীর্ঘ কালের গড়ে ওঠা সভ্যতা সব নিয়ে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে সমুদ্র গর্ভে। শঙ্কিত দ্বীপ রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিশ্ববাসীকে বলছেন (Copenhagen Climate Summit in 2009), ‘যদি উষ্ণায়ন আর দুই ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বাড়তে দাও, তাহলে জানবে, তোমরা আমাদের হত্যা করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছ’।
তেমনি অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন বিশ্ব মানচিত্রের মাঝামাঝি জায়গায় স্থিত অনেকগুলি দেশের রাষ্ট্র প্রধান। টুভালু, কিরিবাটি, ফুজি – প্রশান্ত মহাসাগরের এই সব দ্বীপ বিশ্ব উষ্ণায়নের দাপটে ডুবে যাচ্ছে ক্রমশ। এই অঞ্চলে সমুদ্রের জলতল উঁচু হয়েছে বিশ্বের গড় উচ্চতার দ্বিগুণ। প্রবল শংকটের মুখে সেখানে মানুষের অস্তিত্ব। ‘দেশের সংস্কৃতি, মানুষের ঘরবাড়ি, আমাদের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ আমরা সমুদ্র গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছি’। বিশ্ববাসীকে এ কথা জানিয়ে (বন ক্লাইমেট সামিট 2017) সাহায্য প্রার্থনা করেছেন কিরিবাটির পূর্বতন রাষ্ট্রপ্রধান অ্যানোতে তং (Anote Tong)। দু’হাজার কিলোমিটার দূরে অন্য দেশে (ফিজিতে) জায়গা কিনে দেশের লোককে বাঁচানোর প্রয়াস নিয়েছেন অ্যানোতে তং।
কেন এমনটা ঘটল? কেন বিশ্ব মানচিত্রের স্থলে জলে বন তলে, সব খানেই আবহাওয়া বদল হেতু ত্রাহি ত্রাহি আর্তনাদ? এ সবের মূল কারণ পৃথিবী গ্রহের বর্ধিত উষ্ণতা। দীর্ঘ দিন ধরে একটু একটু করে গরম হয়ে উঠেছে পৃথিবী। আধুনিক জীবন যাত্রার চাহিদা মেটাতে জ্বালানী দহন করে করে ক্রমাগত তাপ শক্তি নিঃসরণ করেছে মানুষ। নিঃসৃত তাপে উত্তপ্ত হয়েছে বায়ুমণ্ডল।
আরেকটু গভীরে গিয়ে বলতে হয়, ভোগ্যপন্য উৎপাদন করতে দরকার হয়েছে তাপ শক্তি। কোথা থেকে এসেছে? জ্বালানি পুড়িয়ে। জ্বালানী আদতে রাসায়নিক শক্তি। প্রাকৃতিক জ্বালানী কয়লা, তার দহনে রাসায়নিক শক্তি রূপান্তরিত হয়েছে তাপ শক্তিতে (Thermal power)। একে কাজে লাগিয়ে তৈরি হয় বিদ্যুৎ ( Thermal power)। বিদ্যুৎ বিনা জীবন অচল। বাড়ি ঘরে পথে প্রান্তরে বিজলি বাতি প্রয়োজন। বাড়িতে দরকার ফ্রিজ এয়ার কন্ডিশন ওয়াশিং মেশিন। এ সবের ব্যবহার বাড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবী গ্রহের উষ্ণতা।
শুরু বহু কাল আগে। শিল্প বিপ্লবের সময় (1760-1820) থেকে। কলকারখানায় লোহা ও অন্য ধাতু গলিয়ে গাড়ি রেল জাহাজ তৈরি হতে লাগলো। অগ্রগতির খিদে মেটাতে শক্তি যোগান দিল প্রাকৃতিক জ্বালানী (Fuel) — কাঠ তেল কয়লা। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর 40 শতাংশ বিদ্যুৎ তৈরি হয় কয়লা পুড়িয়ে। আর পেট্রল দহন করে সংগ্রহ হয় 38 শতাংশ শক্তি। যত বেশী পুড়েছে প্রাকৃতিক জ্বালানি, ততই বৃদ্ধি পেয়েছে বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড এবং চারপাশের উষ্ণতা।
উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে পৃথিবী গ্রহটাই ধ্বংসের মুখে। টিকবে বড় জোর আর এক শতাব্দী। কারণ যে হারে বাড়ছে কার্বন ডাই অক্সাইড তাতে বর্তমান শতাব্দীর শেষে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা 2.5-5 ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। ভয়ঙ্কর কথা! তাপমাত্রা 2 ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়লেই তো মৃত্যু ঘণ্টা বেজে যাবে পৃথিবীর। উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রতল উঁচু করে দেবে 230 ফুট। এর পরিণাম? জলের নিচে তলিয়ে যাবে বহু দেশ।
শুরু হয়ে গেছে বহু গ্রাম শহর দেশের অবলুপ্তি। বস্তুচ্যুত হয়ে মাথা গোঁজার আশ্রয় খুঁজছেন অসংখ্য মানুষ।
সমস্যার গভীরে:
আমরা আগে থেকে কেন সাবধান হতে পারিনি? যথার্থ প্রশ্ন। বিশ্ব-উষ্ণায়নের পরিণাম ও কারণ বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছিলেন বহু আগে। দুই সুইডিশ বিজ্ঞানী জন টিন্ডাল (1820-1893) এবং স্যাভান্তে আরহেনিয়াস (1859-1927) [নোবেল পান 1903 সালে], বহু প্রমাণ হাতে নিয়ে মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘বাতাসে অধিক পরিমান কার্বন ডাই অক্সাইডের উপস্থিতি ভবিষ্যতে পৃথিবীর ভয়ংকর বিপদ ঘটাবে। কারণ, এই গ্যাসটিই বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে (Greenhouse effect)’।
বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে নিজের খাদ্য বানায় (Photosynthesis) গাছ আর বাতাসে মুক্ত করে অক্সিজেন। বায়ু মণ্ডল শুদ্ধ করবার প্রাকৃতিক সম্পদ বৃক্ষ। এ তথ্য জেনেও দুনিয়া ব্যাপী নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করেছে মানুষ। গাছ কাটার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে তেল কয়লা ইত্যাদি জীবাশ্ম জ্বালানীর দহন। তৈরি হয়েছে কার্বন ডাই অক্সাইড। সব মিলিয়ে বায়ু মণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসটির আধিক্য বেড়েছে বহু গুণ। বায়ু মণ্ডলে এই গ্যাসটির আধিক্যই বাড়িয়ে দিয়েছে পৃথিবী গ্রহের তাপমাত্র। এতটাই বৃদ্ধি হয়েছে যে এর উপস্থিতি বিপদ সীমা অতিক্রম করে সর্বনাশের ডঙ্কা বাজাচ্ছে।
ছোট্ট একটা গ্যাস কার্বন ডাই অক্সাইড। কোন কৌশলে এটি বায়ুমণ্ডল বা সমুদ্রতলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়? কারণ গ্যাসটি তাপ শোষণ করে রাখে। কেমন করে? একশ আঠান্ন বছর আগে পদার্থবিদ জন টিন্ডাল বহু প্রমাণ হাতে নিয়ে প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছিলেন। তিনটে মাত্র পরমানু — একটা কার্বন এবং দু’টো অক্সিজেন — এ দিয়ে তৈরি রাসায়নিক যৌগ কার্বন ডাই অক্সাইড। গ্যাসটি শুষে নেয় অবলোহিত (infrared light) আলো।
সূর্যের সাত রঙের বর্ণালীতে দীর্ঘতম তরঙ্গ দৈর্ঘ লাল আলোর। কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নেয় লাল আলো এবং এর চাইতে বেশী তরঙ্গ দৈর্ঘের আলো। ফলে বাতাস উত্তপ্ত হয়। উত্তাপ ঊর্ধ্বাকাশে না গিয়ে মাটিতে ফিরে আসে। এরই নাম গ্রিন হাউস এফেক্ট (Greenhouse effect)। গ্রিন হাউস গ্যাস বহু সদস্য বিশিষ্ট। এই পরিবারে আছে কার্বন ডাই অক্সাইড, জলীয় বাস্প, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ওজন। এরা ভূপৃষ্ঠে তাপ ফিরিয়ে আনে। তবে এ কাজে সবচাইতে বেশি ক্ষমতা কার্বন ডাই অক্সাইড ও জলীয় বাস্পের।
উষ্ণায়নের রহস্য উদ্ঘাটন করেছিলেন বিজ্ঞানি আরহেনিয়াস। বাতাস দু’ভাবে তাপ ধরে রাখে। বাতাসের মধ্য দিয়ে তাপ প্রবাহিত হবার সময় (selective diffusion) এবং তাপ শোষণের (absorption) মাধ্যমে। বাতাসের অন্য উপাদান গুলোয়, দ্বি-পারমানিক নাইট্রোজেন অক্সিজেন—তাপের প্রভাবে কম্পন (vibration) ঘটে (দুই পরমানুর মধ্যেকার কম্পন)। ফলে প্রচুর পরিমান তাপ শোষণ করতে পারে তারা। কিন্তু বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড এবং জলীয় বাস্প শোষণ প্রক্রিয়ার (absorption) মাধ্যমে তাপ গ্রহণ করে। এদের (CO2, H2O) পরমাণু গুলো কাঁপতে থাকে বর্ণালির অবলোহিত (Heat, Infrared) অঞ্চলে। কাঁপতে থাকা থাকা একটি অনু তাপ মোচন (Emission) করলে আরেকটি অনু সেটি গ্রহণ করে কাঁপতে থাকে (vibrate)। এই প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ তাপ শোষণ–মোচন-শোষণ (Absorption-emission-absorption) করে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং জলীয় বাস্প পৃথিবী তলে তাপ ধরে রাখে।
টিন্ডালেরর আবিষ্কারের ছত্রিশ বছর পর আরহেনিয়াস, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের উষ্ণতা সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা করে প্রমাণ করলেন যে, জ্বালানী দহনে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস কারখানা থেকে নির্গত হচ্ছে। নির্গত গ্যাস ঊর্ধ্বাকাশে না গিয়ে জমা থাকছে বায়ু মণ্ডলে। এর ফলে গ্রহের উষ্ণতা বাড়ছে। তিনি বলছেন, 1896 সালে কার্বন ডাই অক্সাইডের যা পরিমাণ, ভবিষ্যতে সেটা বেড়ে দ্বিগুণ হলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়বে 6 ডিগ্রী সেলসিয়াস।
এখনকার গবেষণার তথ্য প্রায় তাই। ভয়ংকর তথ্য। এখন উপায়? এ প্রসঙ্গে পরে আসছি।
ভারত ও সংলগ্ন ভূখণ্ডের অবস্থা:
শুধু টুভালু, কিরিবাটি, ফুজি নয়। বার্বাডোস মেক্সিকো মিশর ইন্দনেশিয়া সর্বত্রই ডুবছে নগর সভ্যতা। ভারত বাংলাদেশ দারুণ রকম ক্ষতিগ্রস্ত। সমুদ্র তীরবর্তী এবং পদ্মা নদীর তিরে বাংলা দেশের বিস্তৃত ভূভাগ জলের তলায়। ভারতবর্ষের সামগ্রিক চিত্রও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। পূর্বভারতের এই প্রদেশে, আমাদের ঘাড়ের উপর শ্বাস ফেলছে বিশ্ব উষ্ণায়নের মারণ দানব। এখানেও বে-ঘর হচ্ছেন বহু মানুষ। ঘরছাড়া মানুষের কান্না শুনতে ভিন দেশে – মালদিভ কিরিবাটি ক্যারিবিয়ান — ছুটতে হবে না। ঘরের কাছে সুন্দরবনে গেলেই নিদারুন অভিজ্ঞতা হবে। ঘোড়ামারা মউশানি দ্বীপের বাতসে কান পাতলেই ভেসে আসবে আবহাওয়া উদ্বাস্তুদের কান্না। সমুদ্র গিলে খেয়েছে ওই দ্বীপের অনেকটা অংশ।
অনেকের যুক্তি, বিশ্ব উষ্ণায়ণ নয়, সুন্দরবনে ভুমিক্ষয় হেতু দ্বীপের আয়তন কমছে। এ কথা অনস্বীকার্য, ম্যানগ্রোভ অরণ্য হ্রাস পেয়েছে, তাই ভুমিক্ষয় ঘটছে দ্রুত। তবে বিশ্ব উষ্ণায়ণ হেতু সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি এবং দ্বীপ ভুমির ক্রমশ সমুদ্র গর্ভে তলিয়ে যাওয়ার ঘটনাও প্রমাণিত সত্য। ‘বিগত 45 বছরে সমুদ্রমুখী সুন্দরবনের 250 বর্গ কিলোমিটার সাগর গর্ভে তলিয়ে গেছে’। ‘সাগর দ্বীপের এক তৃতীয়াংশ 20 বছরে নিশ্চিহ্ন’। আর সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন দ্বীপের সংখ্যা? ভারতের অন্তর্গত সুন্দরবনের শতেক দ্বীপের অর্ধেক জুড়ে মানুষের বাস। তেমনই অনেক দ্বীপের—যেমন বেডফোর্ড, কাবাসগড়ি, লোহাছারা, সুপারিভাঙা- সলীল সমাধি ঘটেছে। ঘোড়ামারা মউশানি দ্বীপের অবলুপ্তি শুধু সময়ের অপেক্ষা।
ইয়স ঝড়ের পর (মে, ২০২১) ওই সমস্ত দ্বীপের অনেক অংশ সমুদ্র গ্রাস করবে। ভিটে মাটি হারিয়ে চলে যাবেন ভিন্ন স্থানে। জন্ম নেবে বহু সংখ্যায় জলবায়ু উদ্বাস্তু।
এ সব দ্বীপ ভূমিতে (ঘোড়ামারা মউশানি) মানুষের প্রধান জীবিকা চাষবাস মৎস শিকার। জীবিকা অর্জনের সব উপায় হারিয়ে ওখানকার মানুষ ভিনদেশী। কেউ সল্টলেকে রিক্সাওয়ালা। কাজ খুঁজতে কেউ পারি দিয়েছেন ব্যাঙ্গালোর, কেউ কুয়েতে। দেশে ফিরে ভিটে মাটি ঘর-দুয়ার খুঁজে পাবে না কেউ। উদ্বাস্তু ছাড়া এদের কী-ই বা বলা যায়। এঁরা জলবায়ু উদ্বাস্তু।
পরিত্রাণের উপায়:
জলবায়ু উদ্বাস্তু সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য হাতে নেই। কিন্তু বিশ্বব্যাপী দিন দিন বাড়ছে এদের সংখ্যা। আন্তর্জাতিক স্তরে সমস্যাটির বিচার বাঞ্ছনীয়।
আর দরকার বিশ্ব উষ্ণায়ণ কমিয়ে ফেলতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমিয়ে ফেলা। হ্রাস করা জ্বালানীর দহন, গাড়ি এয়ারকন্ডিশন মেসিন এবং অন্য ভোগ্যপণ্যের ব্যবহার।
এ তো অগ্রগতি তথা সভ্যতার কণ্ঠরোধ! এ কি সম্ভব? পৃথিবী জুড়ে চেষ্টা চলছে অসম্ভবকে সম্ভব করবার। একদিকে অগ্রগতি আরেক দিকে বিশ্ব উষ্ণায়ণ, এই দুয়ের সমঝোতার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত অনেক বিজ্ঞানী রাষ্ট্র নেতা। কয়লা ও জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমাতে একাধিক দেশ চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। উদাসীনতাও লক্ষ করা গেছে অনেক দেশের কর্মকাণ্ডে।
আশার কথা, অধিকাংশ দেশের রাষ্ট্রনায়করা এখন বুঝতে পেরেছেন, বায়ুমণ্ডলের উষ্ণায়ন কমানো দরকার। চোখের সামনে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর জমাট বরফ গলতে দেখে, অনেক পাহাড় চূড়ার গ্লেসিয়ার নিশ্চিহ্ন হতে দেখে শিউরে উঠেছেন তারা। লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে দেখে এখন বুঝতে পারছেন ক্রমবর্ধমান বিশ্ব উষ্ণায়ণের রাশ টানা ভিন্ন অন্য পথ নেই।
চিরাচরিত শক্তির উৎস–কয়লা বা তেলের উপর নির্ভরতা কমিয়ে সৌর বিদ্যুৎ, বাতাসের শক্তি ইত্যাদিকে ব্যবহার করতে হবে। দরকার কম জ্বালানি কাজে লাগিয়ে বেশী শক্তি উৎপন্ন করার (Energy efficient) কারিগরি। এ সব না করলে বাঁচানো যাবে না পৃথিবীকে।