যে পরিবারের ছেলেরা কয়েক পুরুষ ধরে স্থানীয় পাদ্রী বা বিদেশের মাটিতে মিশনারির কাজ করে কাটিয়ে দিচ্ছিলেন জীবন, খুব বেশি হলে এক-আধ জন ডাক্তারি করতেন, সেই পরিবারের বাবা-মায়েরা যে ছেলেকে পাদ্রি হিসেবেই দেখতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। চেয়েছিলেনও তাই। কিন্তু ছেলেই বাধ সাধলেন। পাদ্রি তিনি হবেন না।
বাড়িতে এ খবর জানাজানি হওয়ায় সকলেই বেশ মর্মাহত হলেন। কিন্তু কোনও ফল হল না। ছেলে একদম অনড়। শেষে বাড়ির সকলে তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, তা হলে তুই জীবনে কী করবি?
তিনি বললেন, আমাকে কয়েকটা দিন সময় দাও। আমি ভেবে তোমাদের জানাচ্ছি।
বেশ কয়েক দিন ধরে অনেক ভাবনা-চিন্তা করে অবশেষে তিনি জানালেন, তিনি একজন মেকানিক হতে চান।
শেষমেশ মেকানিক! পাদ্রি না হোস না হলি, তা বলে ডাক্তারও নয়! বাড়ির লোকেরা চূড়ান্ত হতাশ হলেও কিচ্ছু করার ছিল না। হাজার বুঝিয়েও তাঁকে বাগে আনা গেল না। অগত্যা তাঁর কথা মতোই একটি জায়গায় তাঁর হাতে-কলমে মেকানিকের কাজ শেখার ব্যবস্থা করা হল।
কিন্তু কয়েকটা বছর কাটতে না-কাটতেই তিনি বেশ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে, হাঁটাচলা করাটাও তাঁর পক্ষে সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। ওই সময় ডাক্তারবাবু তাঁকে পরামর্শ দিলেন, প্রতিদিন বিকেলের দিকে একটু হাঁটাহাঁটি করার।
না, তিনি একা যেতে পারতেন না। তাই তিনি প্রায়ই কাউকে না কাউকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির সামনে একটু হাঁটাহাঁটি করতে বেরোতেন। কোনও কোনও দিন হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা চলে যেতেন। এবং প্রায়ই গিয়ে উঠতেন তাঁদের পারিবারিক এক বন্ধুর বইয়ের দোকানে।
সেখানে গিয়ে তিনি যখন তখন এ তাক সে তাক থেকে ইচ্ছেমতো বইপত্র নিতেন। ঘাঁটাঘাঁটি করতেন। উল্টেপাল্টে দেখতেন। শুধু বইই নয়, বইয়ের ব্যবসা সম্পর্কেও খোঁজখবর নিতেন ওই দোকানের মালিকের কাছে। আর এই ভাবেই একটু একটু করে কী ভাবে যেন বইয়ের প্রতি তাঁর একটা ভালবাসা জন্মে যায়।
তখন তিনি ঠিক করেন, না। তিনি আর মেকানিক হবেন না। বইয়ের ব্যবসা করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। অবশেষে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে তিনি শুরু করলেন প্রকাশনার ব্যবসা।
বেশি না, বছর পাঁচেক পরে দেখা গেল তাঁর ব্যবসা বেশ ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। ঠিক তখনই তিনি লেখকদের কাছে ভাল পাণ্ডুলিপি চেয়ে নানান পত্র-পত্রিকায় ঢাইস ঢাউস সব বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করলেন। জমাও পড়ল প্রচুর পাণ্ডুলিপি। কিন্তু তিনি যেমনটা চাইছেন তার ধারেকাছেও নাকি কোনও পাণ্ডূলিপি পৌঁছতে পারছে না। তাই সেরা পাণ্ডুলিপি পাওয়ার জন্য তিনি প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন। ঘোষণা করলেন বিপুল অঙ্কের আর্থিক পুরস্কার।
কিন্তু তাতেও তাঁর মনের মতো কোনও পাণ্ডুলিপি না পাওয়ায়, তিনি ঠিক কী রকম উপন্যাস চাইছেন, তা বোঝানোর জন্য তিনি নিজেই লেখা শুরু করলেন একটি উপন্যাস।
এই খবর শুনে সকলেই বেশ অবাক হয়ে গেলেন। বিশেষ করে লেখকেরা। তাঁরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি শুরু করলেন। এত লেখক থাকতে শেষ পর্যন্ত এই বইয়ের দোকানের মালিক নিজেই বই লিখতে শুরু করেছেন দেখে। অনেকে আড়ালে-আবডালে কটুক্তি করতেও ছাড়লেন না। কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করলেন, প্রকাশনাটা এ বার লাটে উঠবে।
কিন্তু অবাক কাণ্ড! না, তিন মাসও লাগল না। তাঁর লেখা সেই বই তাঁর প্রকাশনী থেকেই মহাসমারোহে প্রকাশিত হল। এবং সবার সব আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত করে সেই বই হইহই করে বিক্রি হতে লাগল।
সকলেই উচ্ছ্বসিত। হইচই পড়ে গেল চারদিকে। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন বইয়ের দোকানের মালিক— হেরমান হেস। বিক্রি হতে শুরু হল কপির পর কপি— পিটার ক্যামেনডিন্ড। বেরোতে লাগল একের পর এক নতুন মুদ্রণ। বইয়ের ব্যবসা করতে এসে এই ভাবে নিজেই লেখক হয়ে উঠলেন হেরমান হেস।
তার পর থেকে লেখার চাপ এত বেড়ে গেল যে, বছর দুয়েকের মধ্যেই তাঁকে পুরোপুরি সরে আসতে হল ওই ব্যবসা থেকে। মনপ্রাণ ঢেলে তিনি শুরু করলেন লেখার সাধনা। আর এই লেখার জন্যই ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে দেওয়া হল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সাহিত্য সম্মান— নোবেল প্রাইজ।