বাউল কার্তিক উদাস। কবি, গবেষক, গীতিকার, সুরোকার, শিল্পি, সমাজ সেবক, শিক্ষক,আধ্যত্বিক সাধক। আরও অনেক উপাধিতে ভূষিত করা যায় নাটোরের বাউল কুলের শিরোমণি বাউল কার্তিক উদাসকে।
আমাদের সমাজে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যিনি নিজের কর্মের অবসরে বাউল ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে ব্যায় করেছেন কষ্টার্জিত অর্থ, শ্রম ও পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া এক খন্ড জমি। উজ্জীবিত করে রেখেছেন নাটোরের বাউল অঙ্গন। এই আধ্যাত্বিক সাধকের জন্ম নাটোরে।
১৯৬৬ সালে ৫ নভেম্বর নাটোর পৌরসভার হাজরা নাটোর মহল্লায় কৃষি জতিন সাধুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৯০ সালে শিক্ষা জীবন শেষে বেছে নেন শিক্ষকতা পেশা।ছোট বেলা থেকেই জন্মদায়িনী মা কাদম্বনীর কাছেই তিনি শুরু করেন সঙ্গীত চর্চা।
এই সাধকের মা কাদম্বিনী ছিলেন একজন লোকগীতির শিল্পী। মা’র হাতেই গানের হাতেখড়ি হয় তার। ৮০র দশক থেকেই নাটোরে বাউল কুলের সাধক প্রয়াত ওস্তাদ সন্তোষ চৌধুরী,নিমাই তালুকদার, বাউল মনতাজ উদ্দিন, বাউল মতিউর রহমান মতি সহ গুনি সাধকদের সান্নিধ্য পান বাউল কার্তিক উদাস।
লোকসংস্কৃতি ও বাউলগান চর্চার মাধ্যমে সুস্থ ধারার দেশজ সংস্কৃতির বিকাশ সাধনের নিরলস পরিশ্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।‘দেহের ক্ষুধা মিটে খাদ্যে আর মনের ক্ষুধা মিটে গানে’এই ধারণাকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে অনেক গান রচনা করেন তিনি।
বিলীয়মান লোকসংস্কৃতির ধারা বাউল সংগীতকে টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি নিজ উদ্যোগে ১৯৯৬ সালে ‘ভোলা মন বাউল ও সমাজ কল্যান সংগঠন’ নামে প্রতিষ্ঠা করেন বাউল চর্চা কেন্দ্র। বাউল কার্তিক উদাসকে ভালোবেসে জেলার অন্তত হাজার খানেক বাউল সাদক যোগ হয়েছে তার নিজ হাতে গড়া সঙ্গঠনে।
পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া চার শতাংশ জমি তিনি দান করেন ভোলামন বাউল ও সমাজ কল্যাণ সংগঠনে, নির্মাণ করেছেন ইমারত। সেখানে তিনি একটি লোকসংস্কৃতি জাদুঘর (folklore museum) গড়ে তোলার স্বপ্নও দেখছেন।
এছাড়াও প্রতি বছর অগ্রাহণ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার তার বাড়িতে বাউল মিলনমেলা নামে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাউলগণ আসেন এবং সঙ্গীত পরিবেশন করেন।তবে করোনাকালীন সময়ে প্রায় দুই বছর যাবত সেই অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
বাউল কার্তিক উদাস আধুনিক গান বাউল গান দেহতত্ত্ব সহ বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক গান রচনার পাশাপাশি কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর পরিচিতি গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ভয় কিছু নয়, ঐতিহ্যের নাটোর ও বনলতা সেন, পুঠিয়া রাজবাড়ী ও হেমন্ত কুমারী, নাটোরের বাউল-ফকির ইত্যাদি।
গীতিকার হিসেবে বাংলাদেশ বেতারে ১৯৯১ সালে সংগীত শিল্পী হিসেবে উত্তীর্ণ হন।১৯৯৪ সালে চতুর্থ শতাব্দীর সাহিত্য পদক কবিতা ক্লাব পাবনা শাখা সম্মাননা পেয়েছেন। ২০০৮ সালে গানের এ্যালবাম ‘ভবের বাজার’ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত গানগুলো আলোড়ন সৃষ্টি করে নাটোরের পথে, মাঠে-ঘাটে এবং বিভিন্ন মহলে।
২০১০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে গীতিকারের স্বীকৃতি অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি কবি বন্দে আলী মিয়া সাহিত্য পদক, গুণী সংবর্ধনা, বাউল শিল্পী ও সাহিত্য পদক এবং পল্লী-কবি-জসিম-উদ্দিন সাহিত্য পদক ও নাটোর জেলা শিল্পকলা একাডেমী ২০১৫ সম্মাননা পেয়েছেন।
বর্তমানে তিনি তার স্ত্রী ও একমাত্র পুত্রকে নিয়ে নাটোর পৌরসভার হাজরা নাটোর মহল্লায় বসবাস করেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনের পরেও বাউল সংগীত ও সাহিত্য চর্চায় নিষ্ঠার সাথে সাধনা করে যাচ্ছেন তা নাটোরের বাউল সমাজের জন্য দৃষ্টান্তমূলক নিদর্শন।
সাধক বাউল কার্তিক উদাসের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, এই শিল্প ও সাহিত্য চর্চা অব্যাহত রেখে দেশের লোকসংগীত ও বাউল গানকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নিরলস সাধনা করে যাবেন এবং আজীবন দেশজ সংস্কৃতির সেবা করে যেতে চান এটাই তার ব্রত। সেই সাথে নাটোরে তিনি একটি লোকসংস্কৃতি জাদুঘর (folklore museum) গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন।
যুগ যুগ ধরে নাটোরের বাউল অঙ্গনকে উজ্জীবিত রেখেছে যে প্রিয় মুখ তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন সার্বিক সহযোগিতায় করার দায়িত্ব আমাদের সকলের।এতে করে নাটোরের বাউল অঙ্গন সম্পর্কে জানবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এমনটাই মনে করছেন সুশীল সমাজের নাগরিকরা।