নলে খুড়ো
নলিনী রঞ্জন ঘোষ বাবার একমাত্র ছেলে। জমি জায়গা ছিল বেশ ভালই। বাবামায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় আচার ব্যবহারে আভিজাত্যর পরিচয় পাওয়া যেত। নলিনীবাবু যখন বাড়ি থেকে বার হতো ব্রেস্লেট ধূতী পাঞ্জাবী ধোপার কাছে কাচানো আয়রন করা জামাকাপড় ছাড়া বাইরে বার হতো না, পায়ে চামড়ার নিউ কাট জুতো। সুপুরুষ ছয় ফুট উচ্চতা ও মাথায় ছিল কাঁকড়া চুল। রাস্তায় বাহির হলে সবাই তাকিয়ে থাকতো। অবিভক্ত ভাঙড় থানার পোলের হাট বাজারে যখন বাজার করতো বাজারের সেরা মাছ মাংস তরিতরকারী কিনে নিত। সঙ্গে থাকতো তিন জন লোক ব্যক্তিগত সহায়ক হিসাবে। ওনার চালচলন ছিলো অসাধারণ। কেউ কোন দায় নিয়ে হাজির হলে কোন দিন কাউকে খালি হতে ফেরাতো না। অন্তর ছিল দয়ালু। মাঝে মাঝে যাত্রাদলে অভিনয় করতো। যাত্রায় উনি রাজার পাঠ নিতো। এবং খুব ভাল অভিনয় করতে পারতো। এলাকায় নাম যশ ছিল বেশ ভাল। কিন্তু ওনার মনে একটা দুখ ছিল, যা মনের মধ্যে নিজেকে খুব অসহায় বোধ করতো। কারণ উনি নিঃসন্তান ওনার কোন সন্তান আদি ছিল না। অনেক ডাক্তার কবিরাজ করে ও সবেই বৃথা হয়ে গিয়েছিল। মানসিক ভাবে চিন্তা করে করে শরীর স্বাস্থ্য একেবারেই ভগ্ন দশা হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লো। আস্তে আস্তে মানসিক দিক দিয়ে বধির হয়ে গেলো। জমি জায়গা বিক্রী করে দিতে লাগল। হঠাৎ একদিন স্ত্রী মারা গেলো আরো ভেঙে পড়ল এবং যেন দিশাহারা হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। শেষ পর্যন্ত নিজের ভিঠাটা বিক্রী করে দিল। যখন টাকা পয়সা শেষ হয়ে গেলো কোন উপায় অন্ত না থাকায় ভোম ভোলার মত চুপচাপ গাছতলায় আশ্রয় নিল। আর একটা ছেড়া চটের বস্তা নিয়ে রাস্তায় পোলের হাট বাজারের ভিতর কাগজ কুড়িয়ে কুড়িয়ে বস্তা ভর্তি করে করে জমা করতো। বাজারে ভাঙ্গাচুরার দোকানে বিক্রি করে যা টাকা পয়সা হতো তা দিয়ে নিজে হাতে চাল আলু ডাল কিনে গাছতলায় রান্না করে খেতো, আর কুড়ানো কাগজের বস্তায় শুয়ে ঘুমাতো। গায়ে ময়লা ছেড়া জামা, আর ছেড়া কাপড় পরে দিনযাপন করতো। বর্ষার সময় কোথায় থাকবে, কোথায় যাবে ভেবে ভেবে মনটা অস্থির হয়ে উঠতো। এমন দশা দেখে বিধাতারও মনে হয় কষ্ট হতো। অপুষ্টি জনিত স্বাস্থ্য একেবারে শীর্ণকায় হয়ে গেল। পোলের হাটে সুধীর পালের ছেলে অজিত পালের বাড়িতে একটি টালী কারখানা ছিল। অজিত পাল ওকে বলল তুই আমার কারখানার মধ্যে কাগজের বস্তাগুলো রেখে ওখানেই থাক। সেইমতো ঘাড়ে করে অজিত পালের কারখানায় আশ্রয়ের প্রতিশ্রুতিতে সব কাগজের বস্তা নিয়ে জমা করে রাখলো। বাজারের লোকেরা প্রায়ই দেখতাম ওর পিছনে লাগতো আর হল্লা করে বলতো ‘বল হরি, হরি বোল’ কে যাবে নলে খুড়ো। যখন খুব রাগ হতো তখন সে কথা বলত। সবাই নলে খুড়ো বলেই ডাকতো। একদিন একটা কুকুর মরা গরুর ডাক্তারখানার সামনে পড়ে আছে, দুর্গন্ধ ছুটছে কেউ আসে না। কেউ আশেপাশে দাঁড়াতে পারছে না। বেলা এগারোটা হবে। দুই-তিনজন লোক খুড়োর কাছে গিয়ে ডাকছে খুড়ো ও খুড়ো। কিন্তু খুড়ো যেন গভীর নিদ্রায় মগ্ন। কোনভাবে ডাক শুনছে না কিন্তু কে ফেলবে ওই কুকুর মরা। আশেপাশে দোকানদাররা দুর্গন্ধে অতীষ্ট। বারোটার দিকে খুড়ো ঘুম থেকে উঠে চায়ের দোকানের দিকে আসছে দেখে সবাই বলল খুড়ো চা খেয়ে কুকুর মরাটা ফেলতে হবে। খুড়ো কোন কথা বলছে না। চা খাওয়ার পর চায়ের পয়সা মিটিয়ে দিয়ে ধীর গতিতে এক পা দু পা করে হাঁটতে শুরু করেছে। তখন চায়ের দোকানদার বলল, ও খুড়ো লাশটার ব্যবস্থা হবে না। তখন খুড়ো বলল দশটাকার কমে লাশ সরবে না। একজন ছুটে গিয়ে বলল খুড়ো দশটাকা দেবে চায়ের দোকানদার। খুড়ো একটু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো মরা কুকুর ফুলে ঢোল হয়েছে। কুকুরের গায়ে মাছি ভনভন করছে। অনেকেই অনুরোধ করার পর নলে খুড়ো বলল লাশ সরবে তবে আরও দশটাকা দিতে হবে। আর এক কাপ চা, একটা পাউরুটি খেতে দিতে হবে। খালি পেটে ওই লাশ সরানো যাবে না। তাই হবে খুড়ো। আগে ফেলে দিয়ে এসো। নলে খুড়ো চা রুটি খেয়ে এগারো টাকা নিয়ে নিল। বাজারের ভিতর থেকে আট আনা দিয়ে এক ছড়ি কাতার দড়ি নিয়ে কুকুরের পায়ে ভালো করে বেঁধে অনেক দূরে খাল পাড়ে নিয়ে ফেলে দিয়ে খালের জলে চান করে ফিরে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে কি চিন্তা করছে। আর দুটো চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। হয়তো মনে মনে বিধাতার বিধানকে মেনে নিয়ে মনটাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে নলে খুড়ো। সেই ভারাক্রান্ত মনের দুঃখ মনেই পোষন করে আবার একদিন পর স্বাভাবিক ভাবেই জীবন যাপন শুরু করে দিল। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সবার দিকে। ছেড়া কাগজের বস্তা সম্বল করে জীবন ধারণ করতো। নলে খুড়ো নলে খুড়ো হয়েই পরিচিতি মানুষের মনে আজও বেঁচে আছে।