রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অনুমতি নিয়ে সেই খোঁড়া লোকটাকে বন্দি করে বর্ধমানে নিয়ে আসা হল। কারণ, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারের এক মেয়ের বিয়ে হয়েছিল বর্ধমান রাজার এক ছেলের সঙ্গে।
মেয়েটি যখন সন্তানসম্ভবা, তখন তাঁর পাতে রোজই নিত্যনতুন উপাদেয় খাবার দেওয়া হলেও দেখা যেতে লাগল, সেই খাবার তাঁর মুখে রুচছে না। যে খাবার কয়েক দিন আগেও তিনি চেটেপুটে খেতেন, সেই খাবারও মুখে তুলতে তাঁর যেন অনীহা। কিন্তু কিছুই না খেলে চলবে কী করে! তাই তাঁর শাশুড়ি, বর্ধমানের রানিমা নানান রকম উপাদেয় খাবার পরিপাটি করে সাজিয়ে তাঁর মুখের সামনে দিতে লাগলেন। কিন্তু পুত্রবধূটি কিছুই মুখে তুলতে চান না। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, অনুরোধ করে, এমনকী চোখ বড় বড় করে তাঁকে খাওয়ালেও, তিনি সঙ্গে সঙ্গে তা বমি করে ফেলছেন।
ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েও কোনও লাভ হল না। তাই একদিন শাশুড়িমা তাঁর বউমাকে বললেন, তুমি তো কিছুই খেতে পারছ না। আচ্ছা, বলো তো মা, তোমার এখন কী খেতে ইচ্ছে করছে?
লজ্জায় চোখ নামিয়ে কী একটু ভেবে নিয়ে একদম নিচু স্বরে রাজবধূটি বললেন, ল্যাংচা।
— ল্যাংচা? সেটা আবার কী? শাশুড়িমা একদম অবাক। কারণ, তিনি সমস্ত রকম ভাল ভাল খাবারই খেয়েছেন, কিন্তু এ রকম উদ্ভট নাম এর আগে তিনি কখনও শোনেননি। তাই রানিমা জানতে চাইলেন, সেটা আবার কী রকম খাবার?
বধূটি তখন লজ্জায় একশেষ। কিছুই আর বলতে চান না।
তাঁকে বারবার জিজ্ঞেস করা হল, তিনি ঠিক কী খেতে চাইছেন? তবু তাঁর মুখে কোনও রা নেই। একদম নিশ্চুপ।
শাশুড়িমাকে না বললেও পর দিন সকালে সেই বধূটি তাঁর স্বামীকে বললেন, ‘ল্যাংচা’ কোনও খাবারের নাম নয়। তবে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদে তিনি একদিন একটা মিষ্টি খেয়েছিলেন। সেই মিষ্টির নামটা তাঁর মনে নেই। তবে যে লোকটা সেই মিষ্টিটা বানিয়েছিলেন, তাঁকে তিনি দেখেছিলেন। তিনি ছিলেন ল্যাংড়া। মানে তাঁর একটা পা ছিল খোঁড়া।
তাঁর তৈরি ঘিয়ে ভাজা সেই বিশেষ মিষ্টিটাই খাওয়ার সাধ জেগেছে তাঁর।
ছেলের কাছ থেকে সেই খবর শুনে রানিমা সেটা মহারাজকে জানাতেই নড়েচড়ে বসলেন বর্ধমানের রাজা।
সাধের পুত্রবধূর শখ বলে কথা! রাজার নির্দেশে তক্ষুনি এক বিশ্বস্ত কর্মচারীকে নদিয়া পাঠানোর ব্যবস্থা করা হল। সঙ্গে সঙ্গে রাজার জরুরি পত্র নিয়ে ঘোড়া ছোটালেন সেই রাজ কর্মচারী।
অনেক খোঁজ করে করে অবশেষে পাওয়া গেল সেই খোঁড়া লোকটিকে। জানা গেল, এই লোকটাই সে দিনের সেই মিষ্টিটা বানিয়েছিলেন। তাই রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অনুমতি নিয়েই তাঁকে নিয়ে আসা হল বর্ধমানে।
বর্ধমানের মহারাজ তাঁর মিষ্টি খেয়ে এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন এবং সেই মিষ্টি খাওয়ার সময় পুত্রবধূর মুখে এতটাই তৃপ্তি দেখেছিলেন যে, সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেই খোঁড়া লোকটিকে বর্ধমানের পূর্বে, চার ক্রোশ দূরে বড়শুল গ্রামে অনেকখানি ভূসম্পত্তি দান করলেন। শুধু জমিই দান করলেন না, ঘরও বানিয়ে দিলেন। তাঁর দোকান গড়ে উঠল বাদশাহী সড়কের উপর শক্তিগড় গ্রামে।
প্রত্যেক দিন তাঁর ভিয়েন থেকে এক মণ করে সেই বিচিত্র মিষ্টি সরবরাহ হত বর্ধমান রাজপ্রাসাদে।
যেহেতু পুত্রবধূ ‘ল্যাংচা’ বলেছিলেন, তাই ময়দা, ছানা, খোয়া আর চিনি দিয়ে বানানো ল্যাংড়া ময়রার সেই কালচে বাদামি রঙের মিষ্টিটার নাম হয়ে গেল ল্যাংচা। লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল ল্যাংচার নাম।
রাজপরিবারের পছন্দ এই মিষ্টিটি খেতে কেমন? প্রজাদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। ভিড় উপচে পড়ল সেই দোকানে। চাহিদা বাড়তে লাগল দিনকে দিন। কিন্তু তাঁর একার পক্ষে সেই চাহিদা সামাল দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই তাঁর দেখাদেখি তাঁর আশেপাশে একের পর এক গজিয়ে উঠতে লাগল আরও অনেক ল্যাংচার দোকান।
আজ শক্তিগড়ের দু’নম্বর জাতীয় সড়কের দু’ধারের সার সার ল্যাংচার দোকানগুলোর এতটাই খ্যাতি যে, ওখান থেকে কোনও বাস বা গাড়ি যাওয়ার সময় অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও, দাঁড়াবেই। শুধুমাত্র ল্যাংচার জন্য নয়, ল্যাংচার পাশাপাশি সীতাভোগ, মিহিদানা এবং ছানাপোড়ার জন্য।