৬৫ কোটি চড়াই পাখি নিধন!
আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এক কলঙ্কজনক ঘটনা

সিদ্ধার্থ সিংহ
সিদ্ধার্থ সিংহ
6 মিনিটে পড়ুন
ছবি: সংগৃহীত

‘মশা, মাছি, ইঁদুর আর চড়াই পাখি, বিশেষ করে ইউরেশিয়ান গেছো চড়াই নাকি গোটা দেশের বেশির ভাগ ফসলই খেয়ে শেষ করে দিচ্ছে। তাই জনগণের খাবারে টান পড়ছে।’

দেশে খাদ্যশস্যে কেন টান পড়ছে সমীক্ষা করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই রিপোর্টই এসে পৌঁছেছিল চিন সরকারের হাতে। তাই ১৯৫৮ সালে‌ এই সমস্যার সমাধান‌ করার জন্য মশা, মাছি, ইঁদুরের সঙ্গে সঙ্গে গোটা দেশের সমস্ত চড়াই পাখিকে মেরে ফেলার নির্দেশে দেন চিনের চেয়ারম্যান‌ স্বয়ং মাও সে তুং। ঘোষণা করা হয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই দেশ থেকে চড়াই পাখি নির্মূল করতে হবে। এই অপারেশনের নাম দেওয়া হয়— দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন।

কিন্তু কথা হল, প্রায় ৯৬ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের এই দেশটি থেকে কোটি কোটি চড়াই পাখিকে রাতারাতি মেরে ফেলা যাবে কী করে! সেটা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। তাই দেশের তাবড় তাবড় বিদগ্ধ পণ্ডিতদের নিয়ে রীতিমত গবেষণা শুরু হল, কী ভাবে চড়াই পাখি নিধন করা যায়।

nidhon ৬৫ কোটি চড়াই পাখি নিধন! <br>আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এক কলঙ্কজনক ঘটনা
ছবি: সংগৃহীত

তখন কয়েক জন পশু চিকিৎসক একটা পথ বাতলে দিলেন। আর সেই নিদান পাওয়ার পর থেকেই থালা, বাটি, গ্লাস, হাতা, খুন্তি নিয়ে দেশের জনগণ বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়। সামনে কোনও চড়াই পাখি দেখলেই তাঁরা সেগুলো জোরে জোরে বাজাতে লাগলেন।

- বিজ্ঞাপন -

আর সেই বিকট শব্দে ভয় পেয়ে চড়াই পাখিগুলো দিকভ্রষ্ট হয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল এদিক ওদিক। কিন্তু ওরা পালাবে কোথায়!

চড়াই পাখি মারার জন্য যে তখন গোটা দেশে জারি হয়েছে এক অঘোষিত যুদ্ধ। স্কুল-কলেজের পড়ুয়া থেকে সরকারি-বেসরকারি অফিসের কর্মচারী, কারখানার শ্রমিক, কৃষক থেকে দিন আনা দিন খাওয়া মজুর, এমনকী‌ পিপল’স লিবারেশন আর্মি— সকলেই নেমে পড়েছে চড়াই নিধনযজ্ঞে।

khun ৬৫ কোটি চড়াই পাখি নিধন! <br>আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এক কলঙ্কজনক ঘটনা
ছবি: সংগৃহীত

মূলত কম বয়সি ছেলেমেয়েরা জাল ফেলে, খাঁচা পেতে, টোপ দিয়ে ধরার চেষ্টা করছে ঝাঁক ঝাঁক চড়ুই পাখি। কেউ কেউ গুলতি ছুঁড়ে মারছে। কেউ ব্যবহার করছে খেলনা বন্দুকের গুলি। কেউ খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে বিষ। উদ্দেশ্য একটাই, যেনতেন প্রকারে চড়াই পাখি মারতেই হবে।

বৃদ্ধ এবং শিশুরা পাহারা দিতে শুরু করল ক্ষেত। ‌যাতে একটা চড়াই পাখিও মুখে কোনও দানা তুলতে না পারে। কিছু লোক নেমে পড়ল চড়ুই পাখির বাসা নষ্ট করার জন্য। ডিম ভেঙে ফেলার জন্য।

sparraw ৬৫ কোটি চড়াই পাখি নিধন! <br>আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এক কলঙ্কজনক ঘটনা
ছবি: সংগৃহীত

বাড়ির মেয়ে-বউরা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল থালা, বাটি নিয়ে। চড়াই পাখির দেখলেই তাঁরা বাজাতে লাগল সেগুলো। যাতে সেই আওয়াজে ওই ছোট্ট ছোট্ট পাখিগুলোর হৃদপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে যায়।

- বিজ্ঞাপন -

এই ঘটনার পরের দিন, মানে ১৯৫৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর চিনের সমস্ত দৈনিক পত্রপত্রিকার প্রথম পাতায় এই নিধনযজ্ঞের খবর ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। তখনই জানা গিয়েছিল, এই নিধনযজ্ঞে খতম হয়েছে প্রায় ৬৫ কোটি চড়াই পাখি।

শোনা যায়, সে দিন আক্রমণাত্মক লোকেদের‌ ভয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য প্রচুর চড়ুই পাখি নাকি‌ বেইজিংয়ের পোলিশ দূতাবাসের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছিল।

2 1 ৬৫ কোটি চড়াই পাখি নিধন! <br>আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এক কলঙ্কজনক ঘটনা
৬৫ কোটি চড়াই পাখি নিধন!
আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এক কলঙ্কজনক ঘটনা 44

কিন্তু চিন সরকারের অনুরোধ সত্ত্বেও শুধুমাত্র মানবিকতার খাতিরে পোলিশ কর্তৃপক্ষ নাকি তাদের দূতাবাসের ভেতরে একজন চড়ুই নিধনকারীকেও ঢুকতে দেয়নি।

- বিজ্ঞাপন -

তাতে প্রচণ্ড রেগে গিয়ে ওখানকার হাজার হাজার লোকেরা একসঙ্গে জড়ো হয়ে ওই দূতাবাস ঘিরে রাতদিন থালা-বাটি, কাঁসর-ঘণ্টা, এমনকী ড্রামও বাজাতে শুরু করেন। সেই কান বিদীর্ণ করা শব্দে হার্টফেল করে মারা যায় প্রচুর চড়াই পখি।

4 2 ৬৫ কোটি চড়াই পাখি নিধন! <br>আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এক কলঙ্কজনক ঘটনা
ছবি: সংগৃহীত

এই ভাবে একটানা দু’দিন ধরে পালা করে ওই সব বাজানোর পরে এক সময় ক্লান্ত হয়ে ওরা চলে যায়।

এত আওয়াজ হচ্ছিল যে, কান ঝালাপালা হওয়ার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য দূতাবাসের কর্মীরা দরজায় খিল দিয়ে, কানে তুলো গুঁজে ভিতরের ঘরে কাটাচ্ছিলেন। সেই‌ আওয়াজ থামার পর তাঁরা বেরিয়ে দেখেন, দূতাবাসের সর্বত্র গাদা গাদা চড়াই পাখি মরে পড়ে আছে। উঠানে এত চড়াই পাখি মরে আছে যে, সেগুলো সরানোর জন্য ওই দূতাবাসের কর্মীদের বেলচা ব্যবহার করতে হয়েছিল।

5 2 ৬৫ কোটি চড়াই পাখি নিধন! <br>আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এক কলঙ্কজনক ঘটনা
ছবি: সংগৃহীত

এই নির্মম ও হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য অবশ্য চিনাদের পরে খেসারতও দিতে‌ হয়েছিল। কারণ, শস্য দানার পাশাপাশি চড়াই পাখি তো নানা ধরনের পোকামাকড়ও খেত। দেশ থেকে চড়াই পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বাড়তে থাকে সেই সব পোকামাকড়। ধেয়ে আসতে থাকে লক্ষ লক্ষ পঙ্গপাল। তারা ক্ষেতের সমস্ত শস্য খেয়ে সাবাড় করে দিতে থাকে।

যে শস্য বাঁচানোর জন্য মাত্র দু’দিনে প্রায় পঁয়ষট্টি কোটি চড়াই পাখিকে হত্যা করা হল, তার চেয়েও বেশি শস্য চলে‌ গেল কিনা পোকামাকড়ের পেটে!

3 1 ৬৫ কোটি চড়াই পাখি নিধন! <br>আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এক কলঙ্কজনক ঘটনা
ছবি: সংগৃহীত

এত শস্য খেয়ে তারা সাবাড় করে দিয়েছিল যে, দেশের বাৎসরিক খাদ্যশস্য মজুতের ন্যূনতম লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ করা গেল না।‌ ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই চিনের শস্যভাণ্ডার খালি হয়ে গেল। খাদ্য সংকটের মুখে পড়ল কোটি কোটি মানুষ। শুরু হল দুর্ভিক্ষ।

abin ৬৫ কোটি চড়াই পাখি নিধন! <br>আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এক কলঙ্কজনক ঘটনা
ছবি: সংগৃহীত

‘দ্য‌ গ্রেট চাইনিজ ফ্যামিন’ নামের এই দুর্ভিক্ষে মারা‌‌ যান প্রায় দেড় কোটি মানুষ। চড়াই নিধন করে কত বড় ভুল যে তাঁরা করেছেন, বুঝতে পেরে, অবশেষে ‘পোকামাকড়ের ফসল খাওয়ার সমস্যা’ সামাল দেওয়ার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রায় কয়েক লাখ চড়াই পাখি আমদানি করতে বাধ্য হয় চিনা সরকার। সেই চড়াই পাখি সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ঘোষণা করা হয়, এ বার থেকে চড়াই পাখিকে আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। একটা চড়াইও যাতে না মারা না যায়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

এই ‘দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন’ যেমন চিনের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে আছে, ঠিক তেমনি‌ আছে, বিদেশ থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যাক চড়াই পাখি আমদানি করার এক অদ্ভুত রেকর্ডও।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
২০২০ সালে 'সাহিত্য সম্রাট' উপাধিতে সম্মানিত এবং ২০১২ সালে 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। আনন্দবাজার পত্রিকার পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, স্বর্ণকলম পুরস্কার, সময়ের শব্দ আন্তরিক কলম, শান্তিরত্ন পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা সহ অসংখ্য পুরস্কার। এছাড়াও আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর 'পঞ্চাশটি গল্প' গ্রন্থটির জন্য তাঁর নাম সম্প্রতি 'সৃজনী ভারত সাহিত্য পুরস্কার' প্রাপক হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!