নাটোরে কমছে হিজল ফুলের গাছ: নতুন করে রোপনের উদ্যোগ নেই

মাহাবুব খন্দকার
মাহাবুব খন্দকার - নাটোর প্রতিনিধি
8 মিনিটে পড়ুন
ছবি: মাহাবুব খন্দকার

আমাদের নাটোর এক বৈচিত্রময় পরিবেশের সমাহার। একদিকে বিস্তৃর্ন বিল, জলমগ্ন বৃক্ষশূণ্য অঞ্চল। অপরদিকে উস্মতম লালপুর অঞ্চল।পরিবেশের ভারসাম্য রাক্ষায়, নাটোরের সাতটি উপজেলার বিলাঞ্চলে এক সময় কালের সাক্ষি হয়ে দাড়িয়ে থাকা, প্রচুর হিজল গাছ ছিলো। কিন্তু কালের বিবর্তনে তা আজ হারিয়ে যাচ্ছে।

একটা সময় নাটোর বগুড়া মহাসড়কের পাশে প্রচুর হিজল গাছ ছিলো। সামাজিক বনায়নের গাছ কেটে নেওয়ার সাথে সাথে, নিধন হয় এই বৃক্ষ ।কিন্তু নতুন করে আর তা লাগানো হয়নি। তবুও প্রকৃতিগত ভাবেই, জন্মানো দুএকটি গাছ, চোখে পড়ে আজও।

3 নাটোরে কমছে হিজল ফুলের গাছ: নতুন করে রোপনের উদ্যোগ নেই
নাটোরে কমছে হিজল ফুলের গাছ: নতুন করে রোপনের উদ্যোগ নেই 39

নাটোর শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে, সিংড়া উপজেলার তিসি খালি গ্রামের, হযরত ঘাসি দেওয়ানের মাজার, যেখানে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, প্রাচীনতম ০৩ টি হিজল গাছ, যার সঠিক বয়স কেউ জানে না।

চলনবিলের মতন, হালতিবিলের মধ্যেও রয়েছে হিজল গাছ, নাটোর শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে।যে হিজল গাছ নিয়ে, কবি লিখেছিলেন কবিতা, কতো গল্প, ঘুরে ফিরতো, এই গাছটিকে ঘিরে, তা আজ শুধুই স্মৃতি। স্থানীয়রা জানায়, কয়েকদিন আগে কালবৈশাখী ঝড়ে, ভেঙেছে গেছে সেই হিজল গাছটি।

- বিজ্ঞাপন -
4 নাটোরে কমছে হিজল ফুলের গাছ: নতুন করে রোপনের উদ্যোগ নেই
নাটোরে কমছে হিজল ফুলের গাছ: নতুন করে রোপনের উদ্যোগ নেই 40

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম একটি কবিতায় লিখেছিলেন, “পিছল পথে কুড়িয়ে পেলাম হিজল ফুলের মালা, কি করি এ মালা নিয়ে বল চিকন কালা’। কবি জীবনানন্দ দাশ হিজলগাছের সৌন্দর্য নিয়ে একাধিক কবিতা রচনা করেছেন। লিখেছিলেন- ‘এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ’।

নাটোর শহরের আশপাশে, রাণীভবানীর রাজবাড়ীতে ও বিলাঞ্চলে একসময় প্রচুর হিজল গাছ ছিল যা এখন আর চোখে পড়ে না। জেলার হর্টিকালচার সেন্টার ও বন বিভাগের যৌথ উদ্দ্যোগে একদা নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের দুই পাশে রোপণ করা হয়েছিল হিজল গাছ

সেই গাছগুলোর মধ্যে অনেক গাছ সড়ক প্রশস্তিকরণের কারণে কাটা পড়েছে। তবে কিছু গাছ এখনও আছে। সরকারিভাবে ও ব্যাক্তি উদ্যোগে হিজল গাছ রোপণ ও পরিচর্যা করা দরকার বলে মনে করছনে নাটোরের বৃক্ষপ্রেমিকেরা।

নাটোর পৌরসভার বলারী পাড়া মহল্লার খন্দকার আনিছুর রহমান জানান, ৮০ দশকে তার বাড়ির পাশে পুকুরের ধারে একটি হিজল গাছ ছিল। যখন ফুল ঝরে পানিতে পড়ে থাকত সেটা দেখতে অপূর্ব লাগত। ৯০ দশকে গুজব উঠেছিল হিজল গাছে নাকি ভূত থাকে, সেই সময় গাছটি কাটা হয়েছিল।

2 নাটোরে কমছে হিজল ফুলের গাছ: নতুন করে রোপনের উদ্যোগ নেই
নাটোরে কমছে হিজল ফুলের গাছ: নতুন করে রোপনের উদ্যোগ নেই 41

সদর উপজেলার দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের মতিগাঙ্গল গ্রামের মো.আব্দুর রাজ্জাক বাচ্চু জানালেন, ৪০ বছর আগের তাদের বাড়ির পেছনে বিলের ধারে দুইটা হিজল ফুলের গাছ ছিল, এখন আর নেই। পেন্ডুলামের মত ঝুলতে থাকা পুষ্পমঞ্জুরি। রাতে বা ভোরে হিজল তলার সামনে দিয়ে গেলে বা দূর থেকেও এর মাদকময় মিষ্টি ঘ্রাণ পওয়া যেত ।

- বিজ্ঞাপন -

পানির ওপর পড়া হিজল ফুলের আস্তরণ চেনা রূপ। হিজলতলায় সকালে গেলে মনে হত গোলাপি বিছানা পাতা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুল ফোটা শুরু হত এবং সকালের আলোয় ঝরে যেত। তাদের গ্রামে সেই সময় বেশকিছু হিজল গাছ ছিল। এখন সেই গাছগুলো তার চোখে আর পড়ে না।

নাটোরের চাঁদপুর টেকনিক্যাল এন্ড বি.এম. কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক দেবাশিষ সরকার জানান, হিজল নামটার মধ্যে প্রথমত স্তবধতা ও প্রফুল্লতা বিরাজ করে। হিজল ফুল ও গাছের উপর তার অনেক দূর্বলতা। অদ্ভুদ আকর্ষণীয় ও পরিবেশ বান্ধব হিজল গাছ। তিনি শহর ও বিলাঞ্চলের বহু হিজল গাছ দর্শন করেছেন।

গাছ প্রিয় এই মানুষটি আরও জানালেন হিজল ফুল গাছের সাথে তার গভীর সম্পর্ক। গাছটির সঙ্গে সে অতপ্রতোভাবে জড়িত। ২০০২ সালে তিনি শুনেছিলেন বাগাতিপাড়া উপজেলার ডাকাতিয়া বিলের মধ্যে একটি প্রকান্ড আকারের হিজল আছে। তিনি দেখতে গিয়েছিলেন সেই গাছ।

- বিজ্ঞাপন -
1 3 নাটোরে কমছে হিজল ফুলের গাছ: নতুন করে রোপনের উদ্যোগ নেই
নাটোরে কমছে হিজল ফুলের গাছ: নতুন করে রোপনের উদ্যোগ নেই 42

হাঁটু পানি ভেঙ্গে সে গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। গ্রামবাসী সেই গাছের নিচে ভয়ে যায় না। কারণ একদা এই গাছের নিচে ডাকাতরা তাদের লুটের মালামাল ভাগ বাটোয়ারা করতো। গ্রামবাসী জানে না গাছটির বয়স কত। সবাই বলে ছোটবেলা থেকেই এই গাছটি তারা দেখে আসছে।

এছাড়াও তিনি হালতি বিল, খোলাবাড়িয়া বিল, চলন বিলের অনেক স্থানের হিজল গাছ পরিদর্শণ করেছেন। তিনি আরো বলেন, শহরের আশপাশে ও রাণীভবানীর রাজবাড়িতে বেশকিছু হিজল গাছ ছিল যা এখন আর চোখে পড়ে না।

তবে হর্টিকালচার সেন্টার ও বন বিভাগের যৌথ উদ্দ্যোগে একদা নাটোর-বগুড়া মহাসড়কে দুই পাশে রোপণ করা হয়েছিল হিজল গাছ। সেই গাছগুলোর মধ্যে অনেক গাছ কাটা পড়েছে। তবে কিছু গাছ এখনও আছে। সরকারিভাবে ও ব্যাক্তি উদ্যোগে হিজল গাছ রোপণ ও পরিচর্যা করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।

গোল-ই-আফরোজ সরকারী কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মোঃ সাইফুল ইসলাম জানান, হিজল গাছের ইংরেজি নাম Barringtonia, বৈজ্ঞানিক নাম Barringtonia acutangula, এবং সংস্কৃততে একে নিচুল নামে অভিহিত করা হয়। হিজল ছাড়াও আরো কিছু নামে এই গাছকে ডাকা হয় যেমন- নদীক্রান্ত, জলন্ত, কার্ম্মক এবং দীর্ঘপত্রক।

হিজল গাছের আদি নিবাস বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়া, মালেয়শিয়া ও অস্ট্রেলিয়া। হিজল গাছের উচ্চতা ১০ থেকে ১৫ মিটার হয়। হিজল মাঝারি আকারের চিরহরিৎ গাছ। বাকল ঘন ছাই রঙের ও পুরু হয় । ডাল-পালার চারদিকে বিস্তার করে থাকে।

জলাবদ্ধ এলাকায় বিশেষ করে খাল, বিল, নদী-নালা, ও ডোবার ধারে এই গাছ জন্মে। একদা সর্বত্র হিজল গাছ চোখে পড়ত তবে বর্তমানে এই সংখ্যা অনেকটাই কমে এসেছে। হিজলের কাঠ নরম, সাদা বর্ণের, উজ্জ্বল, মসৃণ ও টেকসই। পানিতে নষ্ট হয় না বলে আগে নৌযান তৈরিতে ব্যবহৃত হত।

এর বাকল থেকে ট্যানিন পাওয়া যায়। এছাড়া উদ্ভিদটির ঔষধি গুরত্ব রয়েছে। হিজল ফুল ফোটে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে। হালকা গোলাপি রঙের ১০-১২ সে.মি. লম্বা পুষ্পদণ্ডের মাঝে অসংখ্য ফুল ঝুলন্ত অবস্থায় ফোটে। হিজল ফুল দেখতে খুবই সুন্দর হয় এবং এর রঙ বেশ আকর্ষণীয়।

হিজল গাছ পানিতে সহজে মরে না। জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে এবং দীর্ঘদিন বাঁচে । হিজল ফুল শেষ হলে গাছে ফল আসে। ফল তিতা ও বিষাক্ত, দেখতে অনেকটা হরিতকির মতো। বিল অঞ্চলে এগাছের ডাল মাছের অভয়ারণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হত। সময়ের ব্যবধানে নাটোর জেলা থেকে অনেকআংশে কমে গেছে হিজল ফুলের গাছ ।

জেলা সহকারী বন সংরক্ষণ কর্মকর্তা মেহেদুজ্জামান জানান, হিজলগাছ সাধারণত জল ও কাদা মাটিতে বীজ থেকে প্রাকৃতিক ভাবেই হয়। হিজলগাছের প্রাণশক্তি প্রবল। বন্যার পানি কিংবা তীব্র খরাতেও টিকে থাকে।

5 1 নাটোরে কমছে হিজল ফুলের গাছ: নতুন করে রোপনের উদ্যোগ নেই
নাটোরে কমছে হিজল ফুলের গাছ: নতুন করে রোপনের উদ্যোগ নেই 43

এমনকি পানির নিচে কয়েক মাস নিমজ্জিত থাকলেও হিজলগাছ বেঁচে থাকে। যে সমস্ত বিরল প্রজাতির গাছ হারিয়ে যাচ্ছে যেমন হিজল, তমাল এ ধরনের গাছের চারা সরকারিভাবে উৎপাদন ও রোপন করা হয় বলে জানান তিনি।

নাটোর থেকে দিনে দিনে কমছে হিজলগাছ।যেহেতু হিজলগাছ পরিবেশ বান্ধব, জলমগ্ন বিলাঞ্চলের বৃক্ষ, তাই গাছটি বেশি বেশি রোপন করার মাধ্যমে, গাছেটির বংশ টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায়, সাধারন মানুষের সাথে এগিয়ে আসবে বন বিভাগ, এমন প্রত্যাশা সবার।

যেহেতু এই হিজলগাছ পরিবেশ বান্ধব একটি গাছ, তাই মানুষের সচেতনতাই পারে হিজল গাছের বংশ টিকিয়ে রাখতে। দিনদিন হিজল গাছের সংখ্যা এতটাই কমে যাচ্ছে হয়তো অদূর ভবিষ্যৎতে হিজলগাছ চোখেই পড়বে না।

তাই প্রকৃতির সৌন্দর্য ধরে রাখতে আমাদের সচেতন হতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সামাজিক ঐক্য এবং অকারণে গাছ কেটে ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে। আমরা সচেতন হলে প্রকৃতির কোনো কিছুই আর হারিয়ে যাবে না বলে মনে করেন নাটোরের বৃক্ষপ্রমিকেরা।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
নাটোর প্রতিনিধি
সাংবাদিক এবং লেখক
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!