স্যার যদুনাথ সরকার ভারতবর্ষে ইতিহাস রচনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণার পথিকৃৎ। ইতিহাসবিদ হিসেবে বিশ্বে সমাদৃত হলেও নিজ পৈতৃকভিটা থেকে গেছেন পরবাসী হয়ে। বেদখল হয়ে গেছে তার পৈতৃক জমিদারবাড়ি। গড়ে উঠেছে ইউপি কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিক, সংঘ ও মাদ্রাসা। স্থানীয় সংসদ সদস্যকে বলেও রক্ষা করা হয়নি এসব।
স্যার যদুনাথ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কোনো ধারণা নেই বললেই চলে। স্থানীয় ইতিহাস জানানোর তাগিদ থেকেও স্কুল-কলেজে পালন করা হয় না তার জন্ম-মৃত্যু দিবস। অনেক শিক্ষকই জানেন না তার নাম।
স্যার যদুনাথ সরকার ১৮৭০ সালের ১০ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়া উপজেলার ছাতারদীঘি ইউনিয়নের কড়চমাড়িয়া গ্রামে ধনাঢ্য জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পিতা রাজকুমার সরকার মা হরিসুন্দরী দেবীর ৭ ছেলে ও ৩ মেয়ের মধ্যে তিনি পঞ্চম সন্তান যদুনাথ সরকার। পাঁচ বছর বয়সে স্থানীয় শম্ভুনাথ পন্ডিতের পাঠশালায় তার হাতেখড়ি।
মাঝে এক বছর কলিকাতা সিটিজিয়েন স্কুলের পড়াশুনা করলেও রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৮৮৭ সালে প্রথম শ্রেণির সরকারি বৃত্তিসহ উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে এন্ট্রানস পাস করেন। ১৮৮৯ সালে মেধাতালিকায় দশম স্থান অর্জন করে রাজশাহী কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণির বৃত্তিসহ এফ.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
সমৃদ্ধ কর্মজীবনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুভাষাবিদ স্যার যদুনাথ ছিলেন প্রথম অধ্যাপক ভাইস চ্যান্সেলর। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে ইংরেজি অনুবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা পাশ্চাত্যে ছড়িয়ে দিতে তিনি অবদান রেখেছিলেন।
তার ২৫টি গ্রন্থের পাঁচখন্ডে রচিত ‘হিস্ট্রি অব ঔরঙ্গজেব’, ভারতবর্ষের সামরকি ইতিহাস ও শিবাজী গবেষণ ইতিহাস সচেতন সবার কাছেই পরিচিত। প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯২৯ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে নাইট উপাধি প্রদান করেন। ৮৮ বছর বয়সে ১৯৫৮ সালের ১৯ মে কলকাতায় প্রয়াত হন স্যার যদুনাথ সরকার।
ইতিহাসবিদ ও ইতিহাস গবেষক স্যার যদুনাথ সরকার যতটা প্রখ্যাত, পৈতৃকভিটায় তিনি ততটাই অবহেলিত। তাদের জমিদারবাড়ি ভেঙে তৈরি করা হয়েছে ছাতারদিঘী ইউনিয়ন পরিষদের ভবন। স্থানীয় সংদস সদস্য ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এমপি ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন।
সরেজমিনের দেখা যায়, জমিদারবাড়ির পশ্চিম পাশে প্রায় এক একর জায়গার ওপর নির্মিত বিশাল কাচারি ঘরটি ভেঙে তৈরি করা হয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক ও করচ মারিয়া সবুজ সংঘ নামে একটি ক্লাব ঘর। উত্তর- পূর্ব দিকের বিশাল বাড়ি ও পোস্ট অফিস ভেঙে তৈরি হয়েছে ইউনিয়ন ভবনের অংশ ও কিছু দোকান।
এ ছাড়া বাড়ির দক্ষিণ চত্বরের এক কোণে ১৩২৬ বঙ্গাব্দে নির্মিত মন্দিরটি সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের পথে। এদিকে মদিনাতুল উলুম কওমিয়া মাদ্রসা ও করচমাড়িয়া সবুজ সংঘের নামে একদল প্রভাবশালী ভোগ দখল করছে জমিদারের ভিটা, পুকুর ও জমি। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা মফাজ্জল হোসেন চাঁদ মাদ্রাসার নামে অবৈধভাবে এসব সম্পত্তি ভোগদখল করছে।
কালীগঞ্জ বনমালী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রবীণ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নারায়ণ চন্দ্র দাস দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই স্যার যদুনাথ সরকারের জীবনীসহ অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছি, কিন্তু জমিদার বাড়িটি শত চেষ্টা করেও রক্ষা করতে পারিনি। সবশেষ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে বলেও তার কোনো প্রতিকার পাইনি। তিনি আরো বলেন, আজ যদি এই জমিদার বাড়িটি সংরক্ষণ করা যেত, তাহলে নতুন প্রজন্ম অনেক কিছু শিখতে পারত’।
স্যার যদুনাথ সম্পর্কে জানতে চাইলে সিংড়া দমদমা পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আনোয়ারুল ইসলাম আনু বলেন, ‘স্যার যদুনাথ সরকারের ইতিহাস ও কিছু ছবি সংগ্রহ করে খোদাই করে দেওয়ালে টাঙানো আছে এবং প্রতি বছর স্যারের সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে কুইজ ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়’।স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আলতাব হোসেন বলেন, সরকারি বরাদ্দ পেলে পুরনো মন্দিরটি সংস্কার করা হবে’।
জেলা প্রশাসক মো. শাহরিয়াজ জানান, ‘স্যার যদুনাথ সরকার সম্পর্কে আমি জেনেছি, জমিদারবাড়ি ও স্যারের স্মৃতি রক্ষার চেষ্টা করব। সরেজমিনে জায়গাটি পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যদি কেউ অবৈধভাবে ভোগ দখল করে, তা উদ্ধার করা হবে’ বলে জানান তিনি।
আমরা আশাবাদীদের দলে, তাই উপমহাদেশের বিখ্যাত ইতিহাসবিদের পৈত্রিক ভিটা একদিন উদ্ধার হবে। আগামী প্রজন্ম স্যার যদুনাথ সরকার সম্পর্কে জানবে, এমন প্রত্যাশা সচেতন মহলের।