বাজারে যখন ওয়েব ম্যাগাজিন আসেনি, তখন একচেটিয়া দাপিয়ে বেড়াত বিভিন্ন মুদ্রিত পত্রপত্রিকা। কেউ দাবি করতেন, আমাদের পাঠক সংখ্যা দু’লক্ষ। কেউ দাবি করতেন, আমাদের পাঠক সংখ্যা দশ লক্ষ। কেউ দাবি করতেন পঞ্চাশ লক্ষ। এখানে উল্লেখযোগ্য হল, এঁরা সবাই কিন্তু বলতেন পাঠক সংখ্যা। কেউ কিন্তু বলতেন না, তাঁরা কত কপি মুদ্রণ করছেন।
গণ্ডগোলটা এখানেই। এখনও কেউ ধরে নিচ্ছেন তাঁদের একটি পত্রিকা গড়পড়তা দশ জন পড়েন। কেউ ধরে নিচ্ছেন পনেরো জন পড়েন। আবার কেউ ধরে নিচ্ছেন কুড়ি জন পড়েন। এবং তাঁদের মন গড়া সেই সব হিসেব নিয়েই তাঁরা যে যাঁর মতো বলে বেড়াচ্ছেন, আমাদের পাঠক সংখ্যা এত লক্ষ… এত লক্ষ… এত লক্ষ…আসলে পুরো ব্যাপারটাই কিন্তু ধোঁয়াশা। পত্রিকার কর্তৃপক্ষ যে হিসেব দেন, হয় আমাদের সেই হিসেব বা তাঁদের বলা পাঠক সংখ্যাকে বিশ্বাস করতে হয় অথবা হা হা হা করে হেসে উড়িয়ে দিতে হয়।
কারণ যাঁরা একটু খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন, যিনি পয়সা দিয়ে একটি পত্রিকা কেনেন, তিনিও পুরোটা পড়েন না। আদৌ পড়েন কি? সেটাও সন্দেহ আছে। সেখানে একটি পত্রিকা দশ জন পড়েন, এই দাবি করাটা কি হাস্যকর নয়?
যাঁরা এই সব দাবি করেন বা করছেন, তাঁরাও কি নিজের বুকে হাত রেখে এই কথাগুলো বলতে পারবেন? না, পারবেন না। সেখানে ওয়েব ম্যাগাজিনের হিসেবটা কিন্তু পুরোটাই স্বচ্ছ। যত জন পড়ছেন, সঙ্গে সঙ্গে সেই সংখ্যাটা উপরে দেখা যাচ্ছে।
শুধু পড়া নয়, যদি কারও কোনও লেখা ভাল লেগে যায়, তিনি সেই লেখাটির শেয়ার অপশনে গিয়ে যে কোনও লোককে অনায়াসে পাঠাতে পারেন। আর এই শেয়ার করাটাও কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নথিভূক্ত হয়ে যায় নির্দিষ্ট জায়গায়। সেই সংখ্যাটাও দেখা যায়।
গোটা বিশ্ব জুড়ে যে ওয়েবজিনগুলো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, যেমন— আমাদের ভারত থেকেই বেরোচ্ছে ছোটদের অত্যন্ত জনপ্রিয় ওয়েবজিন ‘জয়ঢাক’ কিংবা ‘আনন্দকানন’, কানাডার অটোয়া থেকে বেরোচ্ছে ‘আশ্রম’, ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলেস থেকে বেরোচ্ছে ‘এল এ বাংলা টাইমস’ বাংলাদেশের ঢাকা থেকে বেরোচ্ছে ‘কাব্যশীলন’ কিংবা ‘স্টোরি অ্যান্ড আর্টিকেল, অথবা অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে প্রকাশিত হচ্ছে ‘প্রভাত ফেরী’ পত্রিকার দিকে একবার নজর দিলেই বোঝা যাবে, তাদের পাঠকসংখ্যা কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে।
নাঃ, আমরা নরওয়ে থেকে প্রকাশিত একমাত্র বাংলা পত্রিকা আমাদের ‘সাময়িকী’র কোনও ঢাকঢোল এখানে পেটাব না। তবে এটা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, কোনও মুদ্রিত পত্রিকার পক্ষে এই ওয়েবজিনগুলোর পাঠকসংখ্যার ধারেকাছেও পৌঁছনো সম্ভব নয়।
মাত্র ক’দিনের মধ্যেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি লেখা শুধুমাত্র শেয়ার হয়েছে অষ্টআশি হাজার। সেলিনা হোসেনের একটি গল্প শেয়ার হয়েছে পঁচাশি হাজার। সদ্য লিখতে আসা এই বাংলার এক তরুণ কবি রঞ্জনা রায়ের একটি প্রবন্ধ প্রকাশের মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শেয়ার হয়ে গেছে পাঁচশোরও বেশি। এই অধমেরও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে লেখা একটি গদ্য প্রকাশের মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই শেয়ার হয়ে গেছে ছত্রিশ হাজার।
এগুলো শুধু শেয়ারের হিসেব, তার মানে কত লোক এগুলো পড়েছেন একবার ভাবুন। না, মুদ্রিত পত্রিকার মতো এখানে কারচুপি করার কোনও উপায় নেই।
আসলে যেটা হয়েছে, কোনও মুদ্রিত পত্রিকা জোগাড় করতে হলে সেটা কিনতে হবে, পড়ার জন্য সঙ্গে রাখতে হবে এবং যত্ন করে পড়তে হবে যাতে ছিঁড়ে না যায়।
কিন্তু ওয়েবজিনের ক্ষেত্রে সে সবের কোনও বালাই নেই। এখন তো আবার আরও সহজ হয়ে গেছে। কম্পিউটার বা ল্যাপটপও লাগে না। জামা-প্যান্টের মতোই যেটা এখন আমাদের সর্বক্ষণের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে, সেই মোবাইলটা থাকলেই হল। সঙ্গে নেট। ব্যস, আর কিচ্ছু লাগে না।
ট্রেনে-বাসে, যেখানে সেখানে পত্রিকাটা খুলে পড়তে শুরু করলেই হল। আর যেহেতু এই সব ওয়েবজিনগুলোতে খুব ছোট্ট ছোট্ট লেখা প্রকাশিত হয়, তাই চট করে পড়েও নেওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্যও করা যায় চটজলদি। সে খারাপ, ভাল যাই হোক না কেন। আর ওয়েবজিনের পাঠক সংখ্যা বাড়ছে দেখেই মুদ্রিত পত্রিকাগুলো কিন্তু ইদানিং মুদ্রণ সংখ্যার পাশাপাশি ওয়েব সংখ্যাও প্রকাশ করছে। এটা লক্ষ্য করার বিষয়। তবে ওয়েবের এই পাঠক সংখ্যা দিন দিন আরও বাড়বে, যদি মুদ্রিত পত্রিকার প্রথিতযশা লেখকেরা সমান নিষ্ঠা এবং ভালবাসা দিয়ে এই ওয়েবজিনগুলোর জন্যও কলম ধরেন। তাঁরা যে ধরবেন তার প্রমাণ কিন্তু আমরা ইতিমধ্যেই পেতে শুরু করেছি।
এক সময় যাঁরা মুদ্রিত পত্রিকায় দাপিয়ে বেরিয়েছেন, এখনও লেখক তালিকার প্রথম সারিতেই রয়েছেন, যেমন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, সেলিনা হোসেনেরা… তাঁরা কিন্তু ইতিমধ্যেই ওয়েবজিনগুলোতে লেখার জন্য কলম তুলে নিয়েছেন। বাকিরাও যে তুলে নেবেন, সেটা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের বিশ্বাস, ওয়েবজিনের স্বর্ণযুগ এল ফলে!