খুব তাড়াতাড়ি মন ভাল করতে হলে
সবুজের কাছে গেলে মনটা একদম ভাল হয়ে যায়। প্রকৃতির সাথে নিবিড় যোগাযোগই আমাদের মনকে ভাল করে দেয়। এই প্রকৃতিই আমাদের দিতে পারে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন। খোলা আকাশ, উন্মুক্ত বনভূমি, পাহাড়ি নদী, ঝর্ণা, চা বাগান বা সবুজ ক্ষেত মনকে নিমেষেই কেমন ভাল করে দেয়।
খুব বেশি সবুজ দেখলে, খুব বেশি সবুজের মাঝে থাকলে, মাঝে মধ্যে সবুজ প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গেলে, বিষণ্ণতা কিভাবে কখন যে পালিয়ে যায় তা নিজেরাই বুঝে উঠতে পারি না। সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনের জন্য এর চেয়ে ভালো ওষুধ আর কিছুতে নেই।
বিষণ্ণতা থেকে ছুটি পেতে চাইলে প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকার চেয়ে বিকল্প আর কি হতে পারে।
তাই বেড়াতে গেলে মন ভাল হয়ে যায়, আর সেটা যদি হয় পাহাড়ের কোলে বা সাগরের গর্জনের মাঝে অথবা ঘন সবুজ অরণ্যে, তবে তো মন ভালো হবেই। আর সব সময়ই যে মন ঠিক করার জন্যে অনেক দূরে যেতে হবে এমনটা কিন্তু নয়, ঘরের থেকে একটু বেরিয়েই পড়ুন না, খোলা এক প্রান্তর, যদি তা হয় সবুজের মাঝে, আর মাথার ওপর থাকে খোলা আকাশ তাহলে মনটা কি একটু দোলা দিয়ে যায় না?
কর্মক্ষেত্রে কাজের চাপ, সাংসারিক জীবনে কাজের চাপ, বিষন্নতা কিম্বা শারীরিক অসুস্থতা ইত্যাদি নানা কারণে আমরা এতটাই ব্যস্ত থাকি যে বেশিরভাগ সময়েই আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে ভীষণরকম জটিলতায় ফেলে দেয়। আমাদের মাঝে এমন অনেকেই আছেন, যারা সামান্য মানসিক চাপে একেবারেই ভেঙে পড়েন। আবার অনেকেই আছেন সামান্য অসুস্থতায় ওষুধ বা ডাক্তারের দ্বারস্থ না হয়ে পারেন না। আমাদের আশেপাশে এমন মানুষের সংখ্যা কিন্তু খুব একটা কম নেই। সমস্যা থেকে যায় সমস্যার আড়ালেই, সমাধানের পথ আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
অথচ সমাধানের পথ কিন্তু আমাদের হাতেই আছে। অনেকেই জানেন না, প্রকৃতি এক্ষেত্রে আমাদের কতটা উপকার করে থাকে। বলতে গেলে আমাদের শারীরিক অসুস্থতা থেকে শুরু করে মানসিক সমস্যাসহ সকল কিছুর সমাধান প্রকৃতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে। নিজেকে চাপমুক্ত রাখতে চাইলে প্রতিদিন অন্তত কিছুটা সময় প্রকৃতির মাঝে কাটানো উচিত। প্রকৃতির নিবিড় ভালোবাসার হাতছানিতে কিছুটা সময় কাটাতে পারলে মন উৎফুল্ল হয়ে উঠবেই। প্রকৃতি নানারকম ভাবে আমাদের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে।
একটু চোখ বন্ধ করে দুটো দৃশ্যের রূপকে কল্পনা করে দেখুন। এক পাশে রাখুন গ্রাম বাংলাকে, আর এক পাশে রাখুন শহরকে। গ্রামে দেখা যাচ্ছে সবুজ ছায়ায় ঘেরা উঠোন, আর শহরে আছে ইট কাঠ পাথরের ঘেরাটোপ। কোন রূপটা আপনার মন এবং চোখকে শান্তি দিচ্ছে? নিজের কাছেই কিন্তু সেই উত্তরটা আছে তাই না?
তাছাড়া যারা সবুজের মাঝে আছেন তাদের শারীরিক প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। তাদের দৃষ্টি শক্তি তুলনামূলক ভাবে শহরের মানুষের চেয়ে অনেক বেশী প্রখর। গ্রামাঞ্চলের লোকেরা বেশি সবুজ আবহাওয়ায় থাকেন। কিন্তু যারা শহরাঞ্চলে ইট-কাঠ-পাথরের মাঝে জীবনযাপন করেন, তাদের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের মানুষজন বেশি দীর্ঘায়ুসম্পন্ন এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে থাকেন। তাদের মানসিক যন্ত্রণাও তুলনামূলক কম থাকে। এটিই তাদের দীর্ঘায়ু হওয়ার মূল কারণ।
আর একপ্রকার ক্লান্তি মাঝে মাঝেই নেমে আসে আমাদের জীবনে। তার নাম হল ‘মানসিক ক্লান্তি’। আমরা যে কেউ যদি প্রকৃতির কোনো ছবির দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকি, তাহলেও তার স্মৃতি কিছুটা সতেজ হয়। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে। তাহলে সেটি ছবি না হয়ে যদি সত্যিকারের প্রকৃতির সান্নিধ্য হয়, তাহলে তার প্রভাব কেমন হতে পারে একবার ভেবে দেখুন।
তাই মানসিক চাপ ও মনযোগ বাড়াতে চাই প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য। মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতার মতো মানসিক ব্যাপারগুলোর সবচাইতে বড় ওষুধ হচ্ছে প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা। নিজেই পরীক্ষা করে দেখুন হাতে হাতে তার ফল পাবেন। আপনি যদি ভীষণরকম মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন তাহলে চেষ্টা করুন যেভাবেই হোক কোনো পার্ক বা খোলামেলা হাওয়াযুক্ত সবুজ পরিবেশ থেকে হেঁটে আসতে, তাহলেও সঙ্গে সঙ্গে আপনার মানসিক অস্থিরতা বা হতাশা বা ক্লান্তি বোধ কিছুটা সময়ের জন্যে হলেও উপশম হবে। কারণ, এতে মস্তিষ্কে তৈরি হয় কিছু ভালোলাগার হরমোন এবং তা মানসিক চাপ উপশমে অসাধারণ কাজ দেয়।
যে কোনো রোগের ক্ষেত্রেও সবুজ প্রকৃতিই শ্রেষ্ঠ ওষুধ। কঠিন অসুখ থেকে সেরে ওঠার জন্য অনেক সময় ডাক্তাররা প্রেসক্রাইব করে থাকেন রোগী যেন পছন্দসই কোনো ছায়া নিবিড় শান্ত পরিবেশে কিছু সময় কাটিয়ে আসেন। এ কথার পেছনে রয়েছে খুব সুন্দর যুক্তি ও নানা গবেষণালব্ধ ফলাফল। প্রকৃতির নির্মল পরিবেশ, বনের সবুজ ছায়া, পাখির কিচির-মিচির ইত্যাদি বিষয়গুলো আমাদের মনের মধ্যে শান্তির বাতাবরণ তৈরি করে।
যাদের অতিরিক্ত ধূমপানের অভ্যাস আছে তারা যদি এই অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের পথ খোঁজেন, সেক্ষেত্রে তারা যদি প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে পারেন, তাহলে তাদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
দৃষ্টি শক্তির প্রখরতা বৃদ্ধিতে সবুজের কোনো বিকল্প নেই। সবুজের দিকে প্রতিদিন যদি নিয়ম করে তাকিয়ে থাকা যায়, তাদের দৃষ্টি শক্তি অন্যদের তুলনায় প্রখর হবেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় ১২ বছরের মধ্যকার বেশিরভাগ শিশুই কঠিন মায়োপিয়া রোগে আক্রান্ত। মায়োপিয়া হলো এমন এক ধরনের চোখের অসুখ, যার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি কাছের জিনিস দেখতে স্বচ্ছন্দ কিন্তু অসুবিধে হয় দূরের জিনিস দেখতে। প্রাথমিকভাবে তখন তাদেরকে চশমা ব্যবহারে সুফল দিলেও, জটিলতা হলে Lasik surgery করতে হয়। বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত যে প্রকৃতি ও পরিবেশের স্বাভাবিক আলোয় মায়োপিয়ায় কম আক্রান্ত হয় শিশুরা। যদি সেই সব শিশুদের আউটডোর অ্যাক্টিভিটি বাড়িয়ে দেওয়া যায় তবে মায়োপিয়া আক্রান্তের হার কিছুটা হলেও নেমে আসবে। বাচ্চারা আউটসাইডে খেলাধুলা বা বেড়াতে গেলে বেশিরভাগ সময়টাতেই প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকে। সুতরাং বাচ্চাদের সুস্থ-স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে প্রকৃতির গুরুত্ব অপরিসীম।
সুতরাং সবুজ প্রকৃতি আমাদের শরীর আর মনে কতোটা প্রভাব বিস্তার করে তা বলাই বাহুল্য।
এছাড়াও আমাদের অন্তর্দহন প্রতিরোধেও সবুজের ছোঁয়া ভীষণরকম কাজ করে। অন্তর্দহন এমন এক স্বাভাবিক ঘাতক, যা কিনা ধীরে ধীরে আমাদের গভীরে তলিয়ে নিয়ে যায়। এই সমস্যা একেবারেই শেষ পর্যায়ে অটোইমিউনো ডিসঅর্ডার, হাইপারটেনশান, ডিপ্রেশন বা মানসিক অবসাদগ্রস্ততা, ক্ষিধে না পাওয়া, এমনকি প্রাণঘাতী ক্যান্সারও হতে পারে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, এই সমস্যা থেকে প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হচ্ছে বেশি বেশি প্রকৃতির সন্নিকটে থাকা।
আর সেই প্রকৃতির মাঝে যদি থাকে সমুদ্র বা ঝর্ণাধারা, তবে তো একেবারে সোনায় সোহাগা। যাদের নিয়ম মেনে চলার অভ্যাস নেই অর্থাৎ যাদের রয়েছে অনিদ্রা সমস্যা, তা অনেকটা দূর করতে সাহায্য করে সকালের সূর্যালোক রশ্মি। ভোরের আলো আমাদের শরীর এমনকি মনের মাঝেও এক বায়োলজিক্যাল ঘড়ি হিসেবে কাজ করে, যা আমাদের দেহকে সময় মেনে কাজ করার জন্য বার্তা পাঠায়। সকালে নির্দিষ্ট একটা নিয়ম মেনে ঘুম থেকে উঠলে, রাতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে আপনা-আপনিই ঘুম চলে আসে। সে নিদ্রা কতোটা সুখের নিদ্রা।
জীবনকে ভালবাসতে ও নতুনভাবে উপলব্ধি করতে প্রকৃতির সাহচর্যে থাকা তাই খুবই দরকার। প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ যত গভীর হবে, বা যত বেশি সময় প্রকৃতির সঙ্গে কাটবে আমাদের ভাবনার স্বচ্ছতা, চিন্তার গভীরতা ও বোঝার ক্ষমতা ততই উন্নত হবে। যা সামগ্রিকভাবে জীবনকে গ্রহণ করার ও উপভোগ করার মানসিকতা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
(চলবে, পূর্ববর্তী পর্বগুলো পড়ুন। নিচে লিঙ্ক আছে।)
প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়েছে ২২শে মে ২০২১
আপনার লেখনি বরাবর মন ছুঁয়ে যায়। আপনার কাহিনীর সময় চরিত্র মাটি থেকে উঠে আসে। আপনার সৃষ্টি বরাবরিই ভালো লাগে। অনেক বছর আগে আমার পত্রিকার জন্য আপনার একটি লেখা পেয়েছিলাম। আজ আর মনে নেই। সেই প্রথম পরিচয়। তারপর থেকে কোথাও কোন লেখা দেখলে একনিশ্বাসে পড়ে ফেলি।