বেশ কয়েকটি প্রকাশনার টেবিলে টেবিলে ঘুরে অবশেষে ‘লা মিজারেবল’ পাণ্ডুলিপিটির একটা প্রকাশক পাওয়া গেল। প্রকাশক উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বললেন, এটা অসামান্য একটি উপন্যাস। আমরা ছাপব। তবে একটাই শর্ত, বইটি যে দিন বেরোবে, আপনাকে সে দিন উপস্থিত থাকতে হবে। যাঁরা আপনার বইটি কিনবেন, আপনি তাঁদের হাতে সরাসরি বইটি তুলে দেবেন। কেউ আবদার করলে, অটোগ্রাফ দেবেন। বইটি সম্পর্কে কেউ কোনও প্রশ্ন করলে তার উত্তর দেবেন।
হাসি মুখে রাজি হয়ে গেলেন লেখক। সেই মতো বই বেরোনোর অনেক আগে থেকেই প্রায় সমস্ত প্রথম শ্রেণির পত্রপত্রিকায় ঘটা করে বিজ্ঞাপনও দিল সেই প্রকাশন সংস্থা। কিন্তু যে দিন বইটি বেরোবে, সে দিন নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাওয়ার পরেও লেখকের দেখা পাওয়া গেল না। প্রকাশক মহাশয় পড়লেন মহা ফাঁপরে। এ দিকে এক-আধ জন করে ক্রেতারাও আসতে শুরু করে দিয়েছেন। তাই বাধ্য হয়ে একটি চিঠি লিখে তাঁর সংস্থার এক কর্মচারীকে পাঠালেন সেই লেখকের বাড়িতে।
কর্মচারীটি গিয়ে দেখলেন, লেখক বাড়িতে নেই। দরজায় তালা ঝুলছে। আশপাশের লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, তিনি তাঁর বউকে নিয়ে সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গেছেন। সেখান থেকে সমুদ্র খুব একটা দূরে নয়, তাই কর্মচারীটি হন্তদন্ত হয়ে ছুটলেন সেখানে। সমুদ্র সৈকতে তখন প্রচুর লোক। তবু খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলেন তাঁকে। দেখলেন, সমুদ্রের পাড়ে পাশাপাশি বসে আছেন সেই লেখক আর তাঁর বউ। এক মনে সমুদ্রের ভেঙে ভেঙে পড়া ঢেউগুলো দেখছেন। দেখছেন বহু দূর থেকে কী ভাবে আস্তে আস্তে এ দিক থেকে ও দিকে চলে যাচ্ছে পালতোলা জাহাজ। সমুদ্রের বুকে তখনও ডানা মেলে ভেসে বেড়াচ্ছে কতগুলো পাখি। উনি একদৃষ্টে পরখ করছেন পৃথিবীর সেই অপরূপ সৌন্দর্য।
তড়িঘড়ি করে লেখকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন কর্মচারীটি। তাঁকে দেখে লেখক মুখ তুলে তাকাতেই, মনিবের পাঠানো খামটি সঙ্গে সঙ্গে তিনি তুলে দিলেন তাঁর হাতে। খামটি খুলে লেখক দেখলেন, তাতে প্রায় কিছুই লেখা নেই। এ ফোর সাইজের একটা সাদা পাতার মাঝখানে কেবল ইয়া বড় একটা ‘জিজ্ঞাসা চিহ্ন’। সেটা দেখে এক মুহূর্ত তিনি কী একটা ভাবলেন, তার পরেই ওই কর্মচারীটির কাছ থেকে একটা কলম চেয়ে নিয়ে ওই পাতাটিরই পিছন দিকে তিনি লিখে দিলেন তাঁর বয়ান। কর্মচারীটি ওই পত্রটি নিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে তুলে দিলেন মনিবের হাতে।
প্রকাশক মহাশয় ওটা খুলে দেখলেন, তাঁর চিঠিরই উল্টো পিঠে, তাঁর লেখা জিজ্ঞাসা চিহ্নের চেয়েও বড় মাপের, প্রায় পুরো পাতা জুড়ে শুধু একটা ‘বিস্ময় চিহ্ন’ লেখা।
পরবর্তীকালে পত্র গবেষকেরা এই চিঠি দু’টির মর্মার্থ উদ্ধার করেছেন। তাঁদের মত অনুযায়ী, প্রকাশকের লেখা কাগজের প্রথম পত্র ‘জিজ্ঞাসা চিহ্ন’টির মানে— ‘কী, আপনি কি আসবেন না?’ আর লেখকের লেখা দ্বিতীয় চিঠি ‘বিস্ময় চিহ্ন’টির মানে— ‘বইটি বিক্রি হচ্ছে তো?’
এখন পর্যন্ত এই চিঠি দুটিকেই বলা হয়— বিশ্বের সংক্ষিপ্ততম পত্র। একই কাগজের দু’পিঠে লেখা দুই পত্র লেখকের একজন ছিলেন একটি বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থার তৎকালীন কর্ণধার এবং অন্য জন ছিলেন ফরাসি সাহিত্যের জাতীয় কবি, রোমান্সের প্রবর্তক, ঔপন্যাসিক ও স্বনামধন্য নাট্যকার— ভিক্টর হুগো।