বর্তমানে ঢাকা শহরে ইলেকট্রিক সরবরাহ সহনীয় মাত্রায় কিন্তু এক সময় চৌদ্দ শহরের বিদ্যুৎ বিতরণের ঝিনাইদহ, অতিরিক্ত বাড়তি সুবিধা গ্রহণ করতো, তার খেসারত হয়তো এখন দিতে হচ্ছে। ঘনঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট মফস্বল শহরের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। অসহ্য গরমে ঘরে টেকা দায়! তাই গাছে ঘেড়া চিলেকোঠায়, জুঁই-বেলীসহ রাতের নানা ফুলের সুগন্ধে মন মাতানো হাওয়া কিন্তু চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, আকাশে দুই দিনের ঈদ চাঁদের আলো মিটিমিটি করে। নিশাচর প্রাণীর মতন কিছু বন্ধুর গভীর রাতে সন্ধ্যা হয়। তেমনই একজন বাল্য বন্ধু, আকতারের প্রতীক্ষায়। এখানে নবগঙ্গায় পরপর দুটো ব্রিজ! সংকীর্ণ হয়ে গেছে জল কিন্তু এখনো, আগুনের লীলা খেলা চলছে। উদাস মনে, আগের কথা মনে পড়ে…
বাল্যবন্ধু আকতারের সাথে খুব জরুরী প্রয়োজন ছাড়া দেখা মেলা ভার! একদিন সাত সকালে, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে এইড কমপ্লেক্সে হাজির! এই তীব্র গরমে; বৃক্ষরাজির শীতল ছায়ায় নদীর হাওয়ায়, কৃত্রিম বাতাস নিষ্প্রয়োজন! দুই বন্ধুর কাচারী ঘরে বসে কথা হচ্ছে। বন্ধু মুখস্থবিদ্যার মত একনাগাড়ে বলে গেল; ‘গভীর রাতে কর্মস্থল হতে ধোপাঘাটা সেতুর উপর দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে, কিছু আগুনের গুল্লা ব্রিজের তলা দিয়ে উত্তর হতে দক্ষিণ দিকে তড়িৎ গতিতে, গঙ্গাতলায় এসে মিলে গেল! ঘরের সামনে ষড়া গাছ লাগাতে নিষেধ করেছিলাম! শুনলে না, এখন কি হবে? গাছটি না হয় কেটে ফেল!’
বন্ধুটি সেই শিশুকাল হতে, সূর্য সেনা পাঠাগার হতে জ্ঞান চর্চা শুরু করেছে, এখনো প্রায় সময় তার প্যান্টের পিছনের পকেটে দৈনিক পত্রিকা শোভা পায়। তাই ঝটপট বলেছিলাম; প্রায় সময় এটা দেখা যায়, ভয়ের কোন কারন নাই! ওটা এ্যামোনিয়া {(Ammonia) (NH3)} অথবা মিথেন {(Mithaen) (CH4)}গ্যাস হতে সৃষ্ট আগুনের লীলা খেলা! নির্গুণ বলে যেমন কোন মানুষ নেই। আগাছা বলে তেমন কোনো বৃক্ষ নেই কিন্তু প্রচন্ড ঔষধি গুণসম্পন্ন চিরহরিৎ গাছটি, একসময় হয়ত প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাবে। তাই ষড়া গাছটা কাটার প্রশ্নই ওঠে না।
সংস্থার একজন পরিচ্ছন্ন নারী কর্মী ঝাড়ু দেওয়া বন্ধ করে দূরে দাঁড়িয়ে, চোখ বড় বড় করে মনে হয়েছিল কথা গিলছে। বন্ধু চলে যেতেই কয়েকজন পরিচ্ছন্ন কর্মী ও ড্রাইভার হাজির! এইড কমপ্লেক্স সংলগ্ন গঙ্গাতলার জাগ্রত কালী মন্দির ও চৌদ্দ হাত মা কালী এবং ব্রিটিশ আমলের ধোপাঘাটা ব্রিজ নিয়ে তারা নানা পৌরাণিক কাহিনী বলা বলি করে..
একসাথে সমস্বরে হড়বড় করে অনেক কথা, যতটুকু বোঝা যায়; তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘কমপ্লেক্সের সীমানা প্রাচীর করার সময় কিছু অংশে ফাটল ধরেছিল! মা কালী নাকশ হয়ে নির্মাণাধীন সীমানা প্রাচীর ফাটিয়ে দিয়েছিলেন! কাজ বন্ধ না করলে ইন্ডিয়ান মা কালীদের খবর দিত! যা রোধ কল্পে পূজা অর্চনার মাধ্যমে শক্তির দেবী মা কালীকে সন্তুষ্ট করেছিলেন ওরা সকলের অজান্তেই, না হলে রক্ষা ছিল না! ধোপাঘাটা ব্রিজ নির্মাণের সময় শত মানুষের মাথা লেগেছিল, ঠিকাদারের বংশ নকি নির্বংশ হয়ে গেছে। স্বপ্নে দেখা মন্দির নির্মাণ করেও জীবন রক্ষা হয়নি! এই ষড়া গাছের একটি চারা যেখানে চৈত্র পূজার সরঞ্জামসহ মানুষের পাঁচটি মাথার খুলি রাখা হয়, সেথায় জন্মগ্রহণ করেছে। তাই অফিসের সামনে হতে এই বড় গাছটি কেটে ফেলাই মঙ্গল। না হলে; রাত বিরাত চলাচল করি, আমাদের সমস্যা বেশি’ ইত্যাদি ইত্যাদি..
বলেছিলাম ভয়ের কিছু নেই, মা কালী উত্তম নিকট প্রতিবেশী, দেবীর সাথে তো কোনো বিরোধ নেই, সে কেন ক্ষতি করবে? মন ভার করে সবাই চলে যায়।
বিকালে এসে হাজির, খালাতো বোন কুসুম আপা। তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও এইড এর কোষাধক্ষ্য । বোন হলেও মায়ের সাথে ছিল তার বন্ধুর মতো ঘনিষ্ঠতা। কোনো বিপদ-আপদ, অসুখ-বিসুখে হাত বাড়ালে বা চোখ খুললেই, আপাকে প্রথম পাওয়া যায়। ঐ দিন বিকালে অফিসের প্রবেশ মুখে ষড়া তলাতে আপার সাথে দেখা! বেশ চিন্তিত ও মনমরা; বুঝতে বাকি রইলো না এটা সকালের ঘটনার জের।
প্রসঙ্গক্রমে আপাকে শান্ত ও হালকা করার জন্য শরৎচন্দ্রের গল্পে ষড়া গাছ ও আমার লেখা ‘ষড়া গাছের গল্প কাহিনী’ প্রসঙ্গ টেনে বলেছিলাম; সংগত কারণে আবাসন লাগোয়া, এ ষড়া গাছে অনেক পরী থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। আপা বলেছিলেন ‘ষড়া গাছে ভূত থাকে শুনেছি, পরী পেলে কোথায়?’ বলেছিলুম ডিম কোলকাতায় গিয়ে যেভাবে মামলেট হয় সেই ভাবেই, আধুনিক ও তথ্য প্রযুক্তির যুগে এসে ভূত-প্রেত পরীতে রুপান্তরিত হয়েছে। একা একা থাকি তাই গভীর রাতে চিলেকোঠায় বসে ওদের নাচ-গান দেখি…
আপার ভাবান্তর হয় না! বললেন, ‘কোরআন-হাদিস চর্চা, এখন করো না’! বৃক্ষপ্রেমী হিসেবে বলেছিলাম; চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো, গ্রাম-গঞ্জের আনাচে-কানাচে, সেইসব ষড়া গাছ, একটাও আছে কিনা? ষড়া গাছের স্থায়ী বাসিন্দারা যাবে কোথায়? কিতাবে কি লেখা আছে এসব! জ্বীন-পরী লোকালয়ে ঘুরে বেড়াবে আর মানুষের ঘাড়ে ভর করে ভয় দেখাবে? তখন আপার মুখে একটু হাসির ঝিলিক খেলা করে, বললেন; ‘গাছ পাগলের সাথে পারা মুশকিল, সাবধানে থাকবে’-!
অবসরে অতিত চিন্তায় কখন রাত গভীর হয়েছে তা খেয়ালই নেই! অকস্মাৎ তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়, এক পলকেই নিভে যায়! বাস্তব সামনে দৃশ্যমান! কি আশ্চর্য ঘটনা! মাথার উপর দিয়ে আগুনের গোল্লা হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়, এমন কাছের ষড়া গাছে এসে মিলেয়ে গেল! গা ছমছম করা দম বন্ধ ভৌতিক পরিবেশ! ষড়া গাছে বাসা বাধা, টুনটুনি-মৌটুসী ঝুটকুলি ও বউ কথা কও পাখিরা কিচিরমিচির করে ওঠে, রাতের পাখিরা উড়াউড়ি করে। তখনো ষড়া গাছের পাতায় পাতায় মিটিমিটি আলো জ্বলে..
কখন তিন তলায় চলে এসেছি নিজেই জানি না। তড়িঘড়ি নামার শব্দে দোতালার বারান্দয় শুয়ে থাকা, জেরি (সারমেয়) কলাপসিবল গেটে এসে সাড়া দেয়। হঠাৎ কেন জানি ভয় কেটে যায়। জেরিকে সাথে নিয়ে ভালো ভাবে গাছটি পর্যবেক্ষণ, ভয়ে ভয়ে জানালা খুলে দেখা যায়, গোটা ষড়া গাছ জুড়ে, রাজ্যের জোনাকি পোকা মহাসমাবেশে ব্যস্ত
আক্তার হয়তো, এবারও ধোপাঘাটা সেতুর উপর দিয়ে আসার পথে চিলেকোঠায় আগুনের গোল্লা দেখে ভয় পেয়ে আসে নাই কিন্তু সকালে নিজের বানানো বিখ্যাত চা নিয়ে বন্ধু রেজা হাজির! নানা গল্পের মাঝেও বলা হয়নি বাস্তব গল্পটি! এমনিতে এইড এর ট্রেনিং সেন্টারে কোয়ারেণ্টাইন সেন্টার চলছে, তাই অনেকের ভয় ! তার মাঝে আগুনের গোল্লা, এখন কেন ষড়া গাছে। তার কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি খুঁজে কূলকিনারা পাওয়া যায়নি। যদি বিজ্ঞ জনেরা সমাধান দিতেন। সেই অপেক্ষায়-