শূন্যতা জানে শূন্যের ভেতরে কত ঢেউ..

লিটন রাকিব
লিটন রাকিব - সাহিত্য সম্পাদক
7 মিনিটে পড়ুন

খবরটি এখনও ঠিক যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না। দুঃস্বপ্ন; যদি সত্যিই দুঃস্বপ্ন হতো তাহলে কতই না ভালো হতো! এই কঠিন অন্ধকারময় সময়ে যে তাঁর বড়ই প্রয়োজন ছিল। নতুন বছরের শুরু থেকেই চলছিল কবির অন্তহীন লড়াই। বট পাকুড়ের ফেনার মতোই একসময় শান্ত নিথর হয়ে পড়তে হয়, তা কখনোই আবহমানকাল ধরে থাকে না। সবকিছুর শেষ আছে জীবনে; জীবনে শুধু স্মৃতির কোন শেষ নেই।

কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে এক পৃথিবী স্মৃতি রয়েছে যা অনন্তকাল বেঁচে থাকবে গহীন হৃদয়ে। কবিকে কখনো দূর থেকে কখনো বা কাছ থেকে দেখেছি। প্রাণ ভরে দেখেছি, দুচোখ ভরে দেখেছি। সারা জীবনটা ধরে তিনি একটি আদর্শ নিয়ে বেঁচে ছিলেন, কখনো মাথা নত করেননি কোনো অশুভ শক্তির কাছে। সে কারণেই আমার মত অনেকেই তাঁর সৃষ্টির কাছে আজন্ম নতজানু।

3 শূন্যতা জানে শূন্যের ভেতরে কত ঢেউ..
কবি শঙ্খ ঘোষের সাথে নতুন প্রজন্মের দুই কবি ভাই-(বোন লিটন রকিব ও আরফিনা)

স্নেহ-মমতায় তিনি আমাকে এবং আমার বোনকে যে আশ্রয় দিয়েছিলেন সেই বটবৃক্ষের প্রয়াণে যেন পিতৃশোক যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে ক্রমশ। হৃদয় টুকরো টুকরো হয়ে গেছে পবিত্র সংযমের মাসেও নিজেকে যেন ঠিক ধরে রাখতে পারছি না। আসলে তিনি ছিলেন জাতির বিবেক। সত্যিকারের অভিভাবক। ওর মধ্যে অসম্ভব ধরনের গুণ ছিল নারী-পুরুষের সংমিশ্রণে বিনির্মিত। সে কারণেই বোধহয় সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন মুহূর্তের মধ্যেই।

তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন তার সঙ্গে যে কিছুটা সময় কাটিয়েছেন তিনি কখনো ভুলতে পারেবেন না। আসলে তিনি ভুলতে দেন না; তিনি ভালোবাসায় ধরে রাখেন।

- বিজ্ঞাপন -

আমার মতো তরুণ একজন, পাহাড় প্রমাণ পাণ্ডিত্য প্রবীণ প্রথিতযশা কবি সম্পর্কে কি আর লিখব! খুব মনে পড়ছে করোনার আগেই এইতো সেদিন কবির বাড়িতে গিয়েছিলাম কবি’র আতিথেয়তা আপ্যায়নের কোন তুলনাই নেই; খাওয়া-দাওয়া তো ছিলই প্রবন্ধ, কবিতা, যাদবপুর, বর্তমান সময় পরিস্থিতি সবই আলোচনার মধ্যেই ছিল কিন্তু চলে আসার সময় কবি আমাকে আমার বোন আরফিনাকে চোখের জলে বিদায় দিয়েছিলেন। কবি কাঁদছিলেন আমরাও কাঁদছিলাম। শুধু এখানেই শেষ নয়, অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি আমাদের এগিয়ে দিতে এলেন দরজা পর্যন্ত, যতক্ষণ না আমি জুতো পড়লাম ততক্ষণ কবি দাঁড়িয়ে রইলেন। সে এক অন্য অভিজ্ঞতা। বললেন তুমি জুতো পড়ো তারপর আমি যাবো। এহেন আন্তরিকতা কখনো ভোলার নয়।

1 1 শূন্যতা জানে শূন্যের ভেতরে কত ঢেউ..
এক সাহিত্য আড্ডায় কবি শঙ্খ ঘোষের সাথে কবি লিটন রাকিব

প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। অসংখ্য সম্মানে সম্মানিত হয়েও অহংকার তাকে কখনও স্পর্শ করেনি। দু’বাংলায় তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয়। ওপার বাংলাই ছিল কবির জন্মস্থান। জন্মভূমিকে কখনো ভোলেননি তাই তিনি পরবর্তীতে বলেছিলেন, বাংলাদেশে কাটানোই শৈশব তাঁকে তার পরবর্তী জীবনকে নির্মাণ করে দিয়েছিল।

প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। যাদবপুর, দিল্লি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনাও করেছেন। অবসর নেন যাদবপুর থেকেই। তাই যাদবপুরের প্রতি ছিল আলাদা রকমের দুর্বলতা। সেকারনেই বোধহয় আমার কাছে খবর নিতেন তাঁর পুরানো কর্মস্থলের।

দেশভাগের সময় গর্জে উঠেছিল কবির কলম। তারপর বাংলা যখন ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে তখনও থেমে থাকেননি তাঁর লেখনি। তাঁর কলম বরবরই উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সরব। একটার পর একটা কালজয়ী কবিতা উপহার দিয়েছেন পাঠকদের। মধ্যবিত্ত বাঙালির মনন তাঁর মতো করে আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। সাধারণের নিজেকে নিয়ে দ্বন্দ্ব, আলো-অন্ধকারে ঘেরা জীবন, প্রবঞ্চনা-ভালোবাসার চেনা ছকই অচেনা হয়ে ধরা দিত তাঁর সৃষ্টিতে।

কবিতার পাশাপাশি গদ্যও লিখতেন তিনি। আসলে গদ্য হোক বা পদ্য, শঙ্খ ঘোষের প্রতিটি রচনায় থাকত এক অনন্য রসবোধ, বৈদগ্ধতার পরিচয়। যা পাঠকের মনকে শান্ত করে। নতুন করে ভাবতে শেখায়। সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসার জন্ম দেয়।

- বিজ্ঞাপন -
2 1 শূন্যতা জানে শূন্যের ভেতরে কত ঢেউ..
এক সাহিত্য আড্ডায় কবি শঙ্খ ঘোষের সাথে কবি লিটন রাকিব

‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান তিনি ১৯৭৭-এ। ১৯৯৯ কন্নড় ভাষায় নাটক অনুবাদের জন্য দ্বিতীয়বারের সাহিত্য একাডেমি পান। ওই বছরই ‘দেশিকোত্তম’ সম্মানে সম্মানিত হন কবি।

‘মূর্খ বড়, সামাজিক নয়’ কাব্যগ্রন্থের জন্য পান নরসিংহ দাস পুরস্কার। ১৯৮৯ সালে ‘ধুম লেগেছে হৃদকমলে’ কাব্যগ্রন্থের জন্য শঙ্খবাবুর হাতে তুলে দেওয়া হয় রবীন্দ্র পুরস্কার, ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’-এর জন্য পেয়েছিলেন সরস্বতী পুরষ্কার। ২০১৬ সালে ‘জ্ঞানপীঠ’ পুরস্কার ও ২০১১-য় ভারত সরকারের ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে সম্মানিত হন শঙ্খ ঘোষ।

তিনি যখন সবিনয় নিবেদন কবিতায় বলেন, তখন বোঝা যায় তিনি কতখানি সমাজ সচেতন আর প্রতিবাদ মুখর একজন কবি –

- বিজ্ঞাপন -

“আমি তো আমার শপথ রেখেছি
অক্ষরে অক্ষরে
যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন
দিয়েছি নরক করে।
দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল
অন্যে কবে না কথা
বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে
সেটাই স্বাভাবিকতা।
গুলির জন্য সমস্ত রাত
সমস্ত দিন খোলা
বজ্র কঠিন রাজ্যে এটাই
শান্তি শৃঙ্খলা।
যে মরে মরুক, অথবা জীবন
কেটে যাক শোক করে—
আমি আজ জয়ী, সবার জীবন
দিয়েছি নরক করে।”

অথবা, তিনি যখন শাসকের চোখে চোখ রেখে বলেন-

“দেখ্ খুলে তোর তিন নয়ন
রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে
দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন।”

সেই পঞ্চাশ দশক থেকে অতি নীরবে রাজনীতির সঙ্গে, জনজীবনের সঙ্গে কবিতার সাঁকো বাঁধার কাজটা করেছিলেন তিনি। তাঁর কবিতা জীবন ছুঁয়ে থেকেছে কিন্তু কখনও স্লোগান হয়ে যায়নি। তাঁর কবিতা আসলে শেখায় প্রেম ও প্রতিবাদের ভাষা! সে কারণেই বোধহয় কবি অনায়াসেই উচ্চারণ করতে পারেন- “মাটিতে বসানো জালা, ঠান্ডা বুক ভরে আছে জলে
এখনও বুঝিনি ভালো কাকে ঠিক ভালোবাসা বলে।”

শেষের দিকে কথা বলতে পারতেন না, হাত কাঁপতো লিখতে ভীষণ অসুবিধা হতো, তবুও কিন্তু আমাদের মতো তরুণ কবিদের নতুন প্রজন্মকে সাহিত্যের কাজে উৎসাহ যুগিয়েছেন নিরন্তন। তাঁর চলে যাওয়াটা অপ্রত্যাশিত। তিনি চলে গেলেন ঠিকই কিন্তু রেখে গেলেন তাঁর অপার সৃষ্টি।

সকাল, বিকেল তাই শব্দ আর সত্যের মতো মুহুর্মুহু বেজে চলেছে-

“এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হও
শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর।

লেখো আয়ু লেখো আয়ু

ভেঙে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান, ওড়ে ঝড়
তোমার চোখের নিচে আমার চোখের চরাচর
ওঠে জেগে

স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ
আয়ু

received 1498658563808093 শূন্যতা জানে শূন্যের ভেতরে কত ঢেউ..
কবি শঙ্খ ঘোষের সাথে নতুন প্রজন্মের দুই কবি ভাই-বোন (লিটন রকিব ও আরফিনা)

লেখো আয়ু লেখো আয়ু
চুপ করো শব্দহীন হও।”

received 228733765366242 শূন্যতা জানে শূন্যের ভেতরে কত ঢেউ..
কবি শঙ্খ ঘোষ এর সাথে লিটন রাকিব

বৈশাখী বিকেলে অনন্তলোকের পথে চিরবিদায় নিলেন কবি। শূন্যতা জানে শূন্যের ভেতরে কত ঢেউ; সারা জীবনের শূন্যতা …
চুপ করো শব্দহীন হও; ছন্দের বারান্দায় তিনি আছেন, ছিলেন, থাকবেন! আমি যদি না-ও থাকি তবুও আমিই পড়ে থাকে!”

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
সাহিত্য সম্পাদক
লিটন রাকিব মূলত কবি। সহজ সরল ভাষা ও গভীর জীবনবোধ থেকে উৎসারিত তাঁর সৃষ্টি। ভালোবাসেন অরন্যের মত নির্জনতা। প্রথম কবিতা গ্রন্থ 'ঋতুর দান', ছড়া গ্রন্থ 'ছড়া দিলেম ছড়িয়ে' এবং সম্পাদিত গ্রন্থ 'গ্রামনগর ' এছাড়াও দীর্ঘদিন সম্পাদনা করে আসছেন 'তরঙ্গ ' পত্রিকা। প্রতিষ্ঠা করেছেন ভিন্নধর্মী সংগঠন 'আলোপথ'। তিনি নিয়মিত একাধিক দৈনিক সংবাদ পত্র সহ অনান্য পত্রিকায় লিখে চলেছেন। দেশে বিদেশে একাধিক সম্মানে সম্মানিত তরুন এই কবি ও গবেষক। এছাড়াও তিনি সাময়িকী'র সাবেক সাহিত্য সম্পাদক।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!