আকাশে প্রচুর কালো মেঘ জমলে, তুমুল হাওয়া বইতে শুরু করলে, আকাশ বিদীর্ণ করে মেঘ ডাকলে, তার সঙ্গে ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকালে এবং মুষলধারে বৃষ্টি— এই সব ক’টা একসঙ্গে শুরু হলেই মধ্য আমেরিকার হন্ডুরাসের লোকেরা বুঝতে পারেন, এ বার মাছ বৃষ্টি হবে। বুঝবেন নাইবা কেন, একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে যে এটা হচ্ছে!
প্রতি বছর মে থেকে জুলাই মাসের মাঝামাঝি এই বৃষ্টির সঙ্গে মাটিতে আছড়ে পড়ে লক্ষ লক্ষ জীবন্ত মাছ। তাও একবার নয়, বছরে অন্তত দু’বার। তবে না, এই মাছগুলো সাধারণত ছ’ইঞ্চির বেশি হয় না।
এটা হয় মূলত হন্ডুরাসের ইউরো শহরে। এই শহরের লোকজন এই মাছ কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে রান্না করে খান। এটা তাঁদের কাছে এতটাই আনন্দদায়ক ঘটনা যে, ১৯৯৮ সাল থেকে এই ঘটনাকে ঘিরে প্রতি বছর উৎসবের আয়োজন করা হয়।
স্থানীয়রা এই ঘটনাটাকে বলেন, ‘জুভিয়া দে পেতেস’ (Lluvia de Peces)। এই স্প্যানিশ শব্দটির অর্থ হল— মাছের বৃষ্টি। আকাশ থেকে অঝোরে ঝরে পড়তে থাকে মাছ, স্কুইড, ব্যাঙ ও আরও কত কী! স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ সময় রীতিমত লোক নামিয়ে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করাতে হয়।
একটা সময় পর্যন্ত এ অঞ্চলের বহু মানুষ বিশ্বাস করতেন যে, উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি, মানে ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৪ সালের মধ্যে হন্ডুরাসে আসা ক্যাথলিক ধর্মযাজক হোসে সুবিরানার আশীর্বাদেই এই মাছ-বৃষ্টি হয়।
উনি যখন হন্ডুরাসে আসেন, তখন এই অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষই অত্যন্ত অভাব, অনটন আর দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটাতেন। দু’বেলা খাওয়া পর্যন্ত জুটত না। তাঁদের সেই দুর্দশা দূর করার জন্যই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করেন তিনি। তাঁর প্রার্থণার পর থেকেই নাকি স্বয়ং ঈশ্বর আকাশ থেকে এই ‘মাছের বৃষ্টি’।
যে এলাকায় প্রতি বছর একেবারে নিয়ম করে এই মাছের বৃষ্টি হয়, আটলান্টিক মহাসাগর থেকে সেটা প্রায় দুশো মাইল দূরে। তাই অনেকে মনে করেন, আটলান্টিক মহাসাগরের টর্নেডো বা সামুদ্রিক ঝড়ই আটলান্টিক মহাসাগর থেকে এই মাছগুলোকে উড়িয়ে এনে এ অঞ্চলে ফেলে। কিন্তু এ রকম ঘটনা প্রতি বছর কী করে সম্ভব, তা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। এর পাশাপাশি এই মাছ-বৃষ্টি নিয়ে অনেক লোককথাও প্রচলিত আছে।
শোনা যায়, ১৯৭০ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ দলকে পাঠানো হয়েছিল হন্ডুরাসে। তাঁরা জানান, এই অঞ্চলে আকাশ থেকে যে সব মাছের বৃষ্টি হয়, তা কোনও সমুদ্রিক মাছ নয়। সেগুলো মিষ্টি জলের মাছ। অর্থাৎ, আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়া মাছগুলো কোনও নদী, পুকুর বা হ্রদের মতো মিষ্টি জলাশয়ের মাছ। শুধু তাই-ই নয়, বেশির ভাগ মাছই প্রায় একই প্রজাতির।
বেশ কিছু বিজ্ঞানী অবশ্য এই সব মাছ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেছেন, এই মাছগুলো দৃষ্টিহীন। মানে এই মাছগুলো সমুদ্রের অনেক গভীরে থাকে। যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছয় না। ডাঙায় যে টর্নেডো হয়, তার গতিবেগ থাকে ঘণ্টায় তিনশো কিলোমিটার। জলে সেটা একশো কিলোমিটার। তাতেই সমুদ্রের তলদেশ থেকে এই মাছগুলোকে তুলে এনে এখানে ছুড়ে ফেলে।
শুধু হন্ডুরাসেই নয়, এই রকম মাছের বৃষ্টির কথা শোনা গেছে আরও বহু জায়গাতেই। ১৮৬১ সালে সিঙ্গাপুরেও হয়েছিল মাছ-বৃষ্টি। ১৯৪৭ সালের ২৩ অক্টোবরে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানায়। ২০১০ সালের
২৬ ফেব্রুয়ারিতে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চলের রাজামারুতে। তবে জীবিত নয়, ছোট ছোট সাদা মাছগুলোকে দেখে মনে হয়েছিল, ফ্রিজে রাখা মাছ। এই একই রকম মাছ-বৃষ্টি হয়েছিল থাইল্যান্ডেও।
হঠাৎই একদিন শ্রীলঙ্কার চিলাও গ্রামে শুরু হয় মাছ-বৃষ্টি। ওখানকার লোকেরা দেখেন, বৃষ্টির সঙ্গে অবাধে ঝরছে বেশ ছোট ছোট মাছ। মাছগুলো একদম তরতাজা। কোনও কোনওটা দিব্যি লাফাচ্ছে। তাঁরা কুড়োতে শুরু করেন। মাছ ভর্তি পাত্রে জল ঢালতেই দেখা যায়, লাফিয়ে উঠছে সেই সব মাছ।
শ্রীলঙ্কার এই মাছ-বৃষ্টির খবর ফলাও করে জানিয়েছে বিবিসি-সহ বহু আন্তর্জাতিক মিডিয়াও।
গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, ঘরের চালে আকাশ থেকে ভারী কিছু পড়ার শব্দে তাঁরা বাইরে বেরিয়ে আসেন। এসে দেখেন, ঘরের চালে, বাড়ির উঠোনে, মাঠে ঘাটে, এমনকী রাস্তাতেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে তিন থেকে পাঁচ ইঞ্চি লম্বা এই মাছগুলো।
খাওয়ার উপযোগী এই মাছ প্রায় পঞ্চাশ কিলোর মতো ওই গ্রামের বাসিন্দারা সে দিন কুড়িয়েছিলেন বলে জানায় বিবিসি।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ‘মাছ-বৃষ্টি’ অস্বাভাবিক হলেও প্রকৃতিতে এটা ঘটে থাকে। মাছ ভর্তি কোনও কম গভীরতার জলাশয়ের ওপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেলে এমন জলঘূর্ণি হতে পারে। তখন জলে থাকা মাছ, ব্যাঙ-সহ সব কিছুই ঘূর্ণিবায়ুর সঙ্গে আকাশে উঠে যায়। আকাশে উঠে যাওয়ার পর ঝড়ের সঙ্গে অনেক দূরে চলে যেতে পারে এ সব জলজ প্রাণী। এমনকী, এই জলঘূর্ণি থেমে যাওয়ার পরও মেঘের স্তরের কারণে এরা সাময়িক ভাবে আটকে থাকতে পারে ওপরেই। আর তুমুল ঝড়-জলের সঙ্গে মেঘের ভেতর থেকে ঝরে পড়তে শুরু করে ওই সব জলজ প্রাণী।
শ্রীলঙ্কায় এই মাছ-বৃষ্টি অবশ্য সে বারই প্রথম নয়। ২০১২ সালে দেশটির দক্ষিণা লে-তে ‘চিংড়ি-বৃষ্টি’ হওয়ার কথাও জানা গেছে।
সেই একই বছরে লাল ও হলুদ রঙের শিলাখণ্ডের অস্বাভাবিক শিলাবৃষ্টিও হয়েছিল শ্রীলঙ্কায়। ওই শিলাগুলো মহাকাশ থেকে পড়েছে বলেও মন্তব্য করেন বেশ কিছু বিজ্ঞানী।
অনেকে এটাকে অলৌকিক ঘটনা মনে করলেও, মার্কিন এবং ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা মহাকাশের এই শিলাবৃষ্টি এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের এই মাছ-বৃষ্টি নিয়ে ইতিমধ্যেই গবেষণা শুরু করে দিয়েছেন।