শরীরটা ছোট হয়ে গেছে। যন্ত্রনায় ধুঁকতে ধুঁকতে বিছানায় মিশে যাওয়া দিদির একফোঁটা শরীর। একসময় সুন্দরী হিসাবে নাম ডাক ছিল। নাচ জানতেন। কলেজ সোশালে দুবার কত্থক নেচে ষ্টেজ কাঁপিয়েছেন। তারপর অনেক অনুষ্ঠান। আলমারি ভর্তি দিদির নাচের পুরস্কার। জামাইবাবু ধুলো ঝেড়ে সাজিয়ে রাখতেন। জামাইবাবু মারা যাবার পর সেসব কোথায় গেল কে জানে! রিঙ্কু কিছুরই খেয়াল রাখত না। উদাসীন টাইপের ছেলে। কালে ভদ্রে আমি গেলেও ভালো করে কথা বলতো না। পড়াশোনায় ভালো ছিল। কলেজ, তারপর বিশ্ববিদ্যালয় ডিঙ্গিয়ে একদিন বিদেশ চলে গেল। আমেরিকা। দু’বছর পর শীতের ছুটিতে ওর মাকে দেখতে এসেছিল একবার। দিদি তখন শয্যাশায়ী। জামাইবাবু বিপর্যস্ত। চিকিৎসার খরচ যোগাতে হিমসিম। কী একটা বিষয়ে নাকি রিঙ্কুর সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছিল। রাগ করে রিঙ্কু বলেছিল, ‘তোমার বাড়িতে আর আসবোই না কোন দিন’।
সত্যিই রিঙ্কু আর আসেনি। জামাই বাবুর মৃত্যুর খবর শুনেও। আজ আসবে কি? গতকাল দিদির মৃত্যু সংবাদ ই-মেলে জানিয়েছি। ফোন ধরেনি ও। আসবে জানলে ডেড বডি পিস হেভেনে আরও দু’দিন রেখে দিতাম। এখন পিস হেভেনের সামনে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আমরা। স্ত্রী রমা, ওর ভাই আর দিদির রাঁধুনি সরমা। আমার মেয়ে আসতে পারে নি। সদ্য চাকরীতে যোগ দিয়েছে ও। নিচু গলায় কী করনীয় আলোচনা করছি আমরা। হঠাৎ বুক পকেটে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। মনিটরে রিঙ্কু। ওর গলাটা আগের থেকে ভারি হয়েছে অনেক। মার্জিত স্বর। বলল, ‘মামা এখন যেতে পারবো না। হাতে প্রচুর কাজ। তোমরা পুড়িয়ে দাও’।
বুক ভাঙা একটা শ্বাস বেড়িয়ে এল। ধীরে ধীরে একবার ‘আচ্ছা’ উচ্চারণ করে ফোনটা পকেটে রাখলাম। খানিক পরে দিদির শরীরের দিকে তাকালাম। শরীরটা ছোট হয়ে গেছে। যন্ত্রনায় ধুঁকতে ধুঁকতে বিছানায় মিশে যাওয়া দিদির একরত্তি শরীর। বৈদ্যুতিক চুল্লিতে ঢুকবে সাদা কাপড়ে ঢাকা দেহ। পুজো মন্ত্রপাঠ হয়ে গেছে। বৃদ্ধ পুরোহিত বললেন, ‘সব আয়োজন সম্পূর্ণ, আর একটু অপেক্ষা করুন’।
অপেক্ষার চাতালে বসে খুঁত খুঁত করছে মনটা। কি যেন একটা নেই! আমি হাঁটু মুড়ে বসে। আমার পিঠে হাত রাখল রমা। বাঁ’দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি ওর পাশে সরমা। সরমা অনেকটা ঝুঁকে চার-পাঁচটা চাঁপা ফুল দিদির বুকের কাছে রাখল। টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল সাদা চাদরে।
যাক, দিদির মৃত্যুতে কেউ তো একজন চোখের জল ফেলল। একজন মারা যাবে আর কেউ কাঁদবে না?