‘হোম সুইট হোম’ নামের একটি মাত্র কবিতা লিখেই পৃথিবীর সর্বত্র ‘জন হাওয়ার্ড পেইন’-এর নাম কবি হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে এবং সে সময় সমস্ত কবিতা প্রেমিকের মুখে মুখেই এই কবিতার লাইনগুলো অনবরত শোনা যেত। কবিতাটা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই অনুবাদ হয়ে যায় নানান ভাষায়। ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। কবিতাটির প্রতি শব্দের ভাঁজে ভাঁজে সুরকারেরা খুঁজে দেন সুর। শুধুমাত্র একটি কবিতার জন্য এত জনপ্রিয়তা সম্ভবত অন্য আর কোনও কবির ভাগ্যে জোটেনি। কবিতাটি লেখা হয়েছিল ছবির রাজধানী প্যারিসে। যেখানে অঢেল শ্যাম্পেন, কফি আর প্রাচুর্য। যে সময়ে কবিতাটি কবি লিখেছিলেন, ঠিক সেই সময় তাঁর দুটি পকেটই ছিল একদম খালি। প্রাচুর্যের মালভূমিতে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ন কপর্দকহীন কবি লিখে ফেললেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা— হোম সুইট হোম। পরে যার বাংলা অনুবাদ হয়, ‘ঘর সুন্দর ঘর’। কবির শুধু এই কবিতাতেই নয়, তাঁর অন্যান্য কবিতাতেও ধরা পড়েছে ছোট্ট একটি ঘরের স্বপ্ন। সারাটা জীবন ধরে ঘরের স্বপ্ন দেখে গেছেন কবি। ঘরই ছিল তাঁর আশা। ঘরই ছিল তাঁর একমাত্র চাওয়া। ঘরই ছিল তাঁর কাছে সব কিছু। কিন্তু ঘর তো দূরের কথা, একটা বারান্দাও ছিল না তাঁর। তিনি থাকতেন একটি পরিত্যক্ত পার্কের পাপে বড় একটি গাছের তলায়। ছোট্ট মতন একটি ঝুপড়ি বানিয়ে।
একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ করে এত প্রবল জোরে তুষারপাত শুরু হল যে, তাঁর কোনও রকমে জোড়াতাপ্পি দিয়ে বানানো অস্থায়ী ঝুপড়ির ছাউনিটা এক ঝটকায় উড়িয়ে নিয়ে গেল দমকা বাতাস। কোথায় মাথা গুঁজবেন তিনি! দিশেহারা হয়ে ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সামনের একটা বাড়ির ঝুল-বারান্দায় নীচে। কিন্তু তাতেও তুষার ঝাপটার হাত থেকে নিজেকে কিছুতেই বাঁচাতে পারছিলেন না। বেশ খানিকটা ভিজেও গিয়েছিলেন। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছিলেন। এমন সময় তাঁর কানে ভেসে এল একটা পরিচিত গানের সুর। কান পেতে শুনলেন, সমবেত ভাবে কারা যেন তাঁর ‘হোম সুইট হোম’ গানটা গাইছে। কারা? দরজার ঘুলঘুলিতে চোখ রাখলেন কবি। দেখলেন, কিছু তরুণ ছেলেমেয়ে আগুন পোয়াচ্ছে আর হাততালি দিয়ে দিয়ে গানটি গাইছে।
তিনি মনে মনে ভাবলেন, গানটি আমার লেখা, এই পরিচয় দিলে হয়তো এখানে একটু আশ্রয় পাওয়া যেতে পারে। মিলতে পারে ফায়ার প্লেসের আগুন পোয়ানোর সুযোগ। এই আশা নিয়েই তিনি দরজা ধাক্কালেন। একটি মেয়ে এসে দরজা খুলতেই তিনি তাঁর পরিচয় দিলেন। কিন্তু তাঁর ভিখিরির মতো পোশাক-আশাক আর তাঁর চেহারা দেখে তাঁর কথা সে বিশ্বাস করল না।
এই দুর্যোগের রাতে কে এল? দেখার জন্য যারা ওই মেয়েটির সঙ্গে দল বেঁধে গান গাইছিল, ততক্ষণে গান থামিয়ে তারাও বেশ কয়েক জন মেয়েটির পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। লোকটির কথা শুনে তারা ভাবল লোকটা নিশ্চয়ই একটা পাগল। তাই আর কথা না বাড়িয়ে মুখের সামনে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল।
ছেলেমেয়েগুলোর এই ব্যবহারে তিনি এতটাই মর্মাহত হলেন যে, তখনই তিনি ওই তুষার-ঝড়ের মধ্যেই বারান্দা থেকে রাস্তায় নেমে এলেন।
‘হোম সুইট হোম’ লেখার এক বছর পরেই গৃহহীন এই কবি সে দিনের সেই তুষারপাতে ভিজে মারাত্মক টিউনিস রোগে আক্রান্ত হন এবং ক’দিন পরেই ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।
আমরা জানি না, মারা যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সেই কাঙ্খিত ছোট্ট বাড়িটির স্বপ্ন তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল কি না।