তিনি আমাদের জাতীব কবি। অথচ উইকিপিডিয়া লিখছে an Indian poet. চুরুলিয়ায় জন্ম বলে তিনি অবশ্য ই ভারতীয়। কিন্তু আমরা যখন তাঁকে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছি তখন উচিৎ ছিলো তথ্য উপাত্তে এ সত্যটিও তুলে ধরা। যা হতে পারতো বা এখনো পারে তা না হবার কারণ আমরা সবাই বুঝি। যে জোশ বা উন্মাদনায় তাঁকে আপন মনে করা হয় সেটি খুব সাময়িক। মূলত যিনি প্রেমের যিনি বেদনার ও আবেগঘন দ্রোহের তাঁকে ধর্মীয় বৃত্তে আবদ্ধ করাটাই ভুল।
তিনি তাঁর পুত্রদের নাম কি কি রেখেছিলেন? সব্যসাচী, অনিরুদ্ধ আর? কৃষ্ণ মোহাম্মদ। ভাবা যায় এখন? এটাই তাঁর বৈশিষ্ট্য। বাংলা শিল্প সংস্কৃতিতে এমন অসাম্প্রদায়িক মানুষ দ্বিতীয় কেউ নাই। অথচ আমাদের সংকীর্ণ চিন্তায় আমরা তাঁকে আবদ্ধ করেছি এমন এক খাঁচায় আজ যা জানালা দরজাহীন। বুকে হাত দিবে বলুন তো এখন মানে এই প্রজন্মে নজরুল গীতি ভালো গায় এমন ক জনের নাম আপনি জানেন? লিচু চোর বা গাহি সাম্যের গান কিংবা চল চল চলের বাইরে আর কি কি কবিতা জানেন? তাঁর কোন গদ্য আপনার প্রিয়? গানের কথাই যদি বলি বাচ্চাদের আমরা শেখাই প্রজাপতি প্রজাপতি কোথায় পেলে ভাই এমন রঙ্গিন পাখা? কিংবা একটু বড় হলে কন্যা শুকনো পাতার নূপুর পায়ে নাচিছে ঘুর্ণি বায়ের সাথে নাচতে শেখে। আর মধ্যবয়সে মাঝে মাঝে কন্ঠে আসেন তিনি। তাও আমি যার কথার কুসুম ডালা কিংবা মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর । অত:পর? একটাই ভরসার জায়গা এখন অনেকেই তাঁর জীবনী ও জীবন কাহিনী নিয়ে লিখছেন অসাধারণ সব উপন্যাস কিংবা মৌলিক গদ্য ।
আমরা বিদ্রোহী বা রণসঙ্গীতের কঠিন ইমেজের কাজী নজরুলের বাইরে রসিক যে নজরুল কে চিনি না তাঁর কয়েকটি গল্প বলি। বলাবাঊল্য এ সব ই আছে ইতিহাসে। আছে নানা কাহিনী জুড়ে।
কবির এক বন্ধু ছিল, শৈলেন নাম। কবি তার কাছ থেকে কেবল চা খেতেন। আর প্রতিদিন শৈলেনের কাছ থেকে চা খাওয়ার জন্য নিত্যনতুন ফন্দি আঁটতেন। একদিন আর কোনো ফন্দি-ফিকির না পেয়ে কী করলেন; শৈলেনের কাছে গিয়ে বললেন, ‘তুমি তো অনেক টাকা পাবে আমার কাছে, হিসেব করে রেখো, আপাতত দু পেয়ালা চা দাও।’ শৈলেন তো অবাক! এ আবার কেমন কথা! অনেক টাকা পাওয়ার সঙ্গে দু পেয়ালা, মানে দুই কাপ চায়ের কী সম্পর্ক? তিনি চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দু পেয়ালা কেন?’
কবি বললেন, ‘আরে, লাখ পেয়ালা চা না খেলে টাকা হয় না। লাখ পেয়ালা হতে আমার এখনো দু পেয়ালা বাকি আছে।’ এমন কথার পর কোনো বন্ধু চা না খাইয়ে থাকতে পারে, বলো!
একজন অ-বাঙালি ভদ্রলোক কবির খুব ভক্ত ছিলেন। কবিকে তিনি অনেক সময় অনেকভাবে সাহায্য করতেন। কোনো একদিন কলকাতায় কবির বাড়িতে কয়েকজন অভ্যাগতর সঙ্গে কবি গল্পগুজব করছেন। সেই অ-বাঙালি ভদ্রলোকও ছিলেন। একসময় তার সঙ্গে কবির হিন্দি বনাম বাংলা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা হচ্ছিল। ভদ্রলোকটি হিন্দি ভাষার জন্য ওকালতি করছিলেন। কবি হাসতে হাসতে বললেন, ‘যাও! যাও! তোমাদের হিন্দি ভাষা তো কুকুর বেড়ালের ভাষা!’ শুনে ভদ্রলোকটি একটু ক্ষুণ্ন হয়ে বলে উঠলেন, ‘কেঁও?’ অমনি কবি বলে উঠলেন, ‘ওই দেখ কুকুরের ডাক ডাকলে!’ ভদ্রলোকটি কবির কথায় রাগ না করে হেসে বললেন, ‘হুয়া হুয়া!’ কবি বললেন, ‘ওই দেখ শিয়ালের ডাক ডাকলে, আমি ঠিক বলিনি?
অসামান্য প্রতিভাবান কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন ইসলামি হামদ, নাত, গজল রচনা শুরু করলেন, তখনকার একটি ঘটনা । শিল্পী আব্বাসউদ্দিন একদিন অনেক খোঁজাখুজি করে নজরুলকে না পেয়ে সকালে তার বাসায় চলে গেলেন। বাসায় গিয়ে দেখলেন নজরুল গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন লিখছেন । নজরুল ইশারায় আব্বাসউদ্দিনকে বসতে বললেন আব্বাসউদ্দিন অনেকক্ষণ বসে থাকার পর জোহরের নামাজের সময় হলে তিনি উসখুস করতে লাগলেন ।
নজরুল বললেন ‘কী, তাড়া আছে, যেতে হবে?’
আব্বাসউদ্দিন বললেন ‘ঠিক তাড়া নেই, তবে আমার জোহরের নামাজ পড়তে হবে। আর এসেছি একটা ইসলামি গজল নেবার জন্য। গজল না নিয়ে আজ যাওয়া হচ্ছে না।’ (নজরুলকে যেহেতু বাউন্ডুলে স্বভাবের কারণে পাওয়া যেত না, তাই সবাই এইভাবে লেখা আদায় করত!)
নামাজ পড়ার কথা শুনে নজরুল তাড়াতাড়ি একটি পরিষ্কার চাদর তার ঘরের আলমারি থেকে বের করে বিছিয়ে দিলেন। এরপর আব্বাসউদ্দিন যথারীতি জোহরের নামাজ শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে নজরুল তাঁর হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন ‘এই নাও তোমার গজল।’ এই গজলটিই হলো–‘হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড় আজ/ দিলাম তোমার চরণ তলে হৃদয় জায়নামাজ…’
অসামান্য প্রতিভাবান নজরুল ইসলামকে আমরা সেভাবে মনে রাখি না । এই দেখুন না ভূপেন হাজারিকা বাঙালির কানে কানে মনে মনে ঢুকিয়ে দিলেন, সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনাতে নজরুল…. আচ্ছা বলুন তো যাঁর এমন অভিভাবক থাকে তিনি যোগ দেন বিজেপি নামের ধর্মীয় সংগঠনে ?
তাই আমাদের কবি কেবল ই আমাদের দু:খ আর বেদনার এক গোলাপ। মান অপমানের কাঁটায় ঘেরা কাজী গোলাপ। সৈয়দ মুজতবার কথায় সকল কাজের কাজী। প্রিয় কাজী নজরুল ইসলাম মানেই অরুণ কান্তি কে গো যোগী…