স্মরণে হাবীবুল্লাহ সিরাজী
পৌঁছনোর কথা ছিল সন্ধেবেলায়। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় যানজটে আমাকে এতক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল যে, ঢাকায় গিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন রাত দশটা বেজে গেছে।
গিয়েছিলাম ঢাকার জাতীয় কবিতা উৎসবে। কথা ছিল, উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে আমার জন্য কেউ না কেউ অপেক্ষা করবে। কিন্তু বাসস্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে আসার পর দেখি আশেপাশে কেউ নেই।
না, তখনও আমার সঙ্গে ততটা গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি নির্মলেন্দু গুণ, সেলিনা হোসেন, মোহিত কামাল, শরীফা বুলবুল, গোফুর হোসেন, ভারতীয় হাইকমিশনের নান্টু রায়, এমনকী ঢাকা পুলিশে কর্মরত, তরুণ কবি, ২০১৮ সালে একুশে গ্রন্থমেলায় আমার বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে ৯খানা বই প্রকাশ উপলক্ষে আমি যখন ঢাকায় যাই, গিয়ে হারিয়ে ফেলি আমার ট্রাভেল ব্যাগটি, যার মধ্যে ছিল আমার পাসপোর্ট, আমাকে বাইকে চাপিয়ে প্রায় ঘণ্টা তিনেক গোটা ঢাকা শহর চষে যিনি উদ্ধার করে দিয়েছিলেন সেই ব্যাগ এবং পাসপোর্ট, সেই প্রদীপ দত্তেরও।
ফলে আমন্ত্রণপত্রে লেখা ল্যান্ড এবং মোবাইল নম্বরগুলিতে একের পর এক ফোন করতে লাগলাম। কোনও নম্বর বিজি, তো কোনটা নট রেসপনডিং, না হলে রিং হয়ে যাচ্ছে তো হয়েই যাচ্ছে।
কেউই ফোন ধরছেন না। সে বারই যে ঢাকায় আমি প্রথম, তা কিন্তু নয়। কুড়ি বছর আগেই আমি প্রথম গিয়েছিলাম সালেম সুলেরীর আমন্ত্রণে। গিয়ে উঠেছিলাম তোপখানা রোডে। তার পর থেকে উঠি আলমগীর হোসেনের সেন্ট্রাল রোডের বাড়িতে।
কিন্তু তাঁরা কেউই তখন ঢাকায় নেই। ফলে ফোন করতে করতে যখন হাল ছেড়ে দিয়েছি, প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি পরের সৌহার্দ্য বা শ্যামলীতে চেপে কলকাতা ফিরে আসব, কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করছি পরবর্তী বাস কখন? ঠিক তখনই, আমার ফোন বেজে উঠল। দেখি, একটি আননোন নাম্বার। কিন্তু প্রথম দিকে যে কোড নম্বরটি রয়েছে, সেটা বাংলাদেশেরই।
আমি ফোনটা ধরতেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল— আমি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলছি। আপনি কোথায়?
আমি তো ওঁর নাম্বার জানি না। উনি আমার নাম্বার জানলেন কী করে! তা হলে কি এই জাতীয় কবিতা উৎসবে যাঁদের আমন্ত্রণ করা হয়েছে, তাঁদের প্রত্যেকের নাম্বারই উনি লিখে রেখেছেন!
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, আমি তো ঢাকায়। বাসস্ট্যান্ডে।
— এখনও বাসস্ট্যান্ডে কেন?
আমাকে নেওয়ার জন্য জাতীয় কবিতা উৎসবের কোনও প্রতিনিধিকে এখানে দেখতে পাচ্ছি না এবং কেউই আমার ফোন ধরছেন না শুনেই তিনি বললেন, তাই নাকি? ঠিক আছে, দাঁড়ান। আমি এক্ষুণি লোক পাঠাচ্ছি।
উনি লোক পাঠিয়েছিলেন। আমাকে যেখানে রাখা হয়েছিল পর দিন সকালে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে গিয়েছিলেন। দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন আগের রাতের অবাঞ্ছিত ঘটনার জন্য।
তিনি যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলাম আনন্দ পাবলিশার্স থেকে সে বছরেই প্রকাশিত আমার কবিতার বই— দোহাই আপনার।
শিল্পকলা আকাদেমি থেকে ধ্রুব এষ যখন আমাদের জাতীয় কবিতা উৎসবে নিয়ে এলেন, শুনলাম হাবীবুল্লাহ সিরাজী আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন।
দেখা করতেই সকালে দেওয়া বইটি সম্পর্কে উনি এমন প্রশংসা করলেন এবং কবিতার বিভিন্ন লাইন তুলে এমন ভাবে মন্তব্য করলেন, আমি বুঝতে পারলাম এর মধ্যেই উনি পুরো বইটা পড়ে ফেলেছেন।
তার পরেই বললেন এটা রাখুন। বলেই, আমার হাতে একটি খাম ধরিয়ে দিলেন। কীসের খাম বুঝতে না পেরে তাঁর সামনে খুলতেই দেখি, ভেতরে বেশ কিছু টাকা।
পরে শুনলাম, ভারত থেকে যে সব প্রতিনিধি দিয়েছেন তাঁদের প্রত্যেকের জন্য শুধু থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাই উনি করেননি, একটা সাম্মানিকের ব্যবস্থাও করেছেন। উনি ছিলেন ওই জাতীয় কবিতা উৎসবের প্রাণপুরুষ।
সেই যে তাঁর সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তখন থেকেই, আমার চেয়ে বয়সে প্রায় কুড়ি বছরের বড় হলেও, আমি তাঁকে দাদা নয়, সিরাজী ভাই বলেই ডাকতাম।
তার পরেও বহু বার তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। কখনও কলকাতা বইমেলায়। কখনও ঢাকার বাংলা আকাদেমিতে। কখনও আবার নিউইয়র্কের বইমেলায়। আর প্রতিবারই টের পেয়েছি, কলকাতার প্রতি তাঁর অগাধ ভালবাসা এবং ভেতর থেকে একটি অকৃত্রিম টান। যে টান একেবারে নাড়ির টানের মতোই অমোঘ।
বাংলা একাডেমির এই মহাপরিচালক ৭৩ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ঠিকই, কিন্তু উনি চলে গেছেন বলেই যে, সেই টান আলগা হয়ে গেল, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই।