অধ্যাপক আলী রীয়াজের ফেসবুক থেকে –
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিল্লুর রহমান খান শনিবার বিকেলে ফ্লোরিডার অরলান্ডোতে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর পরিবার ও নিকটজনের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা, আমার গভীর শোক। তাঁর জীবনাবসান বাংলাদেশ স্টাডিজের জন্যে একটা বড় ক্ষতি।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা বারোটি। এর মধ্যে অনেক বইই আছে যেগুলো বাংলাদেশের রাজনীতি বোঝা এবং সেই বিষয়ে একটা সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্যে অবশ্যপাঠ্য। তাঁর লেখা পাঠ করে আমার মনে হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং নেতৃত্বের প্রশ্নটি তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বোঝার চেষ্টা করেছেন এবং সে বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত বই Leadership in the Least Developed Nation, Bangladesh, ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত Leadership Crisis in Bangladesh: Martial Law to Martial Law এবং ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত বই The Third World Charismat: Sheikh Mujib and the Struggle for Freedom তার অন্যতম উদাহরণ। তাঁর একাডেমিক কাজে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ভুমিকার প্রশ্ন এসেছে বারবার – সেটি নেতৃত্বের প্রশ্নকে বিবেচনা করার দিক থেকেই। বাংলাদেশের রাজনীতি বিষয়ক বৈঠকি আলোচনায় নেতৃত্বের প্রশ্নটি যতটা আলোচিত হয়, একাডেমিক পর্যায়ে সেই তুলনায় আলোচনা কম। জিল্লুর রহমান খান সেই ধরণের কাজ করেছেন বলেই তাঁর আলোচনাগুলো আমাদের পাঠ করা দরকার।
অধ্যাপক জিল্লুর রহমান খানের সঙ্গে গত প্রায় দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যত্র একাধিক সন্মেলনে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছে। ডক্টর জিল্লুর রহমান খানের কাজের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রপাত ১৯৮০-এর দশকের মাঝমাঝি থেকে, কিন্ত ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও কথাবার্তার সূচনা ১৯৯৫ সালের পরে। বিবিসি বাংলা বিভাগে কাজের সময় বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি বিষয়ে তাঁর সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছি। পরে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসার পরে আমার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত ঘটে একাডেমিক সম্মেলনে। জিল্লুর ভাই একাধিক অনুষ্ঠানে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে আমাদের এই যোগাযোগের কথা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে বলতেন। আমি খানিকটা বিব্রত হতাম আমার বিষয়ে ব্যবহৃত বিশেষণে। জিল্লুর ভাই ছিলেন প্রাণোচ্ছল মানুষ, তাঁর সঙ্গে বিতর্ক করাও ছিলো একটা আনন্দজনক অভিজ্ঞতা। সন্মেলনের বিবিধ ব্যস্ততার মাঝেও দাঁড়িয়ে বা কফির আড্ডায় আমার ভিন্নমতগুলো গুরুত্ব দিয়ে শুনতেন, আলোচনায় অংশ নিতেন। অত্যন্ত ধীর স্থিরভাবে গুরুত্ব দিয়ে ভিন্নমত শোনা ছিলো তাঁর স্বভাবজাত।
তাঁর একটা বড় দিক ছিলো অন্যদের সংগঠিত করার, ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্যাল সায়েন্স এসোসিয়েশনের একটি রিসার্চ গ্রুপের প্রধান হিসেবে তিনি সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, সন্মেলনের প্যানেলের উদ্যোক্তা ছিলেন। প্রতিষ্ঠিত এবং বিকাশমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে তিনি মেলবন্ধনের কাজ করতেন, সেটা করে আনন্দ পেতেন।
জিল্লুর ভাইয়ের সঙ্গে যখনই দেখা হয়েছে তাঁর আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। তাঁর অন্যতম আকর্ষণ ছিলো যে, তিনি সবাইকে বন্ধুজন বলেই বিবেচনা করতেন, সবাইকেই সমতার মর্যাদায় সন্মান করতেন। তাঁর অনুপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রে এবং ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্যাল সায়েন্স এসোসিয়েশনে বাংলাদেশ স্টাডিজের জন্যে একটা বড় ধরণের শুন্যতার সৃষ্টি করবে। আগামিতে কোন সন্মেলনে গেলে কেমন আছি আন্তরিকভাবেই জানতে চাওয়া এমন একজন মানুষ থাকবেন না।