আমি আর ঋতু একসাথে স্কুলে যাচ্ছি। রাস্তায় মঈন মিয়াদের বাগান। সেখানে নানান রকমের গাছ ঘাসের গালিচায় সবুজ জামা পরে বাতাসে দুলছে। বাতাসের একটা বড় দোলা আমাদেরকে ছুঁয়ে পেয়ারা গাছের পাতায় ধাক্কা দিতেই টসটসে কিছু পেয়ারা আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো।আমরা দুজন একসাথে দৃশ্যটি দেখে ফেলেছি বুঝতে পেরে হেসে উঠলাম। ঋতু তাড়াতাড়ি তার বইগুলো আমার হাতে দিয়ে দৌড়ে গিয়ে উঠলো পেয়ারা গাছে। আর চৌকস চোরের মতো চুরি করে আনলো তিনটা পেয়ারা। আমাকে দুটি ডাঁসা পেয়ারা দিলো আর সে নিজে একটি তাড়াহুড়ো করে খেতে শুরু করলো এমন ভঙ্গিতে যেন এখনই না খেলে কেউ কেড়ে নেবে পেয়ারাটি অথবা দেখলেই ওকে পেয়ারা চোর বলবে।
ওর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা দেখে সে বলল,
—দেখছিস কী! খা খা।
পেয়ারা খাওয়ার মচমচে তালে আমরা স্কুলে পৌঁছে গেলাম।
স্কুল শেষ করে ফেরার সময় ঋতু বললো,
—জানিস, আমি সোহাগের সাথে বিকেলে সাইকেল চালানো শিখতে গেছিলাম বড় রাস্তায়। সোহাগের ভাইয়ের সাইকেল। আমি প্রায় শিখে গেছি। তুই সাইকেল চালানো শিখবি?
আমি বললাম,
— না, মা বকা দিবে। ছোট আপা শিখতে চেয়েছিলো, মা বলেছে মেয়েদের সাইকেল চালানো শিখতে নেই। তুইও তো মেয়ে, শিখিস না। মা বলেছে, মেয়েদের ক্ষতি হয়। সে আমার কথা শুনে বড়দের মতো হাসলো।
বিকেল বেলা আমি উঠানে বসে পুতুল খেলছিলাম। ঋতু এসে আমার পাশে বসেই আমার সবচেয়ে পছন্দের বড় পুতুলটা নিয়ে পুতুলের লাল শাড়িটা খুললো। আমি বড় চোখ করে তাকাতেই সে আবার পরিয়ে দিলো যত্ন করে। একসাথে সে আর আমি ঘটি-মাল্টি খেললাম অনেকক্ষণ, এরপর বউ-বর খেলার পালা।এভাবেই প্রতিদিন আমরা একটার পর একটা খেলা খেলি। বউ-বর খেলার সময় আমাকে বর হতে দিবে না সে।
—সবদিন তুই-ই বর হবি, তাই হয়?
—আমি তো বরের মতো দেখতে আর তুই বউয়ের মতো। কী বলিস?
—তা কেন হবে? আমি আর তুই দুজনেই মেয়ে, একই দেখতে।
এই নিয়ে তার সাথে ঝগড়া বাঁধে প্রতিদিন। আমি তার কালি দিয়ে আঁকা গোঁফে লিপস্টিক ঘষে দিয়ে বলি,
—ভাব ধরেছে, সে যেন বেটা ছাওয়াল!
সে আমার স্কাটের ঝুল দিয়ে বানানো চুলটা মাথা থেকে টান দিয়ে খুলে ফেলে দিয়ে পালায়। আমি কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলি,
—তোর সাথে আর কখনো খেলবো না, তুই আমাদের বাড়ি আসবি না। খচ্চর মেয়ে একটা।
আমাকে আপা বকা দিয়ে বলে, সারা বাড়ি এলোমেলো করে খেলিস আবার কাঁদিসও।এবার কাঁদলে মার লাগাবো।
আমি আপার ভয়ে স্বাভাবিক হয়ে যাই।পড়তে বসি।
একটু পর আবার ঋতু আসে। দরজায় এসে ডাক দেয়, পদ্ম, পদ্ম, এই পদ্ম।
আমি চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকাই। সে বলে,
—আচ্ছা, এবার তুই বর হবি আর আমি বউ।
আমি খুশি হই। আর তাড়াতাড়ি করে কলম দিয়ে গোঁফ আঁকাই। আমার বর সাজা দেখে সে দুষ্টু হাসি হেসে তার প্যান্টের ওপর হাত দিয়ে বলে,
— তুই কি জানিস বরদের এখানে মরিচের মতো একটা কিছু থাকতে হয়, আর তা না হলে বর হওয়া যায় না?
আমি ভূত দেখার মতো চমকে গিয়ে তার দিকে তাকাই।
সে ছেলেদের মতো করে খিল খিল করে হাসে। আমার গায়ে রাগের ঝঙ্কার ওঠে। ওর চুল ধরে টানতে টানতে বলি,
—ওই তুই কি বেটা, তোর কি মরিচ আছে?
সে চুল ছেড়ে নিয়ে বলে,
—আছে, আছে।
—আরে কী বলিস, পাগলী মেয়ে কোথাকার; আমিও মেয়ে তুইও মেয়ে। সোহাগ ছেলে, সোহেল ছেলে ;আমরা সেদিন ছাদে বৃষ্টিতে ভিজে গোসল করে সবাই প্যান্ট পাল্টালাম না! তুই কেন বোকা বানাচ্ছিস আমাকে? আমারও সাত বছর বয়স বুঝলি? এসব বলে আমি যখন হি হি করে হাসছি তখন ঋতু রাগে জ্বলছে।
আচমকা ঋতু তার প্যান্ট খুলে বলে,দ্যাখ, দ্যাখ।
আমি এইবার সত্যি বুঝলাম, ঋতুর সাথে আর খেলা যাবে না,স্কুলেও যাওয়া যাবে না; সে অঙ্কে গোল্লা পায়।
প্রতিদিন পড়া না পারার কারণে স্যারের হাতে মার খায়। তারপরও ওকে আমি ভালো মেয়ে ভেবেছিলাম। এখন দেখি পুরায় একটা শয়তান আর পাগলি মেয়ে।
তার গায়ে একটা ধাক্কা দিয়ে বলি,
—আরে প্যান্ট খুলে রেখেছিস কেন? স্কচটেপ দিয়ে পেঁচিয়ে ওটা কি লাগিয়ে রেখেছিস, ভাল্লুক? মা বলেছে, তুই আমার দুই বছরের বড়। আর তোর মাথায় এই বুদ্ধি? তোকে বার বার বলেছি, তুই আর আমি মেয়ে। তোর এখানে ছেলেদের মতো মরিচ গজাবে না। বড় হলে আপুর মতো বুকের মধ্যে উঁচু উঁচু মাংস হবে। যা যা বাড়ি যা, তোর সাথে আমি আর খেলবো না কখনো।
ঋতু তাড়াতাড়ি প্যান্টটা তুলে নিয়ে আমার গায়ে একটা খামচি দিল, থুতু দিল। আমি ওর পায়ে একটা লাথি দিলাম। সে বলল,
—সকালে তোকে বিস্কুট আর পেয়ারা দিয়েছিলাম সেটা ফেরত দে। এটা বলেই ঋতু আমার দুই হাত খামচি দিয়ে ধরলো, আমি ছাড়াতে পারছি না। চিৎকার করে কাঁদছি। মেজ আপা রান্না করছিল, মা নামাজ পড়ছিলেন, ছোট আপা স্কুলের পড়া পড়ছিল। সবাই দৌড়ে এসে আমাদের মারামারি ভেঙে দিল। কিন্তু ঋতু কলাগাছের মতো দাঁড়িয়ে তার শীর্ণ শরীরের পেটটা গর্তে দিয়ে নাক টেনে টেনে কাঁদতে কাঁদতে বলতেই থাকলো,
—আমার বিস্কুট আর পেয়ারা দে।
তার কান্না দেখে মা, আপুরা সবাই বড় বড় চোখ করে আমাকে বলল,
—তুই ওর বিস্কুট আর পেয়ারা খেয়েছিস কেন? ফেরত দে, এক্ষুণি ফেরত দে। ওরা গরিব মানুষ, ওরটা তুই নিবি কেন; খাবি কেন?
আমি ফাঁসির আসামীর মতোন ওদের বুঝাতে পারছি না, আমি ফেরত দেব কীভাবে? সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় সে যখন আমাকে খেতে দিয়েছিল, আমি তো তখনই খেয়ে ফেলেছি।
ওটা বুঝে বড় আপা তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে থেকে আস্ত একটা বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে এসে ঋতুর হাতে দেয়। ঋতু ঐটা দেখে আরও জোরে চিৎকার করে কেঁদে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে,
—আমি এটা চেয়েছি নাকি? আমি যেটা দিয়েছি ঐটাই চাই।
সবাই স্তদ্ধ হয়ে যেন আকাশের তারা গুণছে। ছোট আপা হঠাৎ করে বলে,
—আরে পাগলি ঋতু সেটা তো পদ্মর পেটের মধ্যে। সেটা তো পেট থেকে বের করা যাবে না। তবে হ্যাঁ, পদ্ম যদি হাক্কু করে তাহলে পাবি; নিবি?
ঋতু বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে জানায়, সে সেটাই নিবে। করুণ সুরে বলে,
—ওই বিস্কুট না নিয়ে কান্না থামাবো না, আমি যাবো না।
মা, বড় আপা, মেজ আপা বিরক্ত হয়ে উপরতলায় চলে যায় আর ছোট আপাকে বলে, পদ্মকে নিয়ে এসে পড়াতে বসা।
আমাদের উঠানের আমগাছটার নিচে সে দাঁড়িয়ে কোরান পড়ার সুরের মতো সুর করে কাঁদতে থাকে,
—ফেরত দে কইলাম, ফেরত দে…
আপা আমাকে বলে,
—তোকে নিষেধ করেছিলাম ওর সাথে খেলিস না, সে পাকনা ছেলেদের মতো একটা মেয়ে। এখন হাক্কু করে ওর খাবার ফেরত দে। খেয়েছিস কেন? লজ্জা নেই, অন্যের খাবার খাস?
আমি রাগে-দুঃখে ওর সামনে উঠানেই বসে হাক্কু করে দৌড় দিয়ে চলে যাই উপরে। ছোট আপা দুষ্টুমি জড়ানো কণ্ঠে বলে,
—বাবু ঋতু নিয়ে যাও তোমার খাবার, নিয়ে যাও।
সে বলে,
—কই, এর মধ্যে তো পেয়ারা, বিস্কুট কিচ্ছু নেই!
এবার ছোট আপা রাগ করে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় বাসা থেকে ঋতুকে।
এরপর আর বহুদিন ঋতু আসে না আমার কাছে। আমিও ওর কথায় পাত্তা দেই না। তারপর আমরা প্রাইমারি শেষ করে হাইস্কুলে উঠি। ঋতু আবার আগের মতো সবকিছুতেই কেমন করে জানি না আমার সাথে জড়িয়ে যায়।
দুপুর বেলা টিফিনের টাইম। আমি ভুল করে খাবার নিয়ে যাইনি। প্রচন্ড রোদ বাইরে। আমাদের স্কুলে কোনো ক্যান্টিন নেই। বাইরের দোকান থেকে খাবার আনতে হবে। ঋতু মাথা নিচু করে কিছু একটা লিখছে। দুপুরে কেউ তাকে কখনো কিছু খেতে দিলে খায় না। কিন্তু তাদের বাসা থেকে প্রায় খাবার এনে আমাকে দেয়। আজ আমার খুব খিদে লেগেছে। সাগরকে টাকা দিয়ে বললাম, দোকানের সামনে অনেক দুষ্টু ছেলে থাকে তাই আমার যেতে ইচ্ছে করে না। টাকা দিচ্ছি আমাকে কিছু খাবার এনে দিবি? সে সোজা বলে দিলো, পারবো না। আর কাকে বলবো ভেবে পাচ্ছি না। মন খারাপ করে বসে আছি। হঠাৎ কতগুলো গরম লুচি আর ডাল নিয়ে আমার মুখের সামনে হাজির করলো ঋতু।
সে এখন এত বেশি মায়া করে, মাঝে মাঝে মায়ের মতো মনে হয় তাকে। একদিন রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে পা কেটে গিয়েছিলো, এতগুলো সহপাঠীদের মধ্যে কেউ আমাকে ঋতুর মতো যত্ন করেনি। অনেক কষ্ট করে সে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে।
আমরা এখন সবাই ভি ওড়না পরি হাইস্কুলে। ঋতু পরে না। স্যার ডেকে বললো,
—অনেক দিন ধরে তোমাকে বলছি এই পোশাকে স্কুল করা যাবে না, তুমি শুনছো না। এরপরও যদি এই টাইট গেঞ্জি আর ছেলেদের মতো প্যান্ট পরে, ছেলেদের মতো চুল কেটে স্কুলে আসো তবে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো।
সে মন খারাপ করে মাথা নিচু করে কাঁদে। আমি টিফিনের সময় তার সামনে বসে বিভিন্ন মজার গল্প বলার চেষ্টা করি। সে আমার ভি ওড়নার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।
—কী দেখছিস ঋতু?
সে আমার বুকের মাঝখানে ঝুলানো আল্লাহু লেখা স্বর্ণের লকেটটা ধরে নাড়াচাড়া করে, ভি ওড়নার ভাঁজ আইরনে ডলার মতো ঘষে ঠিক করে দিতে চেষ্টা করে। অথচ তার চোখের মধ্যে জল চিকচিক করে যেন পলকটা ফেললেই গাল ভরে যাবে লোনাপানির স্রোতে।
আমার বুকে অস্বস্তি লাগে। ওর হাত সরিয়ে দিয়ে বলি,
—ঋতু, আমার এই লকেটা তোর অনেক পছন্দ তাই না? তুই প্রায়ই এটা ধরিস। আমি তোকে এই মালা আর লকেট দিয়ে দিতে চাই।এই বলে তাড়াতাড়ি লম্বা মালাটা খুলে ওকে পরাতে গেলে সে শক্ত করে আমার হাত ধরে। আমার কাছ থেকে মালাটা ছিনিয়ে নিয়ে আবার আমাকেই পরিয়ে দেয় । তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
—তুই অনেক ভালো, অনেক সুন্দর;তোর গলায় পৃথিবীর সব মালা সুন্দর লাগবে তাই বারবার তোর মালায় হাত দিই।
আমি ঋতুর আলিঙ্গন খুললেই সে আমার ঠোঁটে একটা আলতো চুমু দেয়। আমি বলি
— তুই বান্ধবী হয়ে মায়েদের মতো ভালোবাসিস। তোর মতো বান্ধবী এক জীবনে পাওয়া কঠিন।
সে হাসে আর বলে,
—তুই ভালোবাসার মতোই মেয়ে।
টিফিনের সময় বলে আমার অন্য বান্ধবীরা ঋতুর অধিক সখীপ্রীতি দেখতে পায়নি। তাছাড়া ওরা প্রায় ঈর্ষা করে ঋতুকে। আর আমাকে বুঝায় তারাও আমাকে পছন্দ করে কিন্তু এত আহ্লাদ দেখানোর কী আছে ঋতুর! আমি বলি, সব মানুষ একই রকম হয় না। এত সমালোচনার কী আছে? সে একটু অন্য রকম মেয়ে।
আস্তে আস্তে স্কুলের সবাই তাকে অপছন্দ করতে শুরু করল। শিক্ষকরাও তাকে এভাবে স্কুলে আসতে নিষেধ করল। সে দূরের একটা গ্রামে অন্য একটা স্কুলে ‘হৃদয়’ নাম দিয়ে ভর্তি হলো। সেখানে ওকে কেউ চেনে না। যারা তাকে ছোটবেলা থেকে চেনে না তারা তাকে ছেলে ভাবতো। যারা তাকে চিনতো তারা অবাক হতো। সে তো হিজড়াদের মতো নয়, যদিও কণ্ঠ কিছুটা মোটা করে ছেলেদের মতো কথা বলার চেষ্টা করে সে তবুও তার কেন ছেলে সাজার সখ, কেউ বুঝতে পারে না।
নওশিন, নাবিলা, বেলি বললো,
—ঋতু কেমন বাজে হয়ে গেছে জানিস?
—কী করেছে ঋতু?
—ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়ায়। ছিঃ!কেমন হয়ে গেলো ঋতু। নামও পাল্টালো।
এতসব শোনার পরও আমার ঋতুর জন্য মায়া হয়। সে স্কুল ছুটির আগেই আমাদের স্কুলের সমনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। স্কুল শেষ করে তাকে ডেকে নিয়ে আমি বিকেলে আমাদের স্কুলের মাঠে বসি। ছোটবেলার দুষ্টুমির গল্প করি। তাকে বুঝতে দেই না আমাদের সহপাঠীরা তাকে নিয়ে কী কী বলাবলি করে।
সবাই ঋতুর চেহারা দেখতে পায় কিন্তু আমি তার ভেতরে আমার প্রিয় পুতুলটির মতো লাল শাড়ি পরা সুন্দর মিষ্টি মুখটা দেখতে পাই।
—চল, এখন আর বসবো না। এটা বলতেই সে উঠে পড়লো, জিদ করলো না। কতদিন আগে তোর বিজ্ঞান নোটটা নিয়েছি, তুই তো চাইলি না ঋতু!
—চাইবো কেন, তোর পড়া হলে এমনই দিবি আমি জানি।
খুব শান্ত করে উত্তর দিলো সে। আমি বলি,
—ঋতু তোর সাথে কথা বললে বোঝাই যায় না যে, সেই ছোটবেলার ঋতু তুই।
ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে সে বললো,
—আমি তো এখন হৃদয় পদ্ম।
—তুই খুব শান্ত হয়েছিস ঋতু কিন্তু বোকাই রয়ে গেলি।
আজ ঈদের দিন। নতুন জামা পরে সেজে সব বান্ধবীরা ঘুরছি, ঋতুর কথা মনেই নেই আমার। মা ডেকে বললো, তোর ঐ পাগলি বান্ধবীটা এলো না তো!
তখন মনে হলো তাই তো। ওদের বাড়িতে গেলাম বহুদিন পর। বাড়ির সামনে বাঁশের চাটাই দিয়ে একটা মাচা বানানো। তার ওপর ঋতু বসা। কাছে গিয়ে দেখি সে কাঁদছে। বাড়ির ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। মনে হয় কেউ মারামারি করছে। আর ঋতু মাথা নিচু করে নিঝুম মনে কাঁদছে। আমাকে সামনে দাঁড়ানো দেখে সে লজ্জা পেয়ে চোখ মুছলো। আমি কোনো প্রশ্ন না করে বললাম,
—চল, মা ডাকছে তোকে।
সে কিছু না বলে আমার সাথে হাঁটতে থাকলো। হঠাৎ তার দুই পকেটে হাত দিয়ে চুড়ি আর পায়েল বের করে দিলো। সে প্রায়ই বিভিন্ন কিছু কিনে নিয়ে আসে আমার জন্য। আমার পছন্দের জিনিসপত্র খেয়াল করে আর ঠিক সেগুলোই দেয়। আমি নিতে না চাইলে সে অনেক মন খারাপ করে, কেঁদে ফেলে। বাধ্য হয়ে আমি নেই।
সব বান্ধবীরা বাসায় এসেছে। আমি তাকেও আমাদের সঙ্গে থাকতে বলি। আমরা আমাদের ছাদে আড্ডা দেই, নীলা আর রুমি সুন্দর গান গায়। মিলু গানের তালে তালে নাচে। ঋতু চুপচাপ বসে থাকে মনমরা হয়ে। সবাই খায়, ঋতু খায় না। ছোট আপা ঋতুর না খাওয়ার কথা বললে মা ঋতুকে নিজে এসে খাবার দিয়ে যায়।
সবাই চলে গেলে ঋতু যায় না। আমি বলি,
—রাত হয়ে গেছে, বাড়ি যা।
সে ঝড়-বৃষ্টিতে পড়া শালিকের মতো অসহায় হয়ে বসেই থাকে। আমি কখনো জানতে চাইনি তাদের পরিবারের সমস্যা। ওদের বাড়ি কিছুটা দূরে অন্য আরেক পাড়ায়, তাই খুব যাইও না ওদের বাড়ি। তাছাড়া সে প্রায় প্রতিদিনই আসে। আজ বললাম,
—ঋতু কী হয়েছে, আসলে তোদের পরিবারে কোন সমস্যা?
সে খুব শান্ত আর করুণ কণ্ঠে বললো, সে কেন ছেলে হতে চায়। তার কষ্টের কথা শুনে আমার কান্না পেলো। সে আমার চোখ মুছে দিয়ে বললো,
—কাউকে বলিস না এসব। এটা বলে খুব ধীরে বিধ্বস্তভাবে চলে যায়।
রাতে আমার ঘুম আসে না। আপাকে বলতে ইচ্ছে করে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আপাকে বলি, ঋতুর হৃদয় হওয়ার কারণ। ঋতুর মা যখন তৃতীয় বারের মতো গর্ভবতী হয়, তখন ঋতুর বাবা তার মাকে শক্ত কণ্ঠে গালি দিয়ে বলে দেয়েছিলো, ‘এবার যদি কন্যা সন্তান হয়, তাহলে পৃথিবীতে তাকে বেঁচে রাখা হবে না।’
তৃতীয় কন্যা সন্তানটি ঋতু। ঋতুকে জন্ম দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বাবা অপেক্ষা করেনি তার মায়ের সুস্থতার জন্য তখনই মেরে মাথা ফাটিয়ে দেয়। মা বেঁচে গেলেও কিছুটা বিকারগ্রস্ত জীবন-যাপন করে। কখনো ভালো কখনো পাগলামি করে। প্রতিদিন বাংলা মদ খেয়ে এসে সাপ পেটানোর মতো পেটাতে থাকে তার বাবা অসুস্থ মাকে ।
যখন ঋতু বড় হয়ে হৃদয় হলো তখন উল্টো হৃদয়ই তার বাবাকে পেটায় আর তারপর অনুতাপে কাঁদে। ঋতুর দুঃখের সব শুনে আপা আবারও নিষেধ করে ঋতুর সাথে সম্পর্ক না রাখতে। কিন্তু আমার মায়া হয় তার জন্য। সে আমার ছোটবেলার খেলার সাথী-সহপাঠী।
শুক্রবার দিন বিকেলে আমি ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি। বাড়ি থেকে একটু দূরে বাগানের মধ্যে রুবেল দাঁড়িয়ে আছে। আমার চোখে চোখে সুখ বিনিময় করছি। সে আমার এক ক্লাস ওপরে পড়ে। কিছুদিন ধরে ওকে দেখলেই নতুন জামা কেনার চেয়ে বেশি আনন্দ লাগে। প্রথম চিঠি সে-ই আমাকে লিখেছে। আমিও লিখেছি। চোখের ভাষা যে সত্যি ছিলো তা তার গোলাপের পাপড়ি দিয়ে ভরা চিঠি পড়ে বুঝেছি। আমি রুবেলকে ইশারা করতেই সে এসে আমাদের বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালো। আমি আমার লেখা একটি চিঠি একটা ইটের টুকরোতে বেঁধে ফেলে দিলাম নিচে। সে বল ধরার মতো ধরে ফেললো দুই হাতে। হঠাৎ ঋতুকে দেখলাম আমাদের বাড়ির দিকে আসছে। রুবেল বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি চলে গেলো।
ঋতুর অবাধে আসা যাওয়া আমাদের বাড়িতে। আমাকে ছাদে দেখে সেও উঠে আসলো ছাদে। আমার বুকের মধ্যে ঝড়। রুবেলের দ্রুত চলে যাওয়ার শূন্যতা নিয়ে ঋতুর দিকে কঠিন করে তাকিয়ে বললাম,
— আসার আর সময় পেলি না?
সে বললো,
—ভ্রু কুঁচকে কথা বলিস না। ঐ ছেলেটাকে কী দিলি?
ধরা পড়া চোরের মতো নড়বড়ে গলায় বললাম,
—আমাদের বাড়ির কাউকে বলিস না, ঋতু, প্লিজ। রুবেলকে আমার খুব পছন্দ। ওর সাথে আমার প্রেম।
ঋতু বাবাদের মতো গলায় বললো,
—প্রেম কী বুঝিস? সে তোকে কয়দিন চিনে, এত তাড়াতাড়ি প্রেম হয়?
—এত বুঝতে হবে না, তুই আমাদের বাড়ির কাউকে বলবি না। আমি পড়া শেষ করে ওকে বিয়ে করবো। ততদিনে আমাদের আরও প্রেম হবে।
ঋতু মুখ শক্ত করে বললো,
—এত পাকনামি করিস না। সে তোকে সুখে রাখতে পারবে না। আর এত তাড়াতাড়ি বিয়ের চিন্তা করিস না। ভুলে যা এসব।
আমি রাগ হয়ে বলি,
—তোর এত কথা শুনতে আমার ভালো লাগছে না। তুই চলে যা।
ঋতু ভীষণ ব্যথিত চেহারা নিয়ে চলে গেলো। আমার ভেতরটা ঝড়োহাওয়ার মতো ছটপট করছে।
আজ আমার জন্মদিন। আপুরা সুন্দর করে বাড়ি সাজিয়েছে। ছাদের ওপর কেক কাটা হবে। সবাই মিলে আমাদের ছাদে হৈ-হুল্লোড় করি।
আগামী মাস থেকে আমাদের এসএসসি পরীক্ষা। তাই সবাই তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে। চলে যায় যার যার বাড়িতে। আমি আর ঋতু বসে থাকি নিয়ন আলোয় সাজানো ছাদে, মিটমিট করে জ্বলে বিভিন্ন রঙের ছোটো ছোট বাল্ব। দূরে আকাশে অনেক তারা আমাদের মতো তারাও পাশাপাশি বসে আছে। মৃদু বাতাস চারিদিকে। আস্তে আস্তে বাতাস বাড়ছে। মনে হচ্ছে ঝড় হবে। আমি রুবেলের কথা আর কারো সাথে আলোচনা করতে চাই না। কিন্তু আজ ভোরবেলা সে আমাদের বাসার সামনে একগুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে এসেছিলো এবং পাশের বাগানে পাঁচ মিনিটের জন্য তার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম। তখন সে আমাকে একটা চুমু দিয়েছিলো। এই প্রথম কোনো প্রেমের চুমু আমার ঠোঁটে পড়লো। এই শিহরণ আমি ভুলতে পারছি না। ছেলেরা চুমু দিলে শরীরে বিদ্যুৎ চমকায় কেন! এসব ঋতুর সঙ্গে শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে। থাক, ঋতু তো আবার মা- বাবার মতো আচরণ শুরু করবে, দরকার নেই। এইসব ভাবতেই একটা দমকা বাতাসে এসে আমাকে নাড়িয়ে দিলো। আমার হারিয়ে যাওয়া মন যেন শরীরে ফিরলো। বাতাসে পড়ে গেল আমার ওড়না শরীর থেকে। হঠাৎ দেখি ঋতু আমার বুকের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। আমি অনেক সময়ই বাসায় ওড়না ছাড়া থাকি। ঋতুর এভাবে তাকানো আগে কখনো খেয়াল করিনি। আজ তার দৃষ্টি কেমন যেন অচেনা লাগলো।
তাড়াতাড়ি ওড়না ঠিক করতেই সে বলল,
—তুই অনেক সুন্দর পদ্ম।
—ওটা আর নতুন কী?
—তুই তো সারাজীবন বলেই আসলি, আমার চোখ সুন্দর, ঠোঁট সুন্দর, আমার পা তোর ভীষণ পছন্দ।
—তুইও সুন্দরী, ঋতু;ছেলে মানুষ সেজে থাকিস তাই বুঝতে পারিস না।
সে খুব পুরুষালি গলায় বলতে থাকলো,
—হ্যাঁ, তোর সবই সুন্দর। এই জন্যই তোকে ছাড়া আমার কিছু ভালো লাগে না,পদ্ম।
ঋতুর কথা আমার অদ্ভূত লাগলো, ভুতুড়ে লাগলো। সে কথা বলতে বলতে আমার খুব কাছে এসে দুই হাত ধরলো। সে প্রায়ই আমার হাত ধরে। এই ধরাটা কেমন যেন!
এরপর সে বললো,
—পদ্ম, শরীরের সুখই সব সুখ নয়। রুবেলের শরীরে আমার চেয়ে একটা জিনিস বেশি আছে, তাছাড়া আমার সব আছে। আমি আমার সব দিয়ে তোকে আদর করে সুখী করবো। ছেলেদের তো শুধু ঐ একটা জিনিস থাকে, আমার মতো এত ভালো তোকে কেউ বাসবে না। তোর সারা শরীর আমি ভালোবাসায় ডুবিয়ে দেবো, পদ্ম।
আমি বললাম,
—তুই তো ছেলেদের মতো কথা বলছিস। তুই জানিস তো আমার রুবেলের সাথে প্রেম, রুবেল যেমন করে হাত ছুঁতে চায় তুই তো তেমন করছিস।
সে অনেক আবেগ নিয়ে বলে,
—হ্যাঁ, আমি তোকে রুবেলের হতে দেব না। কখনো তোকে কেউ বিয়ে করুক আমি চাই না। আমি তোকে নিয়ে পালিয়ে যাবো অনেক দূরে। সারাজীবন আমি তোকে অনেক ভালোবাসবো।
এটা বলেই সে হঠাৎ করে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে দুই হাত দিয়ে আমার স্তন জাপটে ধরে। আমি হতচকিত হয়ে তার হাত থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করতেই সে আবার শক্ত করে জাপটে ধরে আমার ঠোঁট দুটি এমনভাবে তার মুখে ঢুকিয়ে নেয় যে আমি আর কথা বলতে পারি না। সে ঠোঁট চুষতে থাকে আর তার এক হাত আমার ইলাস্টিকের পাজামার ভেতরে দেয়। আমার ঊরুসন্ধিতে তার হাত বেড়ালের গায়ে আদর দেয়ার মতো নাড়াতে থাকে।
আমি চিৎকার করতে চাই বুঝতে পেরে সে আবার হাতটা বের করে আমার মুখে চাপ দিয়ে ধরে। এরই মধ্যে জামাটা একটানে উঁচু করে আমার স্তন শিশুর মতো চুষতে থাকে। সবকিছু এত দ্রুত, এত আচমকা করতে থাকে যে, আমি হঠাৎ মূর্ছা যাওয়ার মতো কিছুই করতে পারি না। অজানা, অচেনা একটা অনুভূতি নিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঋতুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে কাঁপতে থাকি। মনে হয় আমার শরীর বজ্রপাতে ছিন্নভিন্ন হয়েছে। আমার রোমকূপ কাঁটা দিয়ে উঠেছে। ভীষণ ভয় লাগছে, যেন চোখের সামনে খুন করা দেখলাম। ভূত মনে হলো ঋতুকে। অনেক শীতে শীতল বৃষ্টিতে ভিজার মতো কাঁপছি। সে কী কী বলছে, আমার কানে যাচ্ছে না; দূর থেকে আগত অস্পষ্ট শব্দ মনে হচ্ছে।
এবার আমি প্রচন্ড রেগে ঘেমে উঠছি। আমার শরীরে এখন শক্তি ফিরে এসেছে। সজোরে তার গালে একটা থাপ্পড় দিই। সে হু হু করে কেঁদে আমার পায়ে পড়ে। আমার পা অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে বলে, তোকে আমি ভিক্ষা চাই পদ্ম।
আমি লাত্থি মারি ঋতুকে। জীবনের সব সঞ্চিত শক্তি দিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে লাত্থি দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেই। সে মা মরা শিশুর মতো কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়।
জোরে দরজা বন্ধ করি। শব্দ শুনে মনে হয় মা’র ঘুম ভেঙে যায়। ঘর থেকে বলেন,
—কার সাথে চিৎকার করছিস, কার সাথে খারাপ ব্যবহার করে বের করে দিলি?
আমি নির্ভার কণ্ঠে বলি,
—তুমি চেনো না, আমার এক সহপাঠী।