লেখক: অনিরুদ্ধ সরকার
ছেলে বিধর্মী, তাই পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারী যেন সে না হয় তার জন্যে মামলা করলেন মা। ছেলে প্রথমে মায়ের বিরুদ্ধে মামলা লড়তে চাইলেন না। কিন্তু পরে ঠিক করলেন, তিনি মামলা লড়বেন। কারণ ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধেই তাঁর লড়াই। আর ধর্মের সাথে আইনের কোনো সম্পর্ক নেই। মামলা কোর্টে উঠল। মা তারিণী দেবী কোর্টে বিচারের সময় বললেন- “ধর্মত্যাগী পুত্রের মস্তক যদি এখানে ছিন্ন করা হয় তাহলে তা আমি অত্যন্ত পুণ্য কাজ বলে মনে করব।
আইন ধর্মের দোহাই দিয়ে চলে না। ছেলে মামলায় জয়ী হল। কিন্তু মামলায় জয়ী হওয়ার পর ছেলে তাঁর প্রাপ্ত সম্পত্তি মাকে সসম্মানে ফেরত দিয়ে দিলেন। কারণ, তাঁর যুদ্ধ মায়ের করা মামলার বিরুদ্ধে নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সমাজের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় গোঁড়ামি-কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।
এই ছেলে আর কেউ নন, বাংলার প্রথম আধুনিক পুরুষ রাজা রামমোহন রায়।
রামমোহনের পূর্বপুরুষ রাজ সরকারের কাজ করে ‘রায়রায়ান’ উপাধি লাভ করেছিলেন। যদিও তাঁদের কৌলিক উপাধি ছিল ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’। পিতা রামকান্ত ও মা তারিণী দেবী দুইজনই ছিলেন ধর্মপ্রাণ মানুষ। রামকান্ত শেষ জীবনে বৈষ্ণব হয়েছিলেন এবং হরিনাম করে জীবনের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করেন। শেষে তাঁদের ছেলে কিনা বিধর্মী হবে! পিতার মৃত্যুর পর তাই সম্পত্তির অধিকার নিয়ে বিরোধ বাধলে, মা তারিণী দেবী কোর্টে রামমোহনের বিরুদ্ধে মামলা-ই করে বসেন! রামমোহনের প্রথম বিরোধিতার সূত্রপাত খুব সম্ভবত নিজ বাড়ি থেকেই।
রামমোহন সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যখন প্রতিবাদ করছেন তখন কলকাতা ব্রিটিশদের হাতে তৈরি হচ্ছে। একদিকে আধুনিক পাশ্চাত্য ভাবধারা, অন্যদিকে রক্ষণশীল সনাতন ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে মরিয়া বাঙালি; ঠিক সে-সময় রামমোহনের দর্শন কলকাতার মানুষজন মোটেই ভালোচোখে নেননি। যে-কারণে শহর কলকাতার বুকে তাঁর অনেক শত্রু সৃষ্টি হল।
একদিন তিনি মধু দিয়ে রুটি খাচ্ছেন ঠাকুরবাড়ির দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে। দেবেন্দ্রনাথ রামমোহনের থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট। রামমোহন খেতে খেতে দেবেন্দ্রনাথকে বললেন- “বেরাদর, আমি মধু আর রুটি খাচ্ছি, কিন্তু লোকে বলে আমি নাকি গরুর মাংস দিয়ে ভোজন করে থাকি।”
রামমোহনের পুত্র রাধাপ্রসাদের বিয়ে। রামমোহনের বিরুদ্ধপক্ষ উঠেপড়ে লাগল সে-বিয়ে ভাঙার জন্য। এমনকি রামমোহনকে এক ঘরে করে রাখার আয়োজন অবধি করল। ব্যর্থ হল তারা।
রামমোহনের বিরোধী পক্ষ কিন্তু সহজে দমে যাওয়ার পাত্র ছিল না। খাস কলকাতার বিরোধী পক্ষ বলে কথা! রামমোহনের বাড়ির কাছে এসে তারা সকালে মুরগির ডাক ডাকত, কেউবা বাড়ির ভেতরে গরুর হাড় ফেলে দিত। এমনকি রামমোহনের বিরুদ্ধে গান রচনা করে শহর কলকাতার রাস্তায় সেই গান গাইবার ব্যবস্থা অবধি তারা করল।
কলকাতায় তখন সেই সবে ব্রাহ্মধর্মের ভিত তৈরি হচ্ছে। রামমোহন প্রায়শই ব্রাহ্মসভায় উপাসনা করতে যাচ্ছেন। কলকাতার কিছু লোক শুরু করল তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে ঢিল ছোঁড়া। প্রতিদিন একই ঘটনা ঘটতে লাগল। নিরুপায় রামমোহন বাধ্য হলেন বেশিরভাগ সময় গাড়ির জানালা বন্ধ করে রাখতে। শুধু তাই নয়, রামমোহনের বিরোধীপক্ষের তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা পর্যন্ত করল। আশ্চর্যের কথা, এই বিরোধীপক্ষের কেউই কিন্তু বিদেশি নয়, খাস কলকাতার ‘বাঙালি’। রামমোহন সেল্ফ ডিফেন্সের জন্য সঙ্গে পিস্তল সঙ্গে নিয়ে বের হওয়া শুরু করলেন।
স্বাস্থ্যসচেতন রামমোহন প্রতিদিন প্রায় বারো সের দুধ খেতেন। শোনা যায়, আস্ত একটি পাঁঠার মাংস খেতে পারতেন তিনি। কলকাতায় যখন তাঁর এই ব্রাহ্মভাবধারা প্রচার করা নিয়ে নানান মহলে প্রতিবাদ চলছে, তখন রামমোহনের ঘনিষ্ঠ একজন একদিন তাকে এসে জানালেন, তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই কথা শুনে রামমোহন হেসে বললেন, “কলকাতার লোক আমাকে মারবে? তারা কী খায়?’’
রামমোহন ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সপ্তাহে একদিন এই আত্মীয় সভা অনুষ্ঠিত হত। সেখানে বেদান্ত অনুযায়ী এক ব্রহ্মের উপাসনা এবং পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কথা বলা হত। সভায় বেদপাঠের পর ব্রাহ্মসঙ্গীত গাওয়া হত। সভা সকলের জন্যে উন্মুক্ত ছিল না, কেবলমাত্র রামমোহনের কয়েক জন বন্ধু তাতে যোগদান করতেন। সে-সময় নিন্দুকেরা আত্মীয় সভার বিরুদ্ধে গুজব রটাল যে, আত্মীয় সভায় লুকিয়ে লুকিয়ে গো মাংস খাওয়া হয়। ব্যাস! রামমোহনের অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু একথা শুনে রামমোহনকে ত্যাগ করল। রামমোহন নির্বিকার।
যে বেদ শূদ্র সম্প্রদায়ের শোনার অধিকার ছিল না, আর তা উচ্চারণ করলে নাকি জিহ্বা কেটে দেওয়ার রীতি ছিল সেই বেদ-কে অনুবাদ করে সাধারণ মানুষের কাছে উন্মুক্ত করে দিলেন রামমোহন। ব্যাস! সর্বসাধারণের জন্যে বেদ ছড়িয়ে দেওয়ার ফলে রামমোহনের বিরুদ্ধে হিন্দু সমাজে চাঞ্চল্য ও উত্তেজনার সৃষ্টি হল। শুরু হল রামমোহনের প্রকাশ্য বিরোধিতা। ইংরেজি বেদান্ত গ্রন্থের ভূমিকায় রামমোহন লিখলেন – “আমি ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করে বিবেক ও সরলতার আদেশে যে পথ অবলম্বন করেছি তাতে আমার প্রবল কুসংস্কারাচ্ছন্ন আত্মীয়গণের তিরস্কার ও নিন্দার পাত্র হতে হল। কিন্তু যাই হোক না কেন, আমি এই বিশ্বাসে ধীরভাবে সমস্ত কিছু সহ্য করতে পারি যে, একদিন আসবে, যখন আমার এই সামান্য চেষ্টা লোকে ন্যায় দৃষ্টিতে দেখবে।”
রামমোহনের বই ও বইয়ের অনুবাদের ফলে দেশে বিদেশে রামমোহনের নাম ছড়িয়ে পড়ল। লন্ডন, ফ্রান্স, আমেরিকায় রামমোহন জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। অন্যদিকে নিজ দেশের বাঙালিরা রামমোহনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ শুরু করল। রামমোহন-বিরোধী অন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করল।
এরই মধ্যে রামমোহন যীশুখ্রিস্টের উপদেশ -‘শান্তি সুখের পথ’ ইংরাজিতে- ‘Precepts of Jesus-Guide to Peace and Happiness’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই বইটি লেখার জন্য রামমোহন শুধুমাত্র বাইবেল কিংবা ওল্ড টেস্টামেন্টের ইংরেজি পড়েই ক্ষান্ত হননি, গ্রিক ও হিব্রু ভাষাও আয়ত্ত করেছিলেন। এতদিন রামমোহন হিন্দু সমাজ ও ধার্মিকদের সাথে বিবাদে জড়িয়ে ছিলেন, এই বই প্রকাশের পর এবার খ্রিস্টান পাদ্রীদের বিরোধিতার সম্মুখীন হলেন। মিশনারি পাদ্রী উইলিয়াম কেরি ও মার্শম্যান সাহেবও এই বইয়ের বিরোধিতা করলেন। ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা “ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া”য় তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করলেন কেরি ও মার্শম্যান। তাঁদের বক্তব্য, রামমোহন যীশুর উপদেশ মান্য করেছেন ঠিক কথা, কিন্তু প্রভু যীশুর অলৌকিক ঘটনাগুলোকে অস্বীকার করেছেন। ব্যাস! এই নিয়ে উভয়পক্ষের বিরোধ চরমে উঠল ।
এতদিন ধরে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস রামমোহনের সমস্ত বই ছাপতেন। খ্রিষ্টানরা বিরোধিতা করার ফলে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস রামমোহনের নতুন বই ‘Final Appeal’ ছাপাতে অস্বীকার করল। কিন্তু মানুষটির নাম রামমোহন রায়। তিনি হারতে শেখেননি। রামমোহন নিজেই ‘ইউনিটেরিয়ান প্রেস’ নামে একটি প্রেস নির্মাণ করলেন। আর সেই প্রেস থেকে ‘Final Appeal’ বইটি ছাপা হল। রামমোহনের শেষ এই গ্রন্থে তাঁর মেধা ও পাণ্ডিত্য দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল। রামমোহন মার্শম্যানের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে খ্রিস্টধর্ম নিয়ে তাঁর ভাবনার মধ্যে কোন যুক্তি নেই এবং তাঁর ভুল কোথায়। মার্শম্যান ভুল বুঝলেন এবং নীরব থাকলেন।
সতীদাহের বিরুদ্ধে প্রথম রামমোহন একটু গ্রন্থ রচনাকরেন এবং তার ইংরেজি অনুবাদও প্রকাশ করেন। তিনি প্রমাণ করে দেখান যে এই প্রথা শাস্ত্রবিরোধী। রামমোহনের এসব কর্মকাণ্ডের ফলে গোঁড়া রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ আবার তাঁর বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হল। তাঁকে মেড়ে ফেলার জন্য আবার ষড়যন্ত্র শুরু হল।
রামমোহন সতীদাহ নিয়ে শুধু বই লিখেই থেমে থাকলেন না কিংবা ইংরেজদের এই প্রথার বিরুদ্ধে আইন করার জন্য আবেদন করেই বসে থাকলেন না। তিনি নিজের বন্ধুদের নিয়ে একটি দল গঠন করলেন। তাঁরা সহীদাহ বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন শ্মশানে ছুটে যেতেন। মানুষকে এই প্রথার বিরুদ্ধে বোঝাতেন। চেষ্টা করতেন এই প্রথা বন্ধের। আর এই কাজ করতে দিয়ে তাঁকে প্রতিনিয়ত অনেক লাঞ্ছনা, অপয়ান ভোগ করতে হল। তারপরও তিনি থেমে থাকেননি।
লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক পূর্বেই রামমোহন ও তাঁর দলের সমর্থন লাভ করেছিলেন। সতীদাহ প্রথা নিষেধ কোঁরে ইংরেজ সরকার আইন জারী করলেন। এর ফলে হিন্দু সমাজে যেন একটা বোমা ফাটল। চারিদিকে তোলপাড় শুরু হল। গোঁড়া হিন্দুরা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাল। সই সংগ্রহ অভিযান শুরু হল।
গোঁড়া হিন্দু সমাজ সতীদাহ রদ আইন বাতিল করার জন্যে সবাই একজোট হল। রাতারাতি তারা ‘ধর্মসভা’ প্রতিষ্ঠা করল। প্রথম দিনের মিটিঙে তাঁদের চাঁদা উঠল প্রায় বারো হাজার টাকা। ভাবা যায়! হিন্দুদের মুখপত্র ‘সমাচার চন্দ্রিকা’য় রামমোহনের বিরুদ্ধে অপমানজনক লেখালেখি শুরু হল। গোঁড়া হিন্দুরা যখন বুঝল ভারতবর্ষে এই আইন রদ হওয়ারার কোন সুযোগ নেই, তখন তাঁরা বিলেতের পার্লামেন্টে অবধি আপিল করে বসল। ইংল্যান্ডের ধর্মসভায় সেই আপিল অগ্রাহ্য হল। শেষ অবধি রামমোহনই জিতলেন।
রামমোহন নারীর সম্পত্তি লাভের জন্য আন্দোলন শুরু করলেন। তিনি শাস্ত্র ঘেঁটে বলেন- প্রাচীন ঋষিগণ ব্যবস্থা করেছিলেন যে, মৃত- স্বামীর সম্পত্তিতে পুত্রের সাথে স্ত্রীও সমান অধিকারী। একাধিক পত্নী থাকলেও তারা সবাই সমানভাবে সম্পত্তির অংশীদার। ব্যাস! আবার অগ্নিতে ঘৃতাহুতি। কলকাতার রক্ষণশীল সমাজ আবার রামমোহনের প্রাণনাশের চেষ্টা করল। কিন্তু রামমোহন মরিয়া। এই আইনও তিনি পাশ করালেন।
রামমোহনের জীবনের শেষ তিন বছর কেটেছিল ইংল্যাণ্ডে। বিলেত যাওয়ার আগে তিনি দিল্লীর বাদশাহের কাছ থেকে ‘রাজা’ উপাধি লাভ করেন।
এদিকে বিলেত যাওয়ার আগে রামমোহনের আত্মীয়-স্বজন তাঁকে অনেক বাধা দিয়েছিল। কারণ, সেই যুগে দেশের শাস্ত্র অনুযায়ী সমুদ্র যাত্রা নিষিদ্ধ একটা ব্যাপার। জাত চলে যাওয়ার মতো গুরুতর একটা বিষয়। রামমোহন এসব মানলেন না। আর তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি এসব অযৌক্তিক প্রথাকে উপেক্ষা করে, বিরোধীটার তোয়াক্কা না করে নিজ মর্জিতে বিলেত গেলেন। সে সময় তাঁর সঙ্গই ছিলেন তাঁর পালিত পুত্র রাজমোহন, রামরত্ন মুখোপাধ্যায় নামে এক পাচক ব্রাহ্মণ ও রামহরি নামে এক ভৃত্য।
ঊনষাট বছর বয়সে বিদেশের মাটিতেই মারা আন ভারতের প্রথম আধুনিক পুরুষ। মৃত্যুর আগে খ্রিষ্টান সমাধিস্থলে তাঁকে সমাহিত না করার জন্য তিনি অনুরোধ করেছিলেন। যে- কারণে পরে তাঁকে স্টাপেল গ্রোভ-এর নির্মাণস্থানে সমাহিত করা হয়।
লেখাটি ‘বঙ্গদর্শন’ থেকে সংগৃহীত।