‘ভয় কি মরণে, রাখিতে সন্তানে
মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে’।
ভয় কে জয় করার এই মহামন্ত্র চারণ কবি মুকুন্দ দাসের। আজ এই চারণ কবির ৮৭ তম মৃত্যুবার্ষিকী। চারণ এই কবির মৃত্যুর শতবছর প্রান্তে আজও তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন তার লেখায়- যাত্রাপালায়। যাত্রাপালার মাধ্যমে ‘স্বদেশ জাগরণ’ সেতো মুকুন্দ দাসের একান্ত নিজস্ব ঘরানা। দ্রোহ আর সামাজ্র্যবাদী ব্রিটিশ বিরোধিতায় মুকুন্দ দাশ আজও প্রাসঙ্গিক।
মুকুন্দ দাস তার আসল নাম নয়, প্রকৃত অর্থে উপাধি। তার আসল নাম যজ্ঞেশ্বর দে। ডাক নাম যগা। তিনি তৎকালীন ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার বানরী গ্রামে ১৮৭৮ খৃষ্টাব্দের ২২ শে ফেব্রুয়ারী জন্ম গ্রহণ করেন। তা পিতার নাম গুরুদয়াল দে, মাতা শ্যাম সুন্দরী দেবী। পদ্মার ভাঙনে ভিটে মাটি হারিয়ে এই পরিবারটির ঠাই হয় বরিশালে। সে সময়ে বিক্রমপুর থেকে অনেক শিক্ষিত মানুষ বরিশালে চাবুরীর উদ্দেশ্যে আসতেন, তাদের মধ্যে অন্যতম কবি জীবনানন্দ দাশের পিতামহ সর্বানন্দ দাস।
এই যগা যে খুব একটা নিরীহ প্রকৃতির ছিলেন না তা বলাই বাহল্য। জগা ভর্তি হলেন- ১৮৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত, সত্য- প্রেম পবিত্রতা খ্যাত ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে। কিন্ত পড়াশুনায় মন বসেনা। এক সময়ে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে, দলে ,বলে ঘুরতে লাগলেন। পড়াশুনা ছাড়লেও শ্যামাসঙ্গীত আর মা কালীর প্রতি ভক্তিতে এতটুকু কমতি নেই।
‘১৮৯৫ সাল। যজ্ঞেশ্বর তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। কোথায় কার শবদেহ কবর দিতে হবে, শ্মশানে নিয়ে যেতে হবে-হোক সে হিন্দু অথবা মুসলমান অথবা খৃষ্টান- যজ্ঞেশ্বর সেখানেই হাজির। তাই তার নাম হয়েছিল ’মরাপোড়া যগা’।ডাক পড়ল অশ্বিনী ভবনে তথা বাড়ীর সামনে তমাল গাছটির তলায়। যজ্ঘেশ্বর গরুড় পক্ষীর মত করপুটে এস দাড়ালেন। ভয়ে তার দেহ কাপছিল। প্রশ্ন এল, ‘কিরে যগা তুই নাকি আজকাল ভাল কীর্তন গাস?– গা না শুনি’ মুকুন্দ একের পর এক গেয়ে চললেন কীর্তন । অশ্বিনীর গন্ড বেয়ে অশ্রু বেয়ে পড়ে।যজ্ঞেশ্বর স্থান ত্যাগের পূরবে অশ্বিনী কুমার ধরা কন্ঠে বললেন,‘‘ তুই প্রতিদিন এমনি করে এসে আমায় একটা করে কীরতন শুনিয়ে যাবি।… গুরুদেব অশ্বিনী কুমারের পরামর্শে তিনি প্রয়াত কীরতন গুরু বীরেশ্বর গুপপ্তের ভাঙা দলটি নিয়ে গুরুর পরামরর্ মত স্বদেশী যাত্রা দল গঠন করলেন’( মুকন্দ চিন্তায় অশ্বিনী চেতনা- মিহির লাল দত্ত- ব্রজমোহন বিদ্যালয় শতবারষিকী ১৮৮৪ স্মারক পুস্তিকা)
অশ্বিনী দত্তের আহবানে স্বদেশী চেতনা যাত্রাপালা আকারে ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিলেন মুকুন্দ দাস। লিখলেন মাতৃপূজা যাত্রাপালা। মাতৃপূজা মঞ্চস্থ হল জোড়সাকো ঠাকুর বাড়ি, বেলেঘাটা, মানিকতলা রঙ্গ মঞ্চে ক্যালকাটা ভারসিটি হলে। স্বয়ং কবিগুরু মুগ্ধ হলেন এই যাত্রা পালা দেখে।
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বাংলা ভাগ পরিকল্পনা প্রকাশিত হলে সর্বত্র এর প্রতিবাদ হয়। স্বয়ং কবিগুরু রাখী বন্ধনের মাধ্যমে বাংলা ভাগের প্রতিবাদ করলেন। অশ্বিনী দত্তের নেতৃত্বে বরিশাল হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। মুকুন্দ দাশ স্বদেশী যাত্রাপালা নিয়ে গ্রামে গ্রামে জাগরণের গান গাইলেন। অবস্থা এমন হলো মুকুন্দ দাশ যেখানে যেতেন বৃটিশ রাজ সেখানেই ১৪৪ ধারা জারি করতেন। ১৯০৮ সালে দুইবার গ্রেপ্তারের পর ১৯১০ সালে তিনিন দিল্লী থেকে ঝাড়া পান।
মহাত্না গান্ধীর বিলেতি বস্ত্র বরজনের আহবানে তিনি গান ধরলেন,
‘ছেড়ে দাও কাচের চুড়ি বঙ্গ নারী’
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বরিশাল হয়ে ওঠে প্রতিবাদের আশ্রয়স্থল।
‘১৯০৫ সালের ৭ নভেম্বর। অশ্বিনী কুমার দত্ত সহ ৫ জন নেতা বিলাতি মাল বর্জনের আবেদন জানায়। বঙ্গভঙ্গ’র বিরুদ্ধে বরিশালে তীব্র বিদ্রোহের কথা শুনে পূর্ব বাংলার ছোট লাট ব্যামফিল্ড ফুলার বরিশালে ছুটে আসেন এবং তার অাবেদন পত্র প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করেন। অশ্বিনী কুমার দত্ত ফুলারের নিকট মাথা নত করেননি। শুরু হল ফুলারের অত্যাচার।’ (বাংলার রজনীতিতে অশ্বিনী কুমার দত্ত ও ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের অবদান- সিরাজুদ্দিন আহম্মেদ)
ফুলারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে, ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সেদিন মুকুন্দ দাস যাত্রাপালা নিয়ে গাইলেন ‘ ফুলার আর কি দেখাবি ভয়/ দেহ তোমার অধীন বটে মন তো তোমার নয়’
‘ছিল ধান গোলাভরা শ্বেত ইদুরে করল সারা’ দশ হাজার প্রাণ যদি আমি পেতাম, বিদেশী বণিকের গৌরবরবি, অতল জলে ডুবিয়ে দিতাম’
মুকুন্দ দাসের রচনার মধ্যে মাতৃপূজা, সমাজ, আদর্শ, পল্লীসেবা, সাথী, কর্মক্ষেত্র, ব্রহ্মচারিণী, পথ ইত্যাদি
১৯৩৪ সালে ১৮ মে এই চারণ কবির জীবনাবসান ঘটে।
৮৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে মুকুন্দ দাসের স্মরণে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের স্মরণানুষ্ঠান:
চারণকবি মুকুন্দ দাসের ৮৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ সকাল ১০টায় নথুল্লাবাদ মুকুন্দ দাসের কালীবাড়ি প্রাঙ্গনে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের আয়োজনে মুকুন্দ দাসের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান,আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।
মুকুন্দ দাসের স্মরণে আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রধান সংগঠক রিতা ব্যাপারি ও সঞ্চালনা করেন চারণ এর সদস্য অদিতি ইসলাম। আলোচনাসভায় বক্তব্য রাখেন সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ এর অর্থনীতি বিভাগের প্রধান আজমল হোসেন, চারুকলা বরিশালের সংগঠক এ্যাড. সুভাষ চন্দ্র দাস,উদীচী বরিশাল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক স্নেহাংশু বিশ্বাস, বাসদ বরিশাল জেলা শাখার সদস্য সচিব ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সংগঠক সুধীন দাস প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, মুকুন্দ দাস ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সাংস্কৃতিক মাত্রা যোগ করেছিলেন, গান-যাত্রাপালার মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। আজকের দিনেও সংস্কৃতির কর্তব্য বিদ্যমান দুঃশাসন-শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনগনকে প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ করা, প্রগতির পথে চালিত করা। বেশিরভাগ সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলি সেই ধারা থেকে দূরে সরে গিয়ে একধরনের পোশাকি সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখছে। বক্তারা মুকুন্দ দাসের সংগ্রামী জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানের সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করার দাবি জানান।
আলোচনাসভা শেষে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিবেশনায় মুকুন্দ দাস রচিত গান ও কবিতা নিয়ে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।