নাটোর শহর থেকে ৫১ কিলোমিটার দূরে লালপুর উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে ৮নং দুড়দুড়িয়া ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের রামকৃষ্ণপুর গ্রাম। এখানে প্রায় তিনশ একুশ বছরের পুরনো ৩২ বিঘা জমির উপর নির্মিত “শ্রী শ্রী ফকির চাঁদ বৈষ্ণব গোঁসাইয়ের সৎসঙ্গ সেবাশ্রম” ফকির চাঁদ বৈষ্ণব গোঁসাই মন্দির, সমাধি ও যোগী সম্প্রদায়ের বিরাট আশ্রম।
গ্রামবাসীরা কেউ বলে সাধুর আশ্রম, কেউ বলে গোঁসাই বাড়ি আবার কেউ বলে সাধুর বাড়ি। তৎকালিন সময়ে বটগাছের নিচে আস্তানা স্থাপন করেন ফকিরচাঁদ বৈষ্ণব। সেখান থেকেই তিনি ধ্যান-তপস্যা ও বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার শুরু করেন। লোক মুখে শোনা যায়, নিঃসন্তান নারীরা বটগাছের নিচের আসনে বসে ‘ভীখ মাংলে’ যদি গাছের ফল পড়ে তাহলে তারা সন্তান লাভ করেন। কথিত আছে এককালে আশ্রমটি এদেশের যোগী সম্প্রদায়ের একটি কেন্দ্র ছিল ।
জেলার শেষ সীমানায় অবস্থিত এই আশ্রম যুগে যুগে কালের সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বহন করছে মহাপুরুষের স্মৃতি। প্রায় ৪৫ ফিট উচ্চতার নিপুন নক্সায় ক্ষচিত প্রধান ফটকটিতে লেখা আছে “স্থাপিত ১১০৪ বাংলা” আনুমানিক সপ্তাদশ শতাব্দীর শেষ পাদে নির্মিত। ৩২ বিঘা জায়গার এলাকা জুড়ে রয়েছে ফলজ বৃক্ষ আর পূজনীয় ফুলে গাছ। আছে সান বাঁধানো তিনটি সু-বিশাল পুকুর। প্রতি বছর দোল পূর্ণিমা, গঙ্গা স্নান ও নবান্ন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে শ্রী শ্রী ফকির চাঁদ বৈষ্ণব গোঁসাইজীর আবির্ভাব, জীবন চরিত্রের ওপর আলোচনা, গীতা পাঠ অনুষ্ঠান ও সুধী সমাবেশ হয়। এছাড়া প্রতিদিন আশ্রম দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত।
আশ্রমের প্রবেশ পথে রয়েছে ময়ূর, বাঘ ও বিভিন্ন প্রাণির মূর্তি এবং লতা-পাতা কারুকার্য খচিত সুবিশাল ফটক। মুল ফটক পেরলো বামে ছোট বড় সমাধিস্থল। রয়েছে প্রধান ৬ জন সাধুর সমাধি মন্দির। ডানদিকে সাধু বৈষ্ণবদের বিশ্রামাগার বহন করছে প্রাচীন ইতিহাস। নির্জন আর ছায়াময় গোঁসাইজীর চার কোনা প্রধান সমাধি স্তম্ভ। এই স্থানের মূল ভবন প্রায় ৪১ ফিট উচ্চতা ও ১০৮ ফিট স্কয়ার ফিট জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছিল। বাম পাশে এর একটি দরজা ছাড়া কোন জানালা পর্যন্ত নেই।
মূল মন্দিরে শুধুমাত্র প্রধান সেবাইত প্রবেশ করেন। উত্তরে আছে ভক্তদের অন্নসেবার জন্য ভোগ ঘর। পেছনে রয়েছে বিশাল ইন্দিরা। তৎকালিন সময়ে পানি সংকট নিরশনের জন্য নির্মিত কুয়া। তবে এখন কুয়াতে পানি থাকলেও নষ্ট। পানি কেউ ব্যবহার করে না তবে ইন্দিরার পানি এখনও ব্যবহার করা হয় রান্নার কাজে। ডি.আই.জেড ও বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশন এর সহযোগীতায় সম্প্রতি সোলার প্রযুক্তিতে বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত থাকে রাতে। ভক্ত আর দর্শনার্থীর সমাগম থাকে প্রতিদিন।
কথিত আছে, মন্দিরের মধ্যে সাধু ফকির চাঁদ স্বশরীরে প্রবেশ করে ঐশ্বরিকভাবে স্বর্গ লাভ করেন। তাঁর শবদেহ দেখা যায়নি। পরিধেয় খড়ম বস্ত্রাদি সংরক্ষণ করে সমাধি স্তম্ভ নির্মিত হয়েছিল। গম্বুজ আকৃতির সমাধির উপরিভাগ গ্রিল দিয়ে ঘেরা রয়েছে। ঘরের দেয়াল ও দরজায় বিভিন্ন প্রাণি, গাছ, লতা-পাতা খচিত কারুকার্য শোভা পাচ্ছে। ভেতরে রয়েছে ঝাড় বাতি ও দেব-দেবীর মূর্তি। সোনা, রুপা ও কষ্ঠি পাথরে তৈরি মূল্যবান কারুকার্যগুলি চুরি হয়ে গেছে।
আশ্রমের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জয় কর্মকার জানান, আশ্রমের অনেক সম্পত্তি প্রভাবশালীর দখলে চলে গেছে। বছরে এখানে তিনটি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সরকারি ভাবে কোন সহযোগিতা পাওয়া যায় না। ভক্তদের দানে কোন রকমে অনুষ্ঠান পাড়ি দিতে হয়। আশ্রমের সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে প্রতিদিনের খরচ চালানো হয়।
মূল ভবনের পূর্ব ও দক্ষিণ দিক জুড়ে রয়েছে শাস্ত্রীয় মতে সমাধি। আশ্রম চত্ত্বরে রয়েছে ১৪০ জন ভক্ত সাধুর সমাধি। প্রধান সমাধিগুলোর কয়েকটি হলো- পরাণ চন্দ্র সাধু (১৩০৭), মহেন্দ্র যোগেন্দ্রময়ী মাতা (১৩৩৫), জয় মঙ্গল সাধু (১৩৩৬), সুন্দর মাতা (১৩৪১), সুখময়ী মাতা (১৩৪৩), শতদল মাতা (১৩৮১) প্রমুখ। অমৃতযোগ
এখানে শ্রী শ্রী ফকির চাঁদ গোঁসাইজী ও তাঁর মুখ্য শীষ্যদের নিয়ে বাঙলা সাহিত্যের মধ্যযুগের শেষদিকে কিছু মানসম্মত সাহিত্য রচিত হয় যা ইতিহাসের অগোচরেই থেকে যায়। এর মধ্যে ব্রজনাথদত্ত নামে একজন কবির সন্ধান পাওয়া যায়। দীনহীন কাঙ্গালের উক্তি/ চাইনা ধন জন মুক্তি/ ঐ চরণে থাকে যেন ভক্তি/তার তুল্য আছে কি? আশ্রমের দেয়ালে লিখা রয়েছে এরকম অনেক আত্মতত্ত্ব বাণী। শৈব, বৌদ্ধ, তান্ত্রিক, সহজিয়া ও যোগী এ কয়েকটি ধর্মমতের সমন্বয়ে উদ্ভূত ধর্মই নাথধর্ম। এ ধর্মের মূল হলো মানবদেহ।
দেহেই বিশ্বব্রহ্মা-ের ন্যায় নিয়ত সৃষ্টিকর্ম চলছে অর্থাৎ মানব দেহই বিশ্বব্রহ্মান্ডের ক্ষুদ্ররুপ বা অংশ। অপরিপক্ক দেহকে যোগ বা সাধনার দ্বারা পরিপক্ক করতে পারলে শিবত্ব বা অমরত্ব লাভ করা যায়। এই অমরত্ব লাভের সাধনার নামই ‘যোগ’। যোগসাধন পন্থী উক্ত সম্প্রদায়ের গুরু ছিলেন মীননাথ। গুরুদেবের নামের শেষে ‘নাথ’ থাকায় ‘নাথযোগী’ সম্প্রদায় নামে পরিচিত।
সাধক পদ্ধতির ভিন্নতায় নাথপন্থিরা নাথযোগী, কাপালীযোগী ও অবধূতযোগী শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। সিদ্ধাছাড়া অন্যান্যরা গৃহী। সিদ্ধাযোগী ও যোগিনীরা বিশেষ ধরনের পরিচ্ছদ, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ও কানে কুন্ডল পড়ে লোকালয়ে ঘুরে বেড়াতো এবং গোরক্ষনাথ, গোপীচন্দ্রের সন্যাস, নাথগীতিকা, দোহা ইত্যাদি নাথ ধর্মের মাহাত্মামূলক গান পরিবেশন করে ভিক্ষালব্দ অন্নে জীবিকা নির্বাহ করতো।
অনুষ্ঠান উৎযাপন কমিটির উপদেষ্টা মো. আব্দুল করিম জানান, অনুষ্ঠান উদযাপনে গ্রামের হিন্দু মুসলিম উভয়ের সহযোগিতা করেন। ভক্তদের অনুদান ছাড়া সরকারের কোন সহযোগিতা পাওয়া যায়না। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
প্রতি বছর দোল পূর্ণিমা, গঙ্গা স্নান ও নবান্ন উৎসব উপলক্ষে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার ভক্ত সাধক সমবেত হন। সাধু ফকির চাঁদ বৈষ্ণবের মৃত্যুর পর নওপাড়ার জমিদার তারকেস্বর বাবু তাঁর (সাধুর) স্মরণে সমাধিটি পাকা করে দেন। এ ছাড়াও ভক্তদের সুবিধার্থে ২০ বিঘা জমি ও সান বাঁধানো বিশাল দুটি পুকুর দান করেন। আশ্রম চত্ত্বরে দালান কোঠা নির্মানেও সহযোগিতা করেছিলেন তিনি।
আশ্রমের প্রধান সেবাইত শ্রী সদানন্দ সাধু জানান, তিন শতাধিক বছরের প্রাচীন আশ্রম ভক্তদের অর্থানুকুল্যে চলে। আশ্রমের মোট ৪২ বিঘা জায়গা। আবাদি জমি ও পুকুরে মাছ রয়েছে। অনেক জমি প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে। ফলে আশ্রম পরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। শ্রী সরুপানন্দ সাধু ও শ্রীমতি শুকী মাতা সহকারী সেবাইত হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানান তিনি।
আশ্রমের নিজস্ব সম্পদ ও অনেক জমি আত্মসাৎ হয়ে গেছে। চুরি হয়ে গেছে মূল্যবান সম্পদ । নষ্ট হয়ে যাচ্ছে স্থাপত্য শিল্পের এই নিদর্শন। সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ না থাকায় নাটোরের সচেতন মহল হচ্ছেন মর্মাহত।