নাটোর শহর লাগোয়া গ্রাম গুলোতে আবাদ হচ্ছে কলমি শাকের। শহরের যানজট আর কোলাহল ছাড়িয়ে,পাখির কলতানে মুখরিত নাটোর সদর উপজেলার ১০ নং হরিশপুর ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের মন্ডল পাড়া গ্রাম। বিলের বুকচেরা পথের দুই পাশে নারিকেল আর বিভিন্ন গাছ, যেন পাখির অভয়ারণ্য, বিবিধ পাখির কলতানে মুখরিত গ্রামটি, ঘুঘু কবুতরের বসতি একই স্থানে,পথের উপর ঘুঘু পাখি বসে আহার করছে ।
রাস্তার পাশেই চোখে পড়ল জমির ভিতর অজস্র কলমি ফুল, আগ্রহভরে এগিয়ে গিয়ে ছবি তুলতে লাগলে পেছন থেকে পঞ্চাশোর্ধ একটি মহিলা বলল ‘বাবু, ছবি উঠাইতেছ?’ নাম তার কাজলি পাহান,পরিশ্রান্ত এক আদিবাসী কৃষাণী জানালেন হাইব্রিড জাতের কলমি শাক জমিতেই আবাদ হয়, এই গ্রামের অনেকেই জমিতে আবাদ করে, বছরে একবার রোপণ করলে প্রায় পাঁচ মাস পর্যন্ত এ আবাদ স্থায়ী হয়, প্রতিদিন উত্তোলন করা হয় জমি থেকে এবং বাজারজাত করা হয়, অন্য আবাদের চেয়ে খরচ অনেক কম হয় তাই এই গ্রামের অনেকেই কলমি শাকের আবাদ করছেন বলে জানালেন তিনি।
দামে খুব স্বস্তা অথচ পুষ্টিগুণে অনন্য এমন খাবারের নামের তালিকায় উঠে আসবে কলমি শাকের নাম, কলমি শাক মূলত ভাজি অথবা ঝোল রান্না করে ভাতের সঙ্গে খাওয়া হয়, এছাড়া এই শাক দিয়ে পাকোড়া, বড়া ইত্যাদি তৈরি করে খাওয়া যায়, নাটোরের অধিকাংশ মানুষ তাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য শাকসবজি ও ফলমূলের উপর নির্ভর করে, মাছ, মাংস ও ডিমের তুলনায় শাকসবজি দামে কম বলে মানুষ তার পুষ্টির চাহিদা মেটানোর জন্য শাকসবজির ওপর নির্ভর করে এবং নাটোরের সব উপজেলাতেই বিভিন্ন ধরণের শাকসবজি ও ফলের চাষ হয়।
কলমী শাকে রয়েছে অনেক ঔষধী গুণ, কলমি শাক আঁশজাতীয় একটি খাবার, এতে খাদ্যউপাদান রয়েছে প্রচুর পরিমানে,মন্ডলপাড়া গ্রামের সবচেয়ে লাভবান কৃষক কাজী আব্দুর রাজ্জাক, তিনি দুই বিঘা জমিতে কলমি শাকের আবাদ করেন দুই বছর আগে রোপণ করেছিলেন, প্রতিদিনই উত্তোলন করছে জমি থেকে শাক এবং বাজারজাত করছে নিজেই, প্রতিদিন তার প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা রোজগার হয়, তিনি জানালেন ৫ দিন পর পর সার দিতে হয়, কলমি শাকের আবাদ করে লাভবান হয়েছেন বলে জানালেন তিনি।
কৃষক পলান মণ্ডল জানালেন তিনি সাত শতক জায়গাতে কলমি শাকের আবাদ করেছিলেন, তিন মাসে সার বীজ ও জমি প্রস্তুত বাবদ মোট তার ব্যয় হয়েছিল বারোশো টাকা, তিন মাসে তিনি শাক বিক্রি করেছেন সর্বমোট প্রায় দশ হাজার টাকা। তিনি আরো বলেন, কলমি শাক আবাদে ব্যয় কম তাই লাভের পরিমাণ বেশি, বর্তমানে জমিতে ফুল হয়ে গেছে ফুল হলে এই শাক খেতে ভালো লাগে না দামেও কম পাওয়া যায়।
মন্ডল পাড়ার আর একজন কৃষক মো. ইসাহাক শেখ ১০ কাঠা জমিতে করেছিলেন কলমি শাকের আবাদ, তার সর্বমোট ব্যয় হয়েছিল পাঁচ হাজার টাকা, তিনি প্রতিদিন ২০০ টাকার শাক বিক্রি করেন, পাঁচ মাস যাবৎ তিনি উত্তোলন করছেন শাক, পাঁচ মাসে তিনি সর্বমোট ৩০ হাজার টাকার কলমি শাক বিক্রয় করেছেন।
সুদীপ মন্ডল বলেন, এই গ্রামের প্রায় ২০ জন কৃষক কলমি শাকের আবাদ করে লাভবান হয়েছে, তবে সরকারিভাবে কোনো বীজ বিনামূল্যে তাদেরকে দেওয়া হয়না বা ফসল রক্ষণাবেক্ষণ এর জন্য কোন মাঠকর্মী কেউ মাঠে তারা পায়না।
আধুনিক সদর হাসপাতালেন সাবেক মেডিক্যাল অফিসার ডা.মো.আবুল কালাম আজাদ জানান, কলমি শাকে ক্যালসিয়াম থাকে বলে এই শাক হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে, কলমিতে ভিটামিন ‘এ’ আছে, এই শাকে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি, ছোটবেলা থেকেই শিশুদের কলমি শাক খাওয়ানো উচিত, পর্যাপ্ত পরিমানে লৌহ থাকায় এই শাক রক্ত শূন্যতার রোগীদের জন্য উপকারি।
রক্তে হিমোগ্লোবিনের অনুপাত ঠিক রাখে, জন্মের পর শিশু মায়ের বুকের দুধ না পেলে মাকে কলমি শাক রান্না করে খাওয়ালে শিশু পর্যাপ্ত পরিমানে দুধ পাবে, এটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং শরীরের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করে, রাত কানা রোগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই কলমী শাক কয়েক সপ্তাহ প্রতিদিন একবেলা ভাজি করে খেলে রাত কানা রোগ ভালো হয়।
তিনি আরো জানান, গর্ভাবস্থায় গর্ভবতি মায়েদের শরীরে, হাতে-পায়ে পানি আসে, সেই সময় কলমী শাক বেশি করে রসুন দিয়ে ভেজে তিন সপ্তাহ খেলে পানি কমে যাবে, কলমি শাক চোখের জন্য বিশেষ উপকারী, দৃষ্টিশক্তি প্রখর করে, পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্যশক্তি থাকায় শারীরিক দুর্বলতা দ্রুত সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে, কলমিশাক মূলত আঁশজাতীয় খাবার, তাই শরীরের খাবার দ্রুত হজমের জন্য কলমিশাক বিশেষ উপকারী, সারা দেহে প্রয়োজনীয় রক্ত সরবরাহ ঠিক রাখতেও এই শাক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে তিনি জানালেন।
রোজী মোজাম্মেল মহিলা ডিগ্রি কলেজের বোটানিক বিভাগের অধ্যাপক সায়মা চৌধুরী রোশনী জানান- কলমি শাক এক প্রকারের অর্ধ-জলজ উষ্ণমণ্ডলীয় লতা, একে শাক হিসাবে খাওয়া হয়, এর আদি নিবাস কোথায় তা জানা যায়নি, তবে সারা বিশ্বের ক্রান্তীয় ও উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলে এটি জন্মে, ইংরেজিতে একে বলে water spinach, river spinach, water morning glory, water convolvulus, Chinese spinach, Swamp cabbage এবং এশিয়ার কিছু অঞ্চলে Kangkong কলমি শাক পানিতে কিংবা ভেজা মাটিতে জন্মে থাকে।
এর ডাঁটাগুলো ২-৩ মিটার বা আরো বেশি দীর্ঘ হয়, কলমি শাকের পাতা অনেকটা লম্বাটে ত্রিকোণাকার বা বল্লমাকার, এবং ৫-১৫ সেমি দীর্ঘ এবং ২-৮ সেমি চওড়া হয়, কলমির ফুল অনেকটা ট্রাম্পেট আকৃতির এবং ৩-৫ সেমি চওড়া হয়ে থাকে, ফুলের রঙ সাধারণত সাদা এবং গোড়ার দিক বেগুনি, ফুলে বীজ হয়, বীজ থেকেও গাছ লাগানো যায়।
পূর্ব, দক্ষিণ, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে কলমি শাকের চাষ করা হয়, প্রাকৃতিকভাবে পানিতে বা পানির ধারের ভেজা মাটিতে এই গাছ জন্মায়, আর বেশি যত্নেরও দরকার হয় না।
মালয়ী ও চীনা খাবারে এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। বাংলাদেশে এটি শাক হিসাবে বেশ জনপ্রিয়। কলমি শাক সাধারণত ভাজি হিসাবে রান্না করা হয়। এছাড়া ঝোল সহ মাছ দিয়েও রান্না করে খাওয়ার চল রয়েছে। নাটোরের কৃষকরা যেহেতু জমিতে কলমি শাক উৎপাদন করছে সে ক্ষেত্রে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য যাতে বেশিরভাগ কৃষক এই আবাদ করে সে ক্ষেত্রে তাদেরকে উৎসাহিত করা দরকার আর উৎপাদন বেশি হলে নাটোরের চাহিদা পূরণ করে তা বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করলে কৃষকরা আরো বেশি লাভবান হবে বলে তিনি মনে করেন।