চাঁদের ফাঁদে তারাবিহ, রোজা, ফেতরা ও ঈদ। উপবাসীরাও চাঁদের চাঁদনী খেলায় দিকভ্রান্ত; দলে-উপদলে বিভক্ত। “চাঁদ দেখে রোজা ও ঈদ” করার গোলকধাঁধায় পড়ে তারা কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলছে। যারফলে; কিছু লোক তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনোদনের নতুন মাত্রা যোগ করলেও অধিকাংশ মানুষ হয় দুর্ভোগের শিকার। এই প্রবন্ধটি ছয় পর্বে শেষ করা হয়েছে। এই পর্বে ফেতরার ও ঈদের আলোচনা করা হয়েছে।
ফেতরা (Nature):
ভূমিকা (Introduction):
ফেতরা (فطرة) আরবি পরিভাষা। যা মুসলমান সমাজে সাদাকাতুল ফিতর বা যাকাতুল ফিতর নামে পরিচিত। ফিতর বা ফাতুর বলতে সকালের খাদ্যদ্রব্য বোঝানো হয়। যা দ্বারা উপবাসীগণ উপোস ভঙ্গ করেন (আল মুজাম আল ওয়াসিত, পৃষ্ঠা ৬৯৪)। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গরীব দুঃস্থদের মাঝে উপবাসীর বিতরণ করা দানকে সাদাকাতুল ফিতর বা যাকাতুল ফিতর বলা হয়। উপবাস পালনের পর সন্ধ্যায় ইফতার বা সকালের খাদ্য গ্রহণ করা হয়। সেজন্য; রমজান মাস শেষে এই দানকে সাদাকাতুল ফিতর বা যাকাতুল ফিতর বলা হয় (ফাতহুল বারী ৩, পৃষ্ঠা ৪৬৩)।
নারী-পুরুষ, স্বাধীন-পরাধীন, শিশু-বৃদ্ধ, ছোট-বড় সকল মুসলিমের জন্য ফেতরা প্রদান করা ওয়াজিব। ইবনে উমর (রাঃ) থেকে জানা যায়; “عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رضي الله عنهما قَالَ : فَرَضَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم صَدَقَةَ الْفِطْرِ – أَوْ قَالَ رَمَضَانَ – عَلَى الذَّكَرِ وَالأُنْثَى ، وَالْحُرِّ وَالْمَمْلُوكِ : صَاعاً مِنْ تَمْرٍ , أَوْ صَاعاً مِنْ شَعِيرٍ . قَالَ : فَعَدَلَ النَّاسُ بِهِ نِصْفَ صَاعٍ مِنْ بُرٍّ, عَلَى الصَّغِيرِ وَالْكَبِيرِ .وَفِي لَفْظٍ : أَنْ تُؤَدَّى قَبْلَ خُرُوجِ النَّاسِ إلَى الصَّلاةِ – متفق عليه”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক স্বাধীন-ক্রীতদাস, নারী-পুরুষ, ছোট-বড় মুসলমানের যাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন এক ‘সা’ পরিমাণ খেজুর বা যব। তিনি লোকদের ঈদের নামাজে বের হওয়ার পূর্বেই তা আদায় করার আদেশ দিয়েছেন (মুত্তাফাকুন আলাই)।
ফেত্বরা فطرةবি প্রকৃতি, স্বভাব, ধর্ম, পদ্ধতি, নিয়ম, প্রথা, সহজাত প্রবৃত্তি; যেমন; ‘فطرة الإنسان’ (ফাতারাত আলইনসান) মানব প্রকৃতি (প্র) মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক সংস্কার মতে; নির্বাণ উৎসবের পূর্বে প্রদানকৃত নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য (ব্য্য) এছাড়াও; একে যাকাতুল ফিতর, সাদাকাতুল ফিতর ইত্যাদিও বলা হয় (শ্ববি) শুক্র, বীর্য, বিন্দু, semen, মনি (আ.ﻤﻧﻰ), নুত্বফা (আ.ﻧﻂﻔﺔ) (আভা) গোবিন্দ, জল, বারি, পিতৃধন স্ত্রী অহল্যা, কালী, দুর্গা, বৈষ্ণবী, সীতা (আদৈ) আদম (আ.ﺍﺪﻢ), ওয্যা (আ.عُزَّىْ), জিন (আ.ﺠﻦ), পরি (ফা.ﭙﺮﻯ), যাকাত (আ.ﺯﻜﺎﺓ), লুত্ব (আ.ﻟﻮﻄ) স্ত্রী জুলেখা (আ.ﺯﻟﻴﺠﺎ), বিলকিস (আ.بلقيس)। এছাড়াও; শুক্র দ্বারা সর্বদাই সর্বক্ষেত্রে নারীচরিত্র রূপায়ন করা হয়। যেমন; কালী ও জুলেখা (আ.ﺯﻟﻴﺠﺎ) ইত্যাদি (দেপ্র) শুক্র পরিবারের সদস্য ও পৌরাণিক একটি দেবতা; (সংজ্ঞা) ১. সাধারণত; ইসলামী শাস্ত্রীয় সংস্কার মতে; ঈদুল ফিতরের সালাতের পূর্বে উপবাসীদের প্রদেয় অর্থ ও দ্রব্যকে ফেত্বরা (فطرة) বলা হয় ২. মরমীবাদে মৈথুনের সময়ে শিশ্ন হতে নিঃসৃত শুভ্রবর্ণের তরল পদার্থকে রূপকার্থে বাংলা মানব প্রকৃতি ও আরবিতে ফেত্বরা (فطرة) বলা হয় (বাপৌউ) আঙ্গুর, খেজুর, রুটি, ফল (বাপৌচা) রতী (বাপৌরূ) ধন (বাপৌমূ) শুক্র {আ}
ঈদুল ফিত্বর ﻋﻴﺪ ﺍﻟﻔﻄﺮবি প্রাতরাশ উৎসব, ভোজন উৎসব, প্রাতরাশ আনন্দ, ভোজন আনন্দ (প্র) ইসলামী সংস্কার অনুসারে; চান্দ্রবর্ষের শাওয়াল চান্দের প্রথম দিনে অনশন সমাপ্তির আনন্দ বিশেষ (শ্ববি) সাঁই ভোজন দ্বারা শুক্ররক্ষার পরিসমাপ্তি করার আনন্দ উল্লাস, সাঁই সাধনের দ্বারা সাঁই দর্শনের পর শুক্রপাত উৎসব। অর্থাৎ; জন্ম-মরণের হাত হতে মুক্তি বা নির্বাণলাভের আনন্দ উল্লাস {আ.ঈদ.ﻋﻴﺪ +আ. ফিত্বর.ﻔﻄﺮ}
কে ফেতরা দেবে? (Who will give the nature?):
ফেতরা দেয়ার সামর্থ্য আছে (একদিন ও এক রাতের খাদ্যের অতিরিক্ত পরিমাণ সম্পদ থাকলে) এরকম প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজের ও পরিবারের সমস্ত সদস্যদের পক্ষ থেকে ফেতরা প্রদান করা ফরজ। যাদের লালনপালনের দায়িত্ব শরীয়ত কর্তৃক তার ওপরে অর্পিত হয়েছে (আল মুগনী, ৪/৩০৭, বুখারী হাদীস নং ১৫০৩)। যার নিকট এক দুই বেলার খাবার ব্যতীত অন্য কিছু নেই তার ফেতরা দেয়ার প্রয়োজন নেই (সউদী ফাতাওয়া বোর্ড, ৯/৩৮৭)।
কে ফেতরা পাবে? (Who will get the nature?):
গরীব, দুঃস্থ, অসহায়, অভাবগ্রস্থ ব্যক্তিকে ফেতরা প্রদান করা যাবে।
দাস/ দাসীকে ফেতরা দেওয়ার নিয়ম (The rules for giving the nature to the servants):
বেতনভুক্ত কাজের ব্যক্তির পক্ষে ফেতরা প্রদান করা মালিকের ওপর আবশ্যক নয়। তবে; মালিক ইচ্ছে করলে কাজের লোককে ফেতরা প্রদান করতে পারবেন। কিন্তু; তিনি বেতন বা পারিশ্রমিক রূপে ফেতরা প্রদান করতে পারবেন না।
ফেতরার বস্তু (The objects of the nature):
আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) বলেন; “আমরা-নবী (সাঃ) এর যুগে যাকাতুল ফিতর ধার্য করতাম এক সা খাদ্য দ্রব্য কিংবা এক সা যব কিংবা এক সা খেজুর কিংবা এক সা পনীর কিংবা এক সা কিশমিশ (বুখারী শরীফ, হাদিস ১৫০৬/ মুসলিম শরীফ, হাদিস ২২৮১)।
এই হাদীসে খেজুর ও যব ছাড়া আরও যে কয়েকটি বস্তুর নাম পাওয়া যায়, তা হলো; কিশমিশ, পনীর এবং খাদ্য দ্রব্য। উল্লেখ থাকে যে; নবী (সাঃ) এর বিদায় হওয়ার পরে মুআবীয়া (রাযিঃ)-এর খেলাফতে অনেকে গম দ্বারাও ফেতরা দিতেন (বুখারী হাদীস নং ১৫০/ মুসলিম ২২৮১)।
খাদ্যদ্রব্য দ্বারা ফেতরা দেওয়া (To give the nature by the food):
সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায়; খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফেতরা প্রদানের কথা। যেহেতু; চাল বাংলাদেশ সহ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান খাদ্য। সেহেতু; চাল দিয়েও ফেতরা প্রদান করা যাবে। চালের বদলে ধান দিয়ে ফেতরা দিতে হলে ওজনের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। কারণ এক সা ধান এক সা চালের সম মূল্যের হবে না। কুরান থেকে জানা যায়;
“يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنفِقُوا مِن طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُم مِّنَ الْأَرْضِ ۖ وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنفِقُونَ وَلَسْتُم بِآخِذِيهِ إِلَّا أَن تُغْمِضُوا فِيهِ ۚ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ” অর্থ; হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা স্বীয় উপার্জন থেকে এবং যা আমি তোমাদের জন্যে ভূমি থেকে উৎপন্ন করেছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট বস্তু ব্যয় করো এবং তা থেকে নিকৃষ্ট বস্তু ব্যয় করতে মনস্থ করো না। কেননা; তা তোমরা কখনও গ্রহণ করবে না; তবে; যদি তোমরা চোখ বন্ধ করে নিয়ে নাও। জেনে রেখো; কাঁই অভাব মুক্ত, প্রশংসিত। (কুরান; ২ নং সুরা বাক্বারাহ- ২৬৭)।
তবে; ধানের থেকে চাল দিয়ে ফেতরা প্রদান করা উত্তম। নিম্নোক্ত কিয়াস থেকে এই ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যায়; যবের ওপর কেয়াস (অনুমান) খাটিয়ে ধানের ফেতরা জায়েয হবে না। কারণ; ধান আদৌ আহার্য সামগ্রী নয়। আহার্য বস্তুর ওপর কিয়াস করে যব বা খুর্মার ফেতরা দেওয়া হয়। তাআম বা আহার্য সামগ্রীরূপে ফেতরা দিতে হলে এক সা চাউল দিতে হবে (তর্জুমানুল হাদীস, ২য় বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, রবিউল আওয়াল, ১৩৭০ হি)।
টাকা দ্বারা ফেতরা দেওয়া (To give the nature by the money):
মুহাম্মদ (সঃ) এর যুগে মুদ্রা রূপে দিরহাম প্রচলিত ছিল। দিরহামের দ্বারা কেনা কাটা, দান খয়রাত করা হতো। তবে; সাহাবী খুদরী বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায়; মুহাম্মদ (সঃ) খাদ্যবস্তু দিয়ে ফেতরা প্রদান করতেন। এজন্য; মুসলমান পণ্ডিতদের বড় অংশ টাকা দিয়ে ফেতরা প্রদানের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন। ইমাম আহমদ (রঃ) বলেন; রাসুল (সঃ) এর সুন্নতের বিপরীত হওয়ার কারণে আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে; তা যথেষ্ট হবে না (মুগনী, ইবনু কুদামাহ, ৪/২৯৫)।
তবে; প্রয়োজনে টাকা দিয়েও ফেতরা আদায় করা বৈধ। বাংলাদেশের মুসলমানগণ টাকা দিয়ে ফেতরা আদায় করতে চাইলে ২.৪০ (দুই কেজি চল্লিশ গ্রাম) মধ্য মানের চাউলের মূল্য পরিশোধ করতে হবে। অবশ্য বাংলাদেশ যাকাত বোর্ড প্রতি বছর নগর ও পল্লীর জন্য ফেতরার মূল্য নির্ধারণ করে দেন। তাছাড়া; সম্ভব হলে ধান বা খাদ্যবস্তু দিয়ে ফেতরা প্রদান করা উচিত।
সা এবং অর্ধ সা (Sa and half Sa)
ফেতরা প্রদানের পরিমাপ সংক্রান্ত আলোচনায় সা বহুল আলোচিত শব্দ। সা হচ্ছে আরবদেশে ওজন বা পরিমাপে ব্যবহৃত পাত্র। বাংলাদেশে যেমন ধান পরিমাপের জন্য এক সময় কাঠা ব্যবহৃত হতো। একজন মাঝামাঝি শারীরিক গঠনের মানুষ অর্থাৎ অধিক লম্বা নয় এবং বেঁটেও নয়, এই রকম মানুষ তার দুই হাত একত্রে করলে যে অঞ্জলি গঠিত হয়, ঐরকম পূর্ণ চার অঞ্জলি সমান হচ্ছে এক সা (ফাতাওয়া মাসায়েল/ ১৭২-১৭৩/ সউদী ফাতাওয়া ও গবেষণা বিষয়ক স্থায়ী কমিটি, ফতোয়া নং ৫৭৩৩ খণ্ড ৯য় পৃ: ৩৬৫)।
হাদিস থেকে সুস্পষ্ট জানা যায় মুহাম্মদ (সঃ) এর এক সা পরিমাণ ফেতরা প্রদানের কথা। মুহাম্মদ (সঃ) এবং চার খলিফার মৃত্যুর পরে মুয়াবিয়া (রাঃ) ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা নির্বাচিত হন এবং ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী মদিনা থেকে দামেস্ক স্থানান্তরিত করেন। তখন তারা গমের সাথে পরিচিত হন। সে সময় সিরিয়ার গমের মূল্য খেঁজুরের দ্বিগুণ ছিল। তাই; খলিফা মুয়াবিয়া একদা হজ্জ বা উমরা করার সময় মদীনায় এসে বলেন; আমি অর্ধ সা গমকে এক সা খেজুরের সমতুল্য মনে করি। লোকেরা তার এই কথা মেনে নেয়। এরপর থেকে মুসলিম জনগণের মধ্যে অর্ধ সা ফেতরার প্রচলন শুরু হয় (মুসলিম শরিফ, অধ্যায়: যাকাত, অনুচ্ছেদ: যাকাতুল ফিতর হাদীস নং ২২৮১ এবং ৮২)।
ফেতরার আত্মদর্শন (Introspection of nature):
মানবদেহে অনেক প্রকার রস রয়েছে। তারমধ্যে; ১. লালা ২. দুগ্ধ ৩. শুক্র ৪. সুধা ও ৫. মধু এই পাঁচটি রস সেবনযোগ্য। এই রসগুলোর মধ্যে নিজের মুখের লালা নিজেই সেবনযোগ্য। এছাড়া; অন্য চারটি রস সবার সেবনযোগ্য। বিশেষক্ষেত্রে বিশেষ কারণে এসব রস দান করাকেই এখানে ফেতরা বলা হয়েছে। তবে; ইসলামী শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে; চরম আনন্দের (ঈদ) আগে যে স্বভাব (ফেতরা) দেওয়ার কথা বলা হয়েছে; তা অবশ্যই শুক্র। কারণ; সাঁই সাধন ও কাঁই সাধনের জন্য শুক্র ধারণ করা আবশ্যক। তবে; সাধন শেষে আর শুক্র ধারণের প্রয়োজন নেই। তখন সাধক ইচ্ছা করলে শুক্রপাত করতে পারে। একেই চরম আনন্দের পূর্বে ফেতরা বিতরণ বলা হয়েছে।
ঈদ (Eid):
ভূমিকা (Introduction):
ইসলামী সাম্প্রদায়িক মতবাদের অনুসারীদের প্রধান সাম্প্রদায়িক উৎসবগুলোকে ঈদ বলা হয়। আরবি ‘عيد’ ঈদ পরিভাষাটির আভিধানিক অর্থ উৎসব। তবে; ঈদ বলতে প্রধানত ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাকে বুঝায়।
ঈদ ﻋﻴﺪবি আনন্দ, উল্লাস, হর্ষ, অনুষ্ঠান, পর্ব, আনন্দ উৎসব, বিশেষ আনন্দের অনুষ্ঠান, feast, festival (প্র) ইসলামী সংস্কার অনুসারে; মুসলমানদের প্রতি বছর উদযাপিত দুটি বিশেষ অনুষ্ঠান। যথা; ১. ঈদুল ফিতর ও ২. ঈদুল আযহা (শ্ববি) কঠোর সাধনার পর সাঁই ও কাঁই দর্শনের আনন্দ বিশেষ {আ}
ঈদুল ফিতরের সংজ্ঞা (Definition of Eid al-Fitr)
রমজান মাসে দীর্ঘ এক মাস উপোস সাধনার পর শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে আনন্দ উদযাপনকে ঈদুল ফিতর বলা হয়।
দীর্ঘ এক মাস উপোস সাধনার পর মুসলমানেরা এই দিনটি শাস্ত্রীয় কর্তব্যপালনসহ অতি আনন্দের সাথে পালন করে থাকে। হিজরি বর্ষপঞ্জী অনুসারে; রমজান মাসের শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিন ঈদুল ফিতর উৎসব পালন করা হয়। তবে; এই পঞ্জিকা অনুসারে কোনো অবস্থাতে রমজান মাস ৩০ দিনের অধিক দীর্ঘ হবে না। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে রমজানের সমাপ্তিতে শাওয়ালের প্রারম্ভ গণনা করা হয়। ঈদের আগের রাতটিকে ইসলামী পরিভাষায় পুরস্কার রজনী (লাইলাতুল জায়জা) বলা হয়। এবং চলতি ভাষায় ‘চাঁদ রাত’ বলা হয়। শাওয়াল মাসের নতুন চাঁদ দেখা গেলে পরদিন ঈদ হয়। এই কথা থেকেই চাঁদ রাত কথাটির উদ্ভব। ঈদের চাঁদ স্বচক্ষে দেখে তবেই ঈদের ঘোষণা দেয়া ইসলামী বিধান। আধুনিক কালে অনেক দেশে গাণিতিকভাবে ঈদের দিন নির্ধারিত হয়। তবুও; বাংলাদেশে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে দেশের কোথাও না-কোথাও চাঁদ দর্শনের ওপর ভিত্তি করে ঈদের দিন নির্ধারিত হয়। দেশের কোনো স্থানে স্থানীয়ভাবে চাঁদ দেখা গেলে যথাযথ প্রমাণ সাপেক্ষে ঈদের দিন ঠিক করা হয়। মুসলমানদের জন্য ঈদের পূর্বে পুরো রমজান মাস উপোস করা হলেও ঈদের দিনে উপোস করা নিষিদ্ধ।
ঈদের নামাজ (Heat of Eid:)
ঈদের দিন ভোরে মুসলমানরা কাঁইয়ের উপাসনা করে থাকে। ইসলামী বিধান অনুসারে; ২ রাকাত ঈদের নামাজ ৬ তাকবিরের সাথে বড় মাঠে বা বড় মসজিদে পড়া হয়। ফযরের নামাযের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পর ঈদুল ফিতরের নামাযের সময় হয়। এই নামায আদায় করা মুসলমানদের জন্য আবশ্যক। ইসলামী সাম্প্রদায়িক শাস্ত্রে শুক্রবারে জুম্মার নামাজের পূর্বে ইমাম কর্তৃক বক্তব্য দেওয়ার নিয়ম বর্ণিত আছে। কিন্তু ঈদের নামাজের ক্ষেত্রে নামাজের পরে বক্তব্য দেওয়ার নিয়ম। ইসলামী শাস্ত্রীয় বর্ণনা অনুযায়ী; ঈদুল ফিতরের নামাজ শেষে বক্তব্য দেওয়া ইমামের জন্য সুন্নত; তা শ্রবণ করা নামাযীর জন্য আবশ্যক। সাধারণত: ঈদের নামাজের পরে মুসলমানরা সমবেতভাবে প্রার্থনা করে থাকে। তারপর; একে অন্যের সাথে কোলাকুলি করে ঈদের সম্ভাষণ বিনিময় করে থাকে। ঈদের বিশেষ শুভেচ্ছাসূচক সম্ভাষণটি হলো; ‘ঈদ মুবারাক’। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়।
ইসলামী সাম্প্রদায়িক শাস্ত্রীয় নিয়ম অনুসারে; ঈদের নামাজ আদায় করতে যাওয়ার আগে একটি খেজুর কিংবা খোরমা অথবা মিষ্টান্ন খেয়ে যাত্রা করা অধিক পুণ্যের কাজ। ঈদুল ফিতরের ব্যাপারে ইসলামী নির্দেশসমূহের মধ্যে রয়েছে; স্নান করা, দাঁতন করা, আতর-সুরমা লাগানো, এক রাস্তা দিয়ে ঈদের মাঠে গমন এবং নামাজ-শেষে ভিন্ন পথে গৃহে প্রত্যাবর্তন। এছাড়াও; সর্বাগ্রে স্নানের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার বিধানও রয়েছে। ইসলামে নতুন বসন পরিধান করার বাধ্যবাধকতা নেই। তারপরও; বিভিন্ন দেশে তা বহুল প্রচলিত একটি রীতিতে পরিণত হয়েছে।
ঈদের নামাজ সবার জন্য। নামাজের পর সবাই একসাথে হওয়া, দেখা করা। এসময় বাংলাদেশে ছোটরা বড়দের পা ছুঁয়ে সালাম করে এবং সালামি গ্রহণ করে। ঈদের দিনে সালামি গ্রহণ করা প্রায় সব দেশেই রীতি আছে। তবে; এর শাস্ত্রীয় কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ঈদের দিনে সেমাই সবচেয়ে প্রচলিত খাবার। এছাড়াও; আরো অনেক প্রকার খাবার ধনী-নিঃস্ব সকলের ঘরে প্রস্তুত হয়। এ উৎসবের আরো একটি রীতি হলো আশেপাশের সব বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া। এবং প্রত্যেক বাড়িতেই হালকা কিছু খাওয়া। এ রীতি বাংলাদেশে সবাইই মেনে থাকে।
বাংলাদেশ সহ অন্যান্য মুসলিম-প্রধান দেশে ঈদুল ফিতরই হলো বৃহত্তম বাৎসরিক উৎসব। বাংলাদেশে ঈদ উপলক্ষে সারা রমজান মাস ধরে সন্ধ্যাবেলা কেনাকাটা চলে। অধিকাংশ পরিবারে ঈদের সময়েই নতুন বসন কেনা হয়। পত্র-পত্রিকাগুলো ঈদ উপলক্ষে ঈদ সংখ্যা নামে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো ঈদের দিন থেকে আরম্ভ করে পরবর্তী কয়েকদিন বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করে। ঈদের দিন ঘরে ঘরে সাধ্যমত বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়। ঈদের দিনে সেমাই বা অন্যান্য মিষ্টি নাস্তা প্রস্তুত করার চল রয়েছে। বাংলাদেশের নগরগুলো হতে ঈদের ছুটিতে প্রচুর লোক নিজেদের আদি নিবাসে বেড়াতে যায়। এ কারণে ঈদের সময়ে রেল, সড়ক ও নৌপথে প্রচণ্ড ভিড় দেখা যায়।
ঈদের চাঁদ দেখার সময়কার আনন্দমুখর পরিবেশকে নিয়ে লেখা ও সুর করা কাজী নজরুল ইসলামের “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।” গানটি বেশ জনপ্রিয়। ঈদের দিনে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে এই গানটি বাজানো হয়।
ঈদুল আযহা (Eid-ul-Azha):
ঈদুল আযহা ইসলামী সাম্প্রদায়িক মতবাদের অনুসারীদের সবচেয়ে বড় দুইটি উৎসবের একটি। বাংলাদেশে এই উৎসবটি কুরবানির ঈদ নামে পরিচিত। ঈদুল আযহা বাক্যাংশটির অর্থ হলো ত্যাগের উৎসব। আসলে এটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ত্যাগ করা। এ দিনটিতে মুসলমানেরা তাদের সাধ্যমত উট, দুম্বা, মহিষ, গরু ও ছাগল কোরবানি বা জবাই দেয়। এটি আমাদের আলোচনার প্রাসঙ্গিক বিষয় নয় বিধায় আলোচনা এখানেই শেষ করা হয়েছে।
ঈদের আত্মদর্শন (Introspection of Eid:):
দেহ পঞ্জিকা অনুসারে; আত্মতাত্ত্বিক ও মরমী সাধকগণ নিজেরমধ্যেই নিজের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার অন্বেষণ করেন। নিরাকার সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা এক সময় রস আকারে দৃশ্যমান হয়। এই সময়ে সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার দর্শন লাভের জন্য সাধকের শুক্র রক্ষার প্রয়োজন হয়। তবে; সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার দর্শন লাভের পর; আর শুক্র রক্ষার প্রয়োজন হয় না। তখন শুক্রপাত করায় কোনো দোষ নেই। এই শুক্রপাত করাকেই এখানে একবার ফেতরা বলা হয়েছে; আরেকবার বলি দেওয়া বলা হয়েছে। ঈদুল আযহায় বলির জন্য ইসহাকের ইসলামী পৌরাণিক কাহিনী বর্ণনা করা হয়। মূলত; আরবি ‘إسحاق’ (ইসহাক) পরিভাষাটি উৎপন্ন হয়েছে ‘سحق’ (সহাক) হতে। আরবি ‘سحق’ (সহাক) অর্থ crush, নিংড়ানো। এর ভাবার্থ শুক্রপাত করা। সাধক সাধনবলে সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার দর্শন লাভ করেন। তারপর; যদি শুক্রপাত করে তবে; তাকে আরবিতে ফেতরা বা যবহুন বলা হয়। সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার দর্শন লাভের সময়কেই সাধক জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময় মনে করে। আর এই সময়কেই আরবি মরমীবাদে ঈদ (আনন্দ) বলা হয়।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা পরিষ্কারভাবেই বুঝা যায় যে; মানুষের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার দর্শন লাভকেই প্রকৃত আনন্দ বলা হয়। আর প্রকৃত আনন্দ সম্পাদিত হয় দেহ পঞ্জিকা অনুসারে। সৌর বা চান্দ্র পঞ্জিকা দ্বারা কেবল সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা করা হয়। সাধন সম্পন্ন হয় দেহ পঞ্জিকা অনুসারে। তাই; কোন চাঁদ দ্বারা তারাবিহ, রোজা, ফেতরা, ঈদ, সাহরি ও ইফতার করবেন সিদ্ধান্ত আপনার।