কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন- “স্বর্ণলতার ফুল, হয়তো বা বনচ্ছায়া লতাগুল্ম, পল্লবের তলে,ঘুমায়ে রহিবে তুমি নীল শষ্পে, শিশিরের দলে।” প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে যে কয়েকটি লতা, তাদের অন্যতম হচ্ছে স্বর্ণলতা বা আলোকলতা। নাটোরের পথে প্রান্তরে আপন রূপের মহিমা ছড়ায় এই উদ্ভিদ তার নিজের মত করে।
নাটোরের গ্রামের পথের পাশে, বড় কিংবা ছোট গাছের ডালে জড়িয়ে থাকে হলদে-সবুজাভ বর্ণের একধরনের লতা। সেই লতার নেই কোনো পাতা, নেই কোনো শিকড়। তবে শীতের সময় এ লতায় ফোটে দুধসাদা রঙের ছোট ঘণ্টাকার ফুল। ফুল সুগিন্ধও বটে। মধুর জন্য পিঁপড়া আসে ফুলে ফুলে। কমলা বর্ণের পুংকেশরগুলো সাদা রঙের মধ্যে দৃষ্টিনন্দন লাগে।
স্বর্ণলতা শুধুই ধারককে জড়িয়ে বেড়ে ওঠে। ধারক হতে হবে কোনো জীবন্ত গাছ। কখনো কখনো কোনো গাছকে এ লতা জড়িয়ে ধরে ঢেকে ফেলে। এটি আসলে একটি পরজীবী লতা। যে গাছের ওপর বেড়ে ওঠে, সেই গাছের কাণ্ড থেকে খাবার সংগ্রহ করে বেঁচে থাকে। ফুল ছোট এবং ফুলের বৃতি ২ মিলিমিটার, দল ৩ থেকে ৫ মিলিমিটার। এই লতা নাটোরের সব উপজেলাতে দেখা যায়।
গ্রামে বসবাসকারী বা গ্রামে যাতায়াত আছে এমন সব বয়সী মানুষ এই উদ্ভিদকে চেনেন। পরজীবী এই উদ্ভিদ বেশিরভাগ দেখা যায় বড়ই গাছের কাণ্ডে। এর সবুজাভ উজ্জ্বল রঙ বহুদূর থেকে নজর কেড়ে নেয়। এই লতিকার বেড়ে ওঠা ও ফুল ফোটার ভরা মৌসুম মুলত পৌষ থেকে চৈত্র মাস। তবে এই সময়ের আগে ও পরেও এই উদ্ভিদ জন্মে এবং এতে ফুল ফোঁটে, ফল আসে। ভরা মৌসুমের বাইরেও বেঁচে থাকে স্বর্ণলতা।
নাটোরের বৃক্ষপ্রেমিক রফিকুল ইসলাম নান্টু জানান,স্বর্নলতা একটি পরজীবী উদ্ভিদ। কোন পাতা নেই, লতাই এর দেহ কান্ড মূল সব। লতা হতেই বংশ বিস্তার করে। সোনালী রঙ এর চিকন লতার মত বলে এইরূপ নামকরণ।এর ঔষধি গুন আছে। অনেক ক্ষেত্রে আশ্রয় দাতা গাছের মৃত্যু ঘটিয়ে থাকে। নাটোরের আবহাওয়া স্বর্ণলতার জন্য অত্যন্ত অনুকূল। এর জন্ম ও বৃদ্ধি ঘটে প্রাকৃতিক উপায়েই।
সাধারণত ছোট ও মাঝারি উচ্চতার গাছ বা বেড়ার গাছে জোঁকের মতো জড়িয়ে থাকে। আশ্রয়দাতা গাছের কাণ্ডে নিজের মূল কাণ্ড গেঁথে তার সাহায্যে খাদ্য সংগ্রহ করে। তারপর নিজের শাখা-প্রশাখায় জড়িয়ে নেয় গাছটিকে। একসময় মূল কাণ্ড খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রে আশ্রয় দাতা গাছের মৃত্যুও ঘটিয়ে থাকে।
তাই অনেকেই বাড়ির আঙিনা কিংবা বাগানের ফলবতী গাছে এটির অস্তিত্ব ঝামেলার চোখে দেখে। অনেক সময় বাধ্য হয়েই এ লতার উপক্রম থেকে বাঁচার জন্য গাছের কান্ড কেটে ফেলে,ফলে আজকাল শহরে দেখাই মেলেনা , গ্রামেও কমে যাচ্ছে। আমরা একটু সচেতন হলেই বৃদ্ধি ঘটাতে পাড়ি ,ঔষধিগুণে ভরা সৌন্দর্যশালি এই স্বর্ণলতার ।
নাটোর সদর উপজেলার ৩নং দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের ৬নং ওয়াডের মতিগাঙ্গল গ্রামের মো.আব্দুর রাজ্জাক বাচ্চু জানান, এই উদ্ভিদ নিজেই যেন ফুল! তিনি ছোটবেলায় দেখেছেন তার বাড়ির মা-বোনেরা তেলের সাথে স্বর্ণলতা মিশিয়ে মাথায় ব্যবহার করত তাতে চুল কালো হত ।তার দাদাকে দেখেছেন গরুর খাদ্যের সাথে স্বর্নলতা মিশিয়ে খাওয়াতে, এই লতা খাওয়ালে নাকি গরুর দুধ বেশি হয়। তার বাসার কাছেই ছোট্ট একটি খালি জায়গার কোনায় একটা কূল গাছে এই স্বর্নলতা ছিল।
দূর থেকে দেখলে তার মনে হত ঝুরি ঝুরি হলদে সুতা ঝুলে আছে। এর উপরে রোদ পড়লে চকচক করত, ভীষণ সুন্দর লাগতো। কিন্তু পরিবারের সদস্য বৃদ্ধির কারণে বসত বাড়ি তৈরির জন্য সেই গাছগুলোকে কেটে ফেলা হয়েছিল ।তার গ্রামে এখন খুব কমই দেখা যায় এই স্বর্ণলতা কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে উজাড় হয়েছে বনজঙ্গল নির্মাণ হচ্ছে বসতবাড়ি ।
নাটোর পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের বলারীপাড়া গ্রামের বসিন্দা খন্দকার আনিছুর রহমান জানান, দুই-তিন যুগ আগেও শহরের অনেক স্থানে পথে প্রান্তরে ব্যাপকভাবে চোখে পড়তো স্বর্ণলতা। কিন্তু বর্তমানে পাড়াগাঁয়ে পথের পাশে বড়ই গাছ আর অবহেলা অনাদরে সহজে বেড়ে ওঠে না। যদিও বা কোথাও বেড়ে ওঠে এর মালিক দাঁড়িয়ে যায় এবং পরিকল্পিত ও বেশি ফলনের প্রয়োজনে প্রতি বছরই একটা সময়ে এর ডালপালা ছেঁটে ফেলা হয়। সেই গাছে নতুন ডালপালা গজায় কিন্তু স্বর্ণলতা আসে না। যদিও বা আসে তাকে আগাছা হিসেবে উপড়ে ফেলা হয়। ফলে অবলম্বন হারাচ্ছে স্বর্ণলতা। আর এভাবেই নাটোর থেকে কমে যাচ্ছে স্বর্ণলতা।
শহরের উত্তরপটুয়া পাড়ার বাসিন্দা হেকিম মো.শহিদুল ইসলাম জানান , স্বর্ণলতার অনেক ঔষধি গুণ আছে মোটা লতা পিত্তজনিত রোগে, সরু লতা দূষিত ক্ষতে, ডায়াবেটিস ও জন্ডিসে এবং বীজ কৃমি ও পেটের বায়ু নাশে খাওয়ানো হত স্বর্ণলতা। এ ছাড়া পাণ্ডুরোগ, পক্ষাঘাত, মাংসপেশির ব্যথা, বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়। এটি রক্ত পরিষ্কার করে। স্বাদে তিতা এ গাছ পিত্ত, কাশি কমায়। এ ছাড়া শ্লেষ্মা বের করে দেয়, সর্দি কমায়। স্বর্ণলতা খোসপাঁচড়া নিরাময়েও প্রয়োগ করা যায়। এর বীজ পাণ্ডু (জন্ডিস),প্রভৃতি রোগে ব্যবহার করা হত,তবে বর্তমানে এর ব্যবহার নেই।
গোল-ই-আফরোজ কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মো.সাইফুল ইসলাম জানান, স্বর্ণলতা পরজীবী উদ্ভিদ। গাছেই এর জন্ম, গাছেই এর বেড়ে ওঠা ও বংশ বিস্তার। এর ইংরেজি নাম জায়ান্ট ডডার (giant dodder). বৈজ্ঞানিক নাম কাসকিউটা রিফ্লেক্সা (Cuscuta reflexa). কাসকিউটা (Cuscuta) গণের এই উদ্ভিদের প্রজাতি রয়েছে ১৭০ টির মতো। আমাদের দেশে একে শূণ্য লতা নামেও ডাকা হয়।
এটি একবর্ষজীবী উদ্ভিদ এবং পত্রহীন। জীবন্ত গাছে জন্ম নিয়ে গাছকে অবলম্বন করেই টিকে থাকে। যে গাছে জন্মায় সেই গাছের ডাল ও কাণ্ড থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে।এই লতার হস্টেরিয়া (Hosteria) নামের চোষক অঙ্গ থাকে যার মাধ্যমে এটি আশ্রয়ী গাছ থেকে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে। দ্রুত বর্ধণশীল এ লতা অনেক শাখা প্রশাখা তৈরি করে অল্পদিনেই আশ্রয়ী গাছটিকে পুরো ছেয়ে ফেলে।
এতে ফুল আসে বসন্ত ঋতুতে। ফুল হয় ছোট, বৃত্তি হয় ২ মিলিমিটার এবং দল ৩ থেকে ৫ মিলিমিটার। ফল ধরে এবং পাকে গ্রীষ্ম ঋতুতে। বীজ থেকে বংশবৃদ্ধি ঘটে। আমাদের দেশে একে ওষধি লতা হিসেবেও গণ্য করা হয়। লতার তুলনায় ফুল ততটা সহজলভ্য নয়। গাছের বীজ ও কাণ্ড ঔষধি গুণে ভরা। লতার স্বাদ তেতো, কচলালে আঠালো ধরনের হয়।
বসন্ত-গ্রীষ্মে পত্রহীন লতায় ছোট মঞ্জরীদণ্ডে সাদা রঙের ফুল ফোটে। দেখতে অনেকটা ছোট বাতির মতো, মাথায় পাঁচ পাপড়ি, পরাগকেশর অনেকটাই অদৃশ্য। বোঁটা বেশ ছোট এবং গুচ্ছবদ্ধ। ফল পাকে বসন্তের শেষে বা বর্ষায়। সাধারনত চার প্রজাতির লতা দেখা যায়। পৃথিবীতে হলুদ, কমলা ও লাল রঙের ১০০ থেকে ১৭০ প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায় বলে জানালেন তিনি।
আমরা প্রতিনিয়তই স্বার্থপর হয়ে উঠছি। অর্থ আয় করা ছাড়া আমাদের মস্তিষ্কে যেন কোন কিছুই ঢুকছেনা! আর তাই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় যারা সহায়ক ভূমিকা পালন করছে, সেই সমস্তকিছু নিজ স্বার্থে নিধন করে চলেছি। সৌন্দর্য, শোভা বর্ধন আমাদের ভিতর থেকে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এমন মানসিকতার পরিবর্তন আসা প্রয়োজন বলে মনে করছেন নাটোরের সচেতন মহল।