৬ মে, শেষ কর্ম দিবসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে কমপক্ষে ১৩৭ জন শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবন ত্যাগ করেন।
গতকাল ছিল উপাচার্য আবদুস সোবহানের মেয়াদের শেষ দিন। সকাল থেকেই উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কয়েকটি গাড়ি দেখা যায়। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনি বেলা সোয়া দুইটার দিকে উপাচার্যের বাসভবন ছেড়ে যান।
সকাল থেকেই প্যারিস রোড, প্রশাসন ভবন, শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, চাকরি প্রত্যাশী সাবেক ও বর্তমান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অবস্থান করছিলেন। সকাল থেকে সবার কাছে অ্যাডহকে নিয়োগের কথা ছড়িয়ে পড়ে।
বেলা ১২টার দিকে মহানগর ছাত্রলীগের শতাধিক নেতা-কর্মী শেখ রাসেল স্কুলের মাঠ থেকে প্যারিস রোডে শোডাউন দিয়ে প্রশাসন ভবনের সামনে আসেন। এরপর তাঁরা প্রশাসন ভবনের পাশে শহীদ শামসুজ্জোহা চত্বরে অবস্থান নেন। এ সময় সেখানে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিপ্রত্যাশী সাবেক ও বর্তমান ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, মাস্টাররোলের কর্মচারীর মুখোমুখি অবস্থায় চলে যান।
সকালে ক্যাম্পাসে রটে যায়, উপাচার্যের বাসভবনে পরিষদ শাখার দপ্তরপ্রধান সহকারী রেজিস্ট্রার মামুন-অর-রশীদকে নতুন রেজিস্ট্রার নিয়োগ দিয়ে অ্যাডহকে শতাধিক কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া সম্পন্ন হয়েছে। এ বিষয়ে ‘দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষকবৃন্দ’-এর মুখপাত্র অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, ‘আমরাও জেনেছি, উপাচার্য এম আব্দুস সোবহান শেষ দিনে শতাধিক নিয়োগ দিয়েছেন। তবে এখনো নিয়োগপত্র দেননি বলে শুনেছি।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, দুপুর সাড়ে ১২টায় উপাচার্যের বাসভবন থেকে সহকারী রেজিস্ট্রার মামুন-অর-রশীদ এবং রেজিস্ট্রার দপ্তরের সহকারী রেজিস্ট্রার তরিকুল আলম বেরিয়ে আসেন। এ সময় মহানগর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্যারিস রোডেই মামুন-অর-রশীদকে ঘিরে ধরেন। তাঁকে মারধর শুরু করলে হবিবুর রহমান হলের সেকশন অফিসার আবদুল্লাহ আল মাসুদ এগিয়ে যান। মহানগর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মাসুদকে মারধর করে তাঁর জামা ছিঁড়ে ফেলেন। তিনি রাস্তার পাশের ড্রেনে জমা পানিতে পড়ে যান। শরীরচর্চা শিক্ষা বিভাগের সহকারী পরিচালক কামরুজ্জামান চঞ্চলও তাঁদের মারধরের শিকার হন।
এ সময় সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিপ্রত্যাশী ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতা-কর্মীরাও এগিয়ে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। সেখানে পুলিশ ও ডিবির সদস্যরা লাঠিপেটা করে মহানগর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টার করেন। শেষ পর্যন্ত মহানগর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মমতাজউদ্দিন কলা ভবনের সামনে দিয়ে দৌড়ে গিয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে যান।
মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি সিয়াম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে নতুন রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে অ্যাডহক নিয়োগের ব্যবস্থা চলছে শুনে আমরা ক্যাম্পাসে নিয়োগ প্রতিহত করতে আসি। সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মামুন-অর-রশীদের সঙ্গে আমরা এটা নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিলাম। আমরা তাঁকে মারিনি, কিন্তু সেখানে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে।’
দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষকবৃন্দের মুখপাত্র অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, ‘উপাচার্য শেষ দিনে নিয়োগ নিয়ে একটা রক্তাক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে বিদায় নিচ্ছেন।’
ক্যাম্পাসের পরিস্থিতির বিষয়ে সাংবাদিকরা প্রক্টর মো. লুৎফর রহমানকে মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে বেলা দুইটা পর্যন্ত চাকরিপ্রত্যাশীসহ শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও পুলিশের অতিরিক্ত সদস্যদের উপস্থিতি দেখা গেছে।
অপর দিকে, সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বিদায়ী উপাচার্য ড. এম আব্দুস সোবহান বিভিন্ন পদে অবৈধ ও বিধি-বহির্ভূতভাবে জনবল নিয়োগ দিয়েছেন বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই নিয়োগের বৈধতা পাওয়ার সুযোগ নেই উল্লেখ করে বিষয়টি তদন্ত করতে একটি কমিটি গঠনের কথাও জানানো হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শামিমা বেগমের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়। তদন্ত কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, রাবি উপাচার্য প্রফেসর ড. এম আব্দুস সোবহানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে এর আগেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন তদন্ত করেছে। তদন্তে উপাচার্যের বিরুদ্ধে নিয়োগ কার্যক্রম নিয়ে আনা অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় গত বছরের ১০ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রশাসনিক কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের নিয়োগ কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখার জন্য উপাচার্যকে অনুরোধ করে।
‘তবে, ৬ মে অর্থাৎ উপাচার্যের শেষ কর্ম দিবসে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে উপাচার্য বিভিন্ন পদে অবৈধ ও বিধি-বহির্ভূতভাবে জনবল নিয়োগ দিয়েছেন বলে মন্ত্রণালয় জানতে পেরেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, যা অনভিপ্রেত।’
এছাড়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিদায়ী উপাচার্যের নিয়োগ করা জনবলের বৈধতা পাওয়ার সুযোগ নেই বলে এ সংক্রান্ত বিষয় তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিতে আছেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সদস্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর ও প্রফেসর ড. মো. আবু তাহের, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব ড. মো. জাকির হোসেন আখন্দ এবং মোহাম্মদ জামিনুর রহমান, পরিচালক (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়), ইউজিসি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, আইনের আওতায় আনার জন্য কমিটি অবৈধ নিয়োগ ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে।
এর আগে গত ৪ঠা মে সকাল ১০টা ১০মিনিটে শিক্ষকেরা উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তাঁর বাসভবনে ঢুকতে যান। এ সময় গেটের সামনে থাকা ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা বলেন, ‘না স্যার, ভেতরে ঢোকা যাবে না।’ এ বিষয় নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীদের কথা-কাটাকাটি হতে থাকে। এমন সময় ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীদের সঙ্গে থাকা এক চাকরিপ্রত্যাশী বলে ওঠেন, ‘তাহলে কিন্তু স্যার গুলি করে দিব একদম।’ এতে শিক্ষকেরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন।
গুলি করার হুমকি দেওয়া ওই চাকরিপ্রত্যাশীর নাম আকাশ বলে জানা যায়।তিনি বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন মেহেরচণ্ডী এলাকার বাসিন্দা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সঙ্গে ওঠাবসা করেন। তিনিও বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিপ্রত্যাশীদের একজন।
ঐ দিন সকাল সোয়া ১০টার দিকে শিক্ষকেরা আবার উপাচার্যের বাসভবনে ঢুকতে যান। এতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের ধাক্কা দিয়ে পেছনে সরিয়ে দেন। শিক্ষকেরা দ্বিতীয়বার ঢুকতে গেলে প্রক্টরসহ অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম ও অধ্যাপক সফিকুন্নবী ধস্তাধস্তির শিকার হন। ফলে শিক্ষকেরা পেছনে সরে এসে দাঁড়ান। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা-কর্মীরা এসে বাসভবনের গেটে তালা লাগিয়ে সামনে অবস্থান নেন।