মুক্তিযুদ্ধের সময় বরিশাল বানারীপাড়ার গাভা অঞ্চলে যে নারকীয় হত্যাকান্ড হয়েছে তা এখনও ভুলতে পারেনি এলাকাবাসী। হয়তো কোনদিনই ভুলতে পারবে না তারা। এই সমস্ত হিন্দু প্রধান অঞ্চলে তখনও মুক্তিবাহিনীর কোন তৎপরতা শুরুহয়নি। তারপরও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ, নিরীহ হিন্দুদের হত্যা করে সম্পদ নেয়ার জন্য পাকবাহিনীকে এলাকায় এলাকায় নিয়ে আসে। পাকবাহিনীর গানবোট একবার দুইবার নয় কোথাও কোথাও ৪/৫ বার পর্যন্ত হামলা চালায়। দক্ষিণ গাভা নরেরকাঠী সংলগ্ন খালপাড়ে নিরীহ মানুষের হত্যাকান্ড দেখে তৎকালীন সময়ে গাভা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক বেনুলাল দাশগুপ্ত সহ্য করতে পারেননি। এই হামলার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য গড়ে তোলেন মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বাহিনী বেনু বাহিনী। এই বাহিনীতে এক পর্যায়ে ৩/৪শ মুক্তিযোদ্ধা পর্যন্ত অর্ন্তভুক্ত ছিল। বেণু বাহিনীর প্রধান বেণু লাল দাশগুপ্ত জানায়, এই হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিল ১৯৭১ সালে মুসলিম লীগের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী আকতার উদ্দিন আহমেদ, গাভা রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান সিকদার।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বেণু লাল দাশগুপ্ত বলেন- আমি ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বিমল কৃষ্ণ দূরে নরেরকাঠী খালের পাড়ে দেখি প্রায় ৭৬ জন নরনারীকে খালের পাড়ে পাকবাহিনী নিয়ে এসেছে। এদেরকে নিয়ে এসেছে মুসলিম লীগ নেতা আক্কাস খাঁ। স্থানীয় শরৎ সমদ্দার বাড়ী বাড়ী গিয়ে মানুষদের গিয়ে বলেছে “তোমরা কাকে ভোট দিছ জানার জন্য ডাকছে-মিলিটারীরা চকলেটও খাইতে ডাকছে” দলে দলে নারী পুরুষকে লাইনে দাঁড় করানো হল। সব চুপচাপ। এমন সময় কোন এক নারীর বুক থেকে কয়েকদিনের দুগ্ধ পোষ্য শিশু কেঁদে উঠলে এক পাঠান সৈন্য নারী ও শিশুদের হট যাও হট যাও বলে সরিয়ে দিল। অর্ধশতাধিক পুরুষকে লাইনে দাড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। তৎকালীন সময়ে শুধুমাত্র গাভা নয় বহু দূরের মানুষ ও এই অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিল ফলে অধিকাংশের লাশ অচিহ্নিত অবস্থায় খালে ভেসে যায়। কিছু লাশ ঘটনাস্থলেই পরে থাকে। হত্যাকান্ডস্থল দীর্ঘদিন মানুষের রক্তে রঞ্জিত ছিল। এখানেই নারী মুক্তিযোদ্ধা শাহানারা পারভীন শোভার স্বামী রাজেন্দ্র নাথ মন্ডলকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। শোভা (বর্তমানে মৃত) এর আগে এই ঘটনা বর্ননা করেছিলেন, ‘এই দৃশ্য আমার আর সহ্য হয়নি। নিরীহ মানুষের মৃত্যু যন্ত্রনা, মৃত্যুর আগে পানির জন্য চিৎকার, আকূতি আমাকে পাগল করে দেয়। সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিবাহিনীতে যাবো। গাভা হাইস্কুলে ক্যাম্প যোগ দিলাম। এই স্থান থেকেই মুক্তিযুদ্ধের তৎপরতা শুরু হল।
হত্যাকান্ডের সময় প্রত্যক্ষদর্শী যতীন মন্ডল (৭৮) জানায়, ‘দক্ষিণ গাভার এই অঞ্চলে যে পাকবাহিনী আইবে তা আমাদের ধারণাও ছিল না। স্থানীয় মুসলিম লীগরা আশ্বাস দিছিল কিছু হবে না কিন্তু তার পরেও আচমকা পাকবাহিনী একবার দুইবার নয় কয়েকবার হামলা করে।’
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা শাহআলম ঘটনাস্থল চিহ্নিত করে বলেন, ‘সেদিন ছিল ২রা মে পিরোজপুর থেকে গান বোট নিয়ে পাকবাহিনীর একটি বড়োদল বানারীপাড়া থানা হয়ে দুই অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। একাংশ ঢোকে আলতায়। অন্য অংশ হোসেনপুর, গাভাবাজার দক্ষিণ গাভা এলাকায় হত্যাকান্ড চালিয়ে আবার মূল ঘাটিতে ফিরে যায়।’
তৎকালীন সময়ে গাভা খাল ছিল আরো বড়ো ও স্রোত বহুল। গাভা খালের প্রবাহ ধরে গানবোট নিয়ে হত্যাকান্ড ধ্বংস করতে করতে পাকবাহিনী বিস্তীর্ণ এলাকা নিশ্চিহ্ন করে দেয়। ষোড়শ, সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলায় নদী বেষ্টিত তীরে, বর্গী হায়েনাদের আক্রমনে যেভাবে বিরানভূমিতে পরিণত হয় তেমনি নদী জলা-খাল বেষ্টিত বানারীপাড়া-গাভা রামচন্দ্র পুরে সেভাবেই মানুষ মারা হয়েছিল। এসব মানুষের অধিকাংশকেই সঙ্গত কারণে চিহ্নিত করা যায়নি। কালের অমোঘ নিয়মে মৃতদেহ গুলিকে এই মাটি খাল গুলি চির আশ্রয় দিয়েছিল। তারপরেও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় পাক হত্যাকান্ডের শিকার যাদেরকে চিহ্নিত করা গেছে তারা হলেন- বিনোদমন্ডল, সুনীল মিস্ত্রী, লোকনাথ ঘরামি, রাধেশ্যাম মন্ডল, অক্ষয় মেকার, কার্তিক ঋষি, উপেন হাওলাদার, হরলাল বনিক, রংগলাল বনিক, উপেন হাওলাদারের ছেলে এবং স্ত্রী, হেমন্ত রাজের বড়ো ছেলে। এই হত্যাকান্ডের অন্যতম সহায়তাকারী শরৎ সমদ্দারকেও পাকবাহিনী গুলি করে মেরে ফেলে। হত্যাকান্ড স্থলে একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ কার্য বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন।