আদিকাল হতে, সমাজে বিভিন্ন রূপ-রঙে শ্রেণী ও বর্ণবৈষম্য বিদ্যমান! কখনো তা, প্রকট আকার ধারণ করলে সংখ্যাগরিষ্ঠের গণ বিদ্রোহে, অবস্থা বা ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করা হলেও ‘পুরাতন মদ নতুন বোতলে ঢালার’ ব্যবস্থা হয় বারংবার! শ্রেণীর পালাবদলের ইতিহাস, তার জ্বলন্ত সাক্ষী-
আদি সমাজ ব্যবস্থায় শরীর ও বুদ্ধির জোর, শাসন-শোষণের হাতিয়ার ছিল! আধুনিক যুগে ধনিক শ্রেনীর পুঁজি রক্ষার আইন কানুন! তার অদৃশ্য বেড়াজালে বাঁধা দাস, সাধারণ কৃষক শ্রমিক! অনেক বিখ্যাত দার্শনিক দাস প্রথার সমর্থন দিয়েছিলেন বিধায়, অনেকদিন এই প্রথাটি টিকে ছিল! মধ্যযুগে কন্যাশিশুকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো, দাস-দাসী রূপে মানুষ প্রকাশ্যে বিক্রির পণ্য ছিল! যুগের দাবীতে দাস প্রথার রূপ-রঙের পরিবর্তন হয়েছে মাত্র।
এই সমাজে কিছু কাল আগেও সতীদাহ প্রথার প্রচলন ছিল কিন্তু কৃষি ও পশুপালনের প্রবর্তক গ্রামীণ নারী! বাঘের খাঁচায় মানুষ দিয়ে বা দুরন্ত উটের পিঠে শিশুকে বেঁধে প্রকাশ্য খেলা বিদ্যমান ছিল! এইভাবে কালের বিবর্তনে দাস প্রথা পরিবর্তিত হয়ে শ্রমিক শ্রেণী তৈরী হয় কিন্তু আজও শ্রেণীগত কোন পরিবর্তন হয়নি। মনস্তাত্ত্বিক ভাবে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ক্রীতদাস মনে করে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রমিক তা মেনে নেয়। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র গুটিকয়েক ধনিকের কাছে বিশ্বের প্রায় সব পুঁজি ও সম্পদ! তাই তিঁনারা পৃথিবীর অলিখিত রাজা, তাঁদের কে দেয় সাজা?
আদিকাল হতে অস্তিত্ব রক্ষার্থে মানুষ দলবদ্ধভাবে বসবাস শুরু করে, আগুনের ব্যবহার শেখার পর মানুষের জীবনাচারণে আসে আমূল পরিবর্তন। আদি সমাজ ব্যবস্থায় শারীরিক সক্ষমতা ও বুদ্ধির জোরে খাদ্যের চাহিদা পূরণের সংগ্রাম! একসময় মানুষের জীবন ও কর্মে আসে বৈচিত্র্যতা, খাদ্যের সাথে অন্যান্য চাহিদাও প্রাধান্য পায়। তারই ধারাবাহিকতায়, জীবন-জীবিকা নির্বাহে বসতি গড়ার তাগিদে মিঠা জলের সহজ প্রাপ্তি ও চলাচলের সুবিধার্থে সাধারণত নদীর ধারে সৃষ্টি হয় নগর!
নগর সংঘটিত হলে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার নিবিড় অধীনস্থ হতে হয় মানুষকে! একসময়কার ধনিক শ্রেনীর জন্য তৈরি আইন কানুনের বেড়াজালে আবদ্ধ হয় সাধারণ মানুষ! এভাবেই প্রাকৃতিক সন্তান বৃহত্তর পরিমণ্ডলে দাসত্বকে আমন্ত্রণ করে, অধিকাংশ সাধারণ মানুষ হয়ে ওঠে আধুনিক দাস-অন্যদিকে; মূলত সাধারণ মানুষকে শাসন ব্যবস্থার মধ্যে আনার জন্য তৈরি হয় কোট-কাচারি, অফিস-আদালত!
আধুনিক মানুষের চাহিদা মেটাতে নানা ধরনের কল কারখানা গড়ে ওঠে, প্রয়োজন হয় শ্রমিকের। কিন্তু এই দেশটি কৃষিপ্রধান হওয়ার কারণে; প্লাবন ভূমিতে আমন ধানের চাষ হতো, অন্য ভূমিতে নানা জাতের ধান, পাট, বিভিন্ন ধরনের ডাল, সরিষা, মসনে, রাই, তিল! তাই ঢেঁকি, ঘানি ও কুঁটির শিল্প গড়ে ওঠে বাড়ি বাড়ি। আখ ও গুড় উৎপাদনের জন্য ক্ষুদ্র শিল্প গ্রামে গ্রামে বিস্তার লাভ করে!
খটখটে বৃক্ষ খেজুর ও আখের রস ও গুড় হয়, তার আবিষ্কারক কৃষক ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ তাই প্রায় সর্বত্রই চাহিদামত মাছ পাওয়া যেত! প্রকৃতি থেকে স্বচ্ছন্দে তাদের সল্প মৌলিক চাহিদা পূরণ হতো, সেই ধারাবাহিকতায় এখনও, অধিকাংশ শ্রমিক কমবেশি মৌসুমী কৃষি কাজের সাথে যুক্ত হয়! মেহনতী শ্রমজীবী মানুষ সাধারণত চরম বিপদ, বিপর্যয়ে ও নিরাপত্তাহীনতায় নাড়ির টানে মূল শিকড় ভিটা মাটির আদি গৃহ বা গ্রামে ফিরে যেতে চায়। করোনা মহামারীর কালে তার বাস্তব প্রমান!
সঙ্গত কারণে প্রকৃত কারখানা শ্রমিক বলতে যা বোঝায় তা কোনদিনই এই দেশে বিকশিত হয়নি! ফলশ্রুতিতে আট ঘন্টা কাজের দাবির আন্দোলন, দুইশত বছরের অধিক সময় আগে খুব বেশি প্রভাব পড়েনি এই অঞ্চলে। এমনকি এই আধুনিক যুগেও নয়! এখনও অধিকাংশ শ্রমিকের মৌলিক দাবী পূরণ হয় না। আট ঘন্টা কাজের বিষয়টি প্রায় ক্ষেত্রে অলীক কল্পনায়। মূল প্রসঙ্গে আসি; মে দিবসের শ্রমিক অধিকার আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল; এখান থেকে পৃথিবীর উল্টা পিঠে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে!
কি ঘটেছিল; আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের ম্যাসাকার শহিদদের স্মরণে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে, দৈনিক আট ঘণ্টার কাজের দাবিতে শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত হয়েছিল। তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের দিকে অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের ফলে, পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। সেখানে প্রায় ১০/১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়।
১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। রেমন্ড লাভিনে, ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক দ্বিতীয় কংগ্রেসে, প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়- এর পরপরই ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে, এই উপলক্ষ্যে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
প্রস্তাবে দৈনিক আটঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি আদায় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজন করতে, সকল সমাজবাদী, গণতান্ত্রিক দল ও ট্রেড ইউনিয়নে প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেই সম্মেলনে থেকে বিশ্বজুড়ে সকল শ্রমিক সংগঠন পহেলা মে বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে- পূর্বতন সোভিয়েত রাষ্ট্র, চিন, কিউবাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই মে দিবস একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। সেসব দেশে সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়। এই দিনটি বাংলাদেশে যথাযথভাবে পালিত হয়। আমেরিকা ও কানাডাতে অবশ্য সেপ্টেম্বর মাসে শ্রম দিবস পালিত হয়।
কৃষি প্রধান দেশ হিসেবে, এই দেশে কৃষিভিত্তিক শ্রম ব্যবস্থা বিদ্যমান কিন্তু আজ পর্যন্ত কৃষি শ্রমিক সংগঠিত রূপ পায়নি বা তৈরি হয়নি কোনো নিয়ম কানুন! সাধারণ বাঙালি বারংবার সংঘটিত হয়ে, আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে কিন্তু ফলাফল ভোগ করেছে বিত্তবান মানুষ! ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়। মে আন্দোলনের সমসাময়িক সময়, এ অঞ্চলে শিল্প-কলকারখানা বলতে তেমন কিছুই ছিল না। তখন কৃষিভিত্তিক সমাজ ছিল।
মে আন্দোলনেরও কিছু আগে, এই অঞ্চলে কৃষক-শ্রমিক অধিকার আদায়ে কি করেছিল, সেই অতিত আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসের দিকে, একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক; এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃষকদের জোর করে নীল চাষে বাধ্য করায় ‘নীল বিদ্রোহে’র সূচনা হয়। কৃষকদের ঘেরাও এর মুখে মি. গ্রান্ট দাবী মেনে নেন, বাধ্য হয়ে ব্রিটিশ সরকার ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ‘নীল কমিশন’ গঠন করে, ফলে অত্যাচারের মাত্রা কমলেও নীলকরেরা কৌশল পরিবর্তন করে, স্বরূপে ফিরে আসে- ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ঝিনাইদহের শৈলকূপার বিজুলিয়া কুঠির অন্তর্গত ৪৮ গ্রামের সাধারণ কৃষক নীল চাষ বন্ধ করে দেয়, অনেক ভূস্বামী, ছোট জমিদার ও জোতদার সাধারণ কৃষকের যৌক্তিক দাবীর পক্ষে সমর্থন দেন।
কৃষকেরা দেশীয় প্রযুক্তিতে ‘চেঙ্গা’ ও তার মাথায় আগুন ধরিয়ে ছুঁড়ে মারতো শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে। তাই আত্মরক্ষা ও নীল বিদ্রোহ দমন করতে নীলকরেরা মির্জাপুরের উত্তর হতে বেনীপুরের মাঝ দিয়ে একটি খাল খনন করে কালিগঙ্গা নদীর সাথে যুক্ত করে। নীলকুঠি আক্রমণকারী সাধারণ কৃষকদের নীলকরেরা ডাকাত বলে মনে করতো বিধায় খালটির নামকরণ হয় ‘ডাকুয়ার খাল’। কৃষক-শ্রমিকের এমন কতশত সহস্র, গৌরবময় ইতিকথা ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই-
তেমনিভাবে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠন, ৫২’র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯’ এর গণ অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে বাঙলার কৃষক-শ্রমিক। ৭১’ এর স্বাধীনতা সংগ্রামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশ বিষয়ক আন্দোলন সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে কিন্তু কৃষক বা শ্রমিকদের ভাগ্যের ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আজও হয়নি! কৃষিভিত্তিক শ্রমিক দারিদ্রতার দুষ্টচক্র ঘুরপাক খাচ্ছে যুগের পর যুগ!
প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবে কৃষি ব্যবস্থা স্থিতিশীল নয়! মৌসুমে ফসলের উৎপাদন মূল্য থেকে কৃষকের বাজার মূল্য কম হয়, ধান আটশত টাকা উৎপাদন খরচ, বিক্রি হয় সাতশত! কৃষকের ক্ষেতে তরমুজ পাঁচ টাকা কেজি, রাজধানীতে পঞ্চাশ! কৃষকের শ্রমের মূল্য সব সময় বাকির খাতায় থেকে যায় কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগী লাভবান হয়! এইভাবে কৃষক দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে, শ্রমিকের রূপান্তরিত হয়! যা ক্রমবর্ধমান..! কুফলে গ্রামীণ কৃষি-শিল্প সাথে সম্পর্কযুক্ত কৃষি শ্রমিকদের জীবন-জীবিকাও অনিশ্চয়তার দোলায় দোল খায়!
ইতিমধ্যে গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বিলুপ্ত হয়ে গেছে! তার বদলে ছোট মাঝারি শিল্প, কল-কারখানা গড়ে উঠেছিল, সেগুলো অধিকাংশ বন্ধ! পুঁজি বাজার অর্থনীতির যুগে, মাত্র পাঁচ ভাগ ধনিকের কাছে গোটা পৃথিবীর 95% সম্পদ! এক ভাগ মানুষ গোটা পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করছে! তাইতো বিশ্বময়; বিত্তশালী, বড় ব্যবসায়ী ও বহুজাতিক কোম্পানির কাছে কৃষি ব্যবস্থাসহ কল-কারখানা, হাট-বাজার, আইন-কানুন, সভ্যতা-ভদ্রতা, সমাজ-সংসার, রাজনীতি-অর্থনীতি, ইলেকট্রিক-প্রিন্ট মিডিয়া, পরিবহন সেক্টর, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমনকি রাষ্ট্রও, অনেক সময় সব, অনেকটাই জিম্মি!
আধুনিক অর্থশাস্ত্রের জনক অ্যাডাম স্মিথ, এর ভাবনার থেকেও অতীত পুঁজিবাদের বাজার বিকশিত হয়েছে- অন্যদিকে; বিত্তশালীদের মনোভাব ও উপদলীয় কোন্দলে শ্রমিক, সামষ্টিক বা রাষ্ট্রীয় সম্পদকে নিজের সম্পদ মনে না করার কুফলে; মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে প্রায় সব সরকারি কল-কারখানা, একে একে দেনার দায়ে বন্ধ হতে বসেছে কিন্তু বেসরকারি করণের পর ভালোই চলে।
পুরাতন অধিকাংশই ছাঁটাই হয়ে যায়! মহামূল্যবান দক্ষ মানব সম্পদ বৃহত্তম দায় হয়ে উঠে, লক্ষ লক্ষ দক্ষ শ্রমিক বেকার! শূন্যস্থান পূর্ণ করতে; কৃষি শ্রমিক দলে দলে কৃষি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, যান্ত্রিকসহ অন্যান্য কাজে যোগ দিচ্ছে। গ্রাম থেকে শহরে বসবাসের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে, জটিল অবস্থার দিকে যাচ্ছে দেশ! কৃষিনির্ভর শ্রমবাজার বিপন্ন! যতটুকু টিকে আছে তার সুফলতায়, এখনও মহা দুর্যোগের মহামারীতে মরণ দুর্ভিক্ষ হয়নি। তাই কৃষি বাজার টিকিয়ে রাখার, এখনই সময়- জনবহুল দেশে, চলাচলের জন্য যানবাহন সেক্টর উল্লেখযোগ্য সেই কারণে, এখানকার শ্রমিকদের সংগঠিত মনে হলেও, অধিকাংশ শ্রমিক নেতা, মালিক ও ক্ষমতাসীনদের প্রতিনিধি!
সঙ্গত কারণে সাধারণ শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার লঙ্ঘিত! বর্তমানে গার্মেন্টসসহ যে সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সেখানকার অধিকাংশ শ্রমিকদের নেই কোনো নিরাপত্তা ও কাজের নিশ্চয়তা! এমনকি নারী শ্রমিকদের চাকরি রক্ষার্থে গর্ভকালীন সময় লুকাতে হয়! ছুটি তো দূরে পড়ে থাক! এই করোনাকালে প্রকৃত সেইরূপ সমাজে উন্মোচিত হয়েছে! তাইতো, নিয়ম রক্ষার দিবস উদযাপন করা ছাড়া, মে দিবসের মূল চেতনা, অন্যান্য দিন প্রায় সবার মাঝে অচেতন থাকে! এমনকি উন্নত বিশ্বের দেশ সমূহে, শুভংকরের ফাঁকির মতোই, ফাঁকে শ্রমিক শ্রেণী! প্রতিনিয়ত আইনের ফাঁক গলে সুবিধা বঞ্চিত করা হয়। তালিকাভুক্ত শ্রমিকদের ওভারটাইমের অতিরিক্ত সুবিধা দিতে হয় বিধায়, বিকল্প শ্রমিক দিয়ে কর্ম সম্পাদন করে অনেক প্রতিষ্ঠান। অনেক আগে থেকেই যন্ত্রের উপর ধনিক শ্রেণীর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
করোনাকালে ভার্চুয়াল মাধ্যম সহ যন্ত্রের উপর অতি নির্ভরতার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে! বিশ্বের নামি-দামি প্রতিষ্ঠানে, রক্ত-মাংসের মানুষের বদলে, আশঙ্কাজনক হারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন যন্ত্রের ব্যবহার! একের পর এক মানুষের স্থান দখল করছে যন্ত্র মানব! উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্বমতে, শ্রমিকের শ্রম শোষণ করেই পুঁজির পাহাড় গড়ে ওঠে কিন্তু সেথায় এখন দখল করছে কম্পিউটার ও রোবট! এমনকি ড্রাইভারবিহীন গাড়ি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে! তাইতো পুঁজি কিছু অতি ধনিক শ্রেণীর কুক্ষিগত সম্পদে পরিণত হয়েছে এবং এই প্রবণতা দিন দিন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাদের রক্তমাংসের শ্রমিক না হলেও কাজ চলছে।
সনাতনী আমলের কল কারখানা বাতিল হচ্ছে, সাথে অভিজ্ঞ শ্রমিকও বাতিলের খাতায়। ভার্চুয়াল মাধ্যমে অর্থের পাহাড় গড়ে উঠছে- উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে কার্ল মার্ক্স (কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স) এর উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব মতের আশঙ্কা থেকেও, শ্রমিক শ্রেণীর উপর কল্পনাতিত ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এমনকি গোটা শ্রমিক শ্রেণী অস্তিত্বহীন হয়ে, অন্য কোনো রূপে আবির্ভূত হতে পারে। তাহলে আগামীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন যন্ত্রমানব, কিছু অপারেটর আর বিত্তবান মানুষ ছাড়া অন্য কোন শ্রেণীর অস্তিত্ব থাকবে কিনা তা নিয়ে সংশয়! তাহলে মধ্যবিত্ত ও কৃষক-শ্রমিক শ্রেণীর কি হবে? আবার কি দাসপ্রথা ফিরে আসবে নতুন রূপ ও রঙে? শোষক ও শোষিত ছাড়া অন্য কোন শ্রেণী কি আর থাকবে না? তাই নিয়ে শ্রম দিবসের সমাজ-ভাবনা…