১৮৮৬ সালের ১ মে দাবি আদায়ের দিন হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের হে মার্কেটে সমবেত হন শ্রমিকেরা। শ্রমিকেরা যে স্থানে সমবেত হয়েছিলেন, একদল পুলিশ সে স্থানটি কর্ডন করে রাখে। একপর্যায়ে পুলিশ আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। সেখানে নিহত হন ১০-১২ জন শ্রমিক। ১৮৮৬ সাল থেকে ১৯০৪ সালের আগ পর্যন্ত অনেক আলোচনা হয় বিশ্বব্যাপী, ১৮৮৬ সালে ১লা মে এর নির্মম ঘটনা নিয়ে। অবশেষে ১৯০৪ সালে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের জন্য মিছিল ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।
এ ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ১লা মে সরকারি ভাবে ছুটির দিন হিসেবে উদযাপিত হতে থাকে সাথে নানান কর্মসূচী। এবং দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমঘণ্টা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
উন্নত বিশ্বের অনেক (সব দেশে নয়) দেশে সার্থকতার সাথে কার্যত মে দিবস পালিত হয় এবং বারোমাস মে দিবসের গঠনতন্ত্র সঠিক ভাবে প্রয়োগ হয়ে আসছে। অনেক দেশে সবাই বৈধ ভাবে সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা কাজ করে থাকেন। যদি কেউ স্বইচ্ছায় ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন, সেটাকে তারা ব্ল্যাক জব বলে থাকেন এবং এটাকে ভালো চোখে দেখা হয় না। বাংলাদেশে এই দিনটি একটা সরকারী ছুটির দিন ছাড়া কার্যত কিছুই নয়। অবশ্য কিছু সংগঠন ও বাংলাদের বামদল গুলি শ্রমিকদের নিয়ে কিছু কর্মসূচি পালন করে থাকে। টিভি টকশোতে কিছু মাল্য গাঁথন কথা বার্তা হয়ে থাকে। যারা বলেন তাঁরা কিনা আবার শ্রমিকই নয়, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে থাকা নরম শরীরের কঠিন মনের কিছু মানুষ।
আমাদের দেশে প্রথম জেনারেশনের মালিক গোষ্ঠীর কুনীতি দীর্ঘকাল ধরেই এই দেশের মেহনতি শ্রমিক সমাজ প্রকৃত মজুরি, কাজের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সুষম বণ্টনব্যবস্থা, সর্বোপরি সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের সুবিধা, যেমন স্বাস্থ্য পরিচর্যা সুবিধা প্রভৃতি থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে।
বাংলাদেশে সহ পৃথিবী জুড়ে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলছে। সেই সাথে বেড়েই চলছে মালিক পক্ষের নিপীড়ন, শোষণ। শ্রমিক কর্মচারীদের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে মালিকেরা ফুলে-ফেঁপে ওঠে সম্পদের পাহাড় হয়ে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শ্রমজীবী নারীর অবস্থা ভয়াবহ। নারী শ্রমিকেরা পুরুষের পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ থাকলে তারা ন্যয্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত। দৈনিক মুজুরীতে কাজ করা নারীরা পান পুরুষের অর্ধেক কিংবা তার থেকে সামান্য একটু বেশী। অথচ কর্মক্ষেত্রে তারা পুরুষের সম সময় ও শ্রম দিয়ে থাকেন। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করা নারীরাও হন পারিশ্রমিক বৈষম্যের শিকার। কোথাও কোথায় আবার অফিসের মালিক কিংবা সহকর্মী দ্বারা ধর্ষণের শিকারও হয়ে থাকেন শ্রমজীবী নারীরা। মাতৃত্বকালীন ছুটির সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে দৈনিক মুজুরীতে কাজ করা নারী শ্রমিক।
২০২০ সালে করোনার মহামারীতে শ্রমিক দিবস পালিত হয়েছে নামে মাত্র। ২০২১ সালেও একই রকম যেতে বাধ্য। যাচ্ছে প্রতিনিয়ত শ্রমিকের দীর্ঘশ্বাস। ২০২০ সাল পৃথিবী জুড়ে করোনার মহামারিতে আমরা দেখেছি ভিন্ন রুপ। শ্রমিক নিজ কর্ম হারিয়েছে। সর্বোচ্চ সংখ্যক মালিকগণ থাকেনি শ্রমিকের পাশে। আমাদের দেশে ধনী মালিকগণ ও সরকারী চাকরিজীবীরা স্বস্তিতে ছিলেন। সরকারী চাকরিজীবীদের বেতন ভাতায় কোন প্রকার প্রভাব পরেনি। এমন কি সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্ম ক্ষেত্রে তাদের বহুদিন কাজ করতেও হয়নি লকডাউনে। যখন কিনা ছিল সাধারণ মানুষের উৎকণ্ঠা, খাদ্য সংকট ও বিভীষিকার সময়। আর শিল্পপতিরা তো আমাদের দেশে মুদ্রা মাফিয়া, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা তো……। সাথে আবার তারা সরকারী প্রণোদনা পেয়েছেন। ছোট ব্যবসায়ীরাও হয়েছেন নিঃস্ব, তাদের সাথে সাধারণ শ্রমিকেরা হয়েছেন বিধ্বস্ত।
১৮৮৬ সাল থেকে ২০২১ সাল, শ্রমের মর্যাদা, মূল্য ও ন্যায্য মজুরি, যুক্তিসঙ্গত কর্ম সময় নির্ধারণের আন্দোলনের ১৩৫ বছর। গত ১৩৫ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে মানুষের সমাজ ও সভ্যতার। এত উন্নতি-অগ্রগতি সাধিত হলেও শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর অনেক দেশে। আজ ও আমার দেশে বাধ্যতামূলক ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো হয়, শুধুমাত্র সিস্টেম ও চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে। অথচ দেশে অনেক মানুষ এখনো কর্মহীন। তাদের কাজে না লাগিয়ে, যারা কাজ করছেন তাদের নিগড়ে নিচ্ছেন মালিক পক্ষ। এই সব কর্মহীন মানুষদের কাজে লাগালে ৩ বেলা (৩*৮=২৪) কাজ করিয়ে দেশে অর্থনীতি সচল রাখতে পারতো আরো। দিন রাত ২৪ ঘণ্টা চলতে পারতো দেশের কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি, উন্নত বিশ্বের মত।
গত ৩০ বছরে প্রযুক্তি বেড়েছে হু হু করে। উন্নত বিশ্বে আবার প্রযুক্তি, মানুষকে বেকার করেছে। বিশেষ করে অটো মেশিনগুলো। যদিও এতে কম খরচে কম সময়ে অনেক কাজ হয়েছে, কিন্তু বেকার করে দিয়েছে অনেক শ্রমিক। যে মেশিন এখন এক জন মানুষ অপারেট করে, কাজ হচ্ছে ৪/৮ জন শ্রমিকের সমান। এভাবে অনেক প্রযুক্তি কাজকে সহজ করলেও বেকার করছে শ্রমিককে। এগুলো ব্যবহার হয় সকল শিল্প কল-কারখানা, গার্মেন্টস, সকল ধরনের ফ্যাক্টরিতে। এমন কি কৃষি কাজে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বেকার হয়েছেন এখান-কার শ্রমিকেরা।
তারা আবার হচ্ছে দেশান্তরী শহরময়। প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম তবে প্রযুক্তি ও মানব জীবন ও শ্রমিকের সাথে সমন্বয় না করেল অদূর ভবিষ্যতে অস্থিরতা বেড়ে যাবে ধ্বংসের দিকে। সেই সাথে অতি প্রযুক্তি নির্ভর মানব জীবন ধ্বংস করবে জলবায়ু, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, মানব জীবন ও বিশ্বব্রহ্মান্ড।
আজকাল উন্নত বিশ্বে দোকানপাটে, সুপার শপে শ্রমিক সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছি অনেক রবোটিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে। এমন কি একটা সুপারশপে ১ জন মাত্র লোক থাকেন। যেখানে ক্রেতা পণ্য ক্রয়ের জন্য বাছাই করেন, বিল প্রদানের জন্য অটোস্ক্যান মেশিনে ক্রেতা নিজেই পাঞ্চ করেন পণ্যের বারকোড, জিনিসপত্র কিনে ব্যাগ ভরে নিয়ে চলে আসেন। চলে আসার আগের বাকি থাকে বিল দেয়া, সেখানে একজন থাকে বিল সংগ্রহের জন্য। আবার কিছু জায়গায় বিল ক্রেতা নিজেই ক্রয় মূল্য পরিশোধ করেন ডেবিড কার্ড বা ক্রেডিট কার্ড পাঞ্চ করার মাধ্যমে। অথচ এখানেই এক সময় ১০ জন শ্রমিক কাজ করতেন। প্রযুক্তি মানুষের জীবন যেমন সহজ করেছে তেমনি জটিল ও করে ফেলছে। তার মধ্যে আবার মুদ্রা মাফিয়ারা ( মন্দ ব্যাবসায়ীরা ) কূটকৌশলের মাধ্যমে শ্রমিকদের বঞ্চিত করছে ন্যায্য অধিকার থেকে।
১৯৮৬ সালের ১লা মে যে শ্রমিকেরা রক্ত দিয়েছিল তখন শাসক গোষ্ঠী অনেক সংশোধন আনলেও, ধীরে ধীরে কি আমরা আবার চলে যাচ্ছি পেছনের নীতিতে? মানসিক যান্ত্রিকতায় ও প্রযুক্তির অতি ছোঁয়ায়?
পৃথিবীর এই করোনা মহাদুর্যোগ কালে সকল মানুষ হয়ে উঠুক মানবিক, যৌক্তিক, আদর্শ ও নীতিবান। বিশেষ করে শাসকগোষ্ঠী ও মুদ্রা মাফিয়ারা (ব্যবসায়ীরা)। অশান্ত বারুদের পৃথিবীতে, ফিরে পাক সাধারণ মানুষ নিজ জীবনের সাধারণ গতি, আর শ্রমিক পাক নিজের ন্যায্য অধিকার ও সম্মান।