এলার্ম ঘড়িটা রোজকার মতো টুংটাং শব্দে বেজে ওঠার সাথে সাথে অহনা ধড়-মড় করে বিছানা থেকে নেমে পড়ে। অরুনাভও এলার্ম ঘড়ির তালে তাল মিলিয়ে বলবে আর একটু থাকো না।আজ তো ছুটির দিন। হ্যাঁ, অহনাও জানে আজ ছুটির দিন,তাকে আজ অফিসে যেতে হবে না। কর্মজীবি নারীদের কাছে একদিন অফিস ছুটি পাওয়া মানে সোনার হরিণ পাওয়ার মতো। বছরের শুরুতেই সব মেয়েরা হিসেব করে এবারে সরকারি ছুটি কতদিন। সে ছুটিটা যদি সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পড়ে তা-হলে সকলের মন খারাপ হয়ে যায়।ইশ! একটা দিন নষ্ট হয়ে গেল।
কোভিডের সংক্রমণ শুরু হবার পর থেকে ঘরে সাহায্যকারীর আগমন নিষিদ্ধ করেছে অহনা। বাসায় শ্বশুর, শাশুড়ি আছেন। দুজনেই বয়স্ক তাই ঝুঁকি নিতে চায়নি। নিজের উপরে বাড়তি চাপ পড়ে তবুও অফিস একটু ঢিলেঢালা বিধায় চালিয়ে নিচ্ছে।
এই অবস্থায় অহনার সকাল শুরু হয় নিজের জন্য এক মগ গরম কফি দিয়ে। তারপরে সকালের জলখাবারের আয়োজনে লেগে পড়ে।
একটু পরেই শুদ্ধ অহনার কুড়ি বছরের ছেলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলবে মা চা দাও। আধাঘন্টা পরে সতের বছরের মেয়ে চেঁচিয়ে বলবে মা আমার লেবু গরম জল কই?
ওদিকে শাশুড়ি হাঁক পাড়বে বৌমা তোমার শ্বশুরের চা দাও। শ্বশুর নিজে চলাচল করতে পারে না, শাশুড়ির সকালটা তার দেখাশোনা করতেই চলে যায়। শাশুড়ি আবার বলেন, তাকে আজ আর রুটি ডিম দিয়ো না। এক খাবার রোজ খেতে চায় না। একটু চিড়ের পোলাও করে দিয়ো। হ্যাঁ, আমার চা’টা ঢাকা দিয়ে রেখে যাও।
এরমধ্যে অরুনাভ উঠে বলবে,শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে, একটু আদা, গরম মসলা দিয়ে ভালো করে চা বানিয়ে দিয়ো তো!
মেয়ের ফ্রুট সালাদ, ছেলের স্যান্ডুইচ, শ্বশুরের চিড়ের পোলাও, শাশুড়ির গোলারুটি, স্বামীর জন্য পরোটা ডিমভাজির পর্ব শেষ হতে হতে ওয়াশিং মেশিনে দেয়া কাপড় ছাদে মেলে দিয়ে আসা শেষ। এখন ঘর ঝাড়ু দিয়ে মুছতে হবে। সেই গত বছরের লকডাউন শুরুর পর থেকে অরুনাভকে একটা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার কেনার কথা বলে আসছে অহনা। অরুনাভ কানেই তুলছে না। বলে ঘরটা আমরা সবাই মিলে মুছে ফেলব, তুমি চিন্তা করো না। সেই আমাদের মোছাটা হয় কালেভদ্রে দুই একদি এবং যেদিন মেয়ে, ছেলে বা অরুনাভ মুছে সেদিন এই এক কাজের ফিরিস্তি চলবে সবার মুখে মুখে।
দুপুরে কী রান্না হবে শাশুড়ি তা বলে দেন এরই মধ্যে। এ বাড়িতে একবেলা রেঁধে দুইবেলা খাওয়ার চল নেই। দুই বেলায়ই গরম গরম খাবার সকলের পছন্দ। দুপুরের রান্নায় শাশুড়ি কেটেকুটে সাহায্য করে,কখনও কখনও দুই একটা পদ রান্নাও করেন।দুপুরের খাবার পরিবেশনও শাশুড়ি করেন বেশিরভাগ সময়। কারণ অফিস চলাকালে দুপুরে অহনা বাসায় থাকে না।
লকডাউনে অহনা নিয়ম করতে চেয়েছিল ছেলে মেয়ে অরুনাভ নিজের খাওয়া নিজে নিয়ে খাবে, প্লেট নিজে ধোবে। কিন্তু শাশুড়ির তাতে ঘোর আপত্তি।অগত্যা সেই অহনাকেই সকলের খাওয়া শেষে সব পরিষ্কার করে রাখতে হয়।
দুপুরে খাবার টেবিলে সবাই আছে,অসুস্থ শ্বশুরমশায়ও এ সময় হুইল চেয়ারে বসে খাবার টেবিলে। শাশুড়ি খাবার দিতে দিতে বলে, আজ তো ছুটি ছিল একটু পোলাও মাংস করতে পারতে অহনা। ছেলে মেয়ে দুটোর জন্য। খোকাও আজ দুপুরে বাসায় খাচ্ছে। সাথে সাথে অরুনাভও বলে, অহনা বিকেলে একটু লুচি মাংস করো। মাটন তো ঘরে আছে। এই লকডাউন, কোভিডের চিন্তায় কতদিন আমাদের ভালোমন্দ খাওয়াও হয় না। ছেলে মেয়ে আর একটু এগিয়ে বলে মা, কিছু মাংস গ্রিল করো।হ্যাঁ, আমরা তোমাকে সাহায্য করব। সেই সাহায্যের নমুনা তো অহনা জানে।দেখা যাবে সব রেডি করার পরে তারা আসবে কয়লার চুলায় হাওয়া করতে। সে পর্যন্ত পৌঁছাতে যে কত ধাপ পেরোতে হয় তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।
অহনা নিজে দুপুরের খাওয়ার আগেই তাই ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে রাখে। মসলাও রেডি করে রাখে। লুচির ময়দাটাও ময়ান দিয়ে রাখে। আগে বললে মাংসটা মাখিয়ে রাখতে পারত। কিন্তু এখন তো ছাড়াতে সময় লাগবে।
সকলের খাওয়া শেষ হলে,খাবার টেবিল,থালাবাসন সব পরিষ্কার করে,অহনা স্নানে যায়। এইসব কাজ করে স্নান না করলে অহনার ভালো লাগে না।
স্নান সেরে নিজের ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। অরুনাভ তখন দিব্যি মোবাইল নিয়ে ফেসবুকে ব্যস্ত। মোবাইল থেকে মুখ না তুলেই বলে, যাওয়ার সময় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যেও।অহনা মনে মনে ভাবে,এরকম সময়ে অরুনাভ অপলকে তার দিকে চেয়ে থাকত। অহনা যে এখনও খায়নি তাও একবারের জন্য খেয়াল হয়নি অরুনাভের। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত সে।একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস আর একটু চেপে রেখে নিজের কাজে যায় সে। এবার নিজের খাবার নিয়ে টেবিলে বসে অহনা। সব ঠান্ডা জল হয়ে গেছে। তবুও তাই পেটপুরে খায়, খাওয়ার পরে অনেক কাজ করতে হবে। যে কাজগুলো পেটে খিদে থাকলে করা যাবে না।
অহনার বিয়ে হয় খুব ধুমধাম করে, ছেলে মেয়ে দুজনেই পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। বন্ধুত্ব, প্রেম পরিণয় সবই ছকে বাঁধা নিয়মেই হয়। সময়ের প্রবাহে দুজনের জীবনের চেনা ছবির গ্রাফের বদল ঘটতে থাকে অগোচরেই। মাতৃত্বকালীন ছুটি, বিভাগীয় পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারা, নির্দিষ্ট সময়ের পরে অফিসে সময় দিতে না পারা সহ বিভিন্ন কারণে একসময় অহনা কর্মজীবনে অরুনাভ’র থেকে পদোন্নতিতে পিছিয়ে পড়ে।
সে’সব নিয়ে অহনা আজকাল আর ভাবে না। কিন্তু আজ পয়লা মে ঘটা করে শ্রমিক দিবস পালন করা হয়, কল কারখানা সব বন্ধ থাকে।খেটে খাওয়া শ্রমিকদের নিয়ে সভা, সমাবেশ করা হয়।তারই ধারাবাহিকতায় সারা বিশ্বের সকল অফিস আদালত শ্রমিক দিবসের ছুটি পেল,সেও তার কর্মস্থল থেকে ছুটি পেল।
এসব ভাবনার মাঝেই একসময় খাওয়া শেষ হয়। খেয়ে সব গুছিয়ে ফেলতে ফেলতে মন চাইছিল একটু বিছানায় গা এলাতে। সূর্য ওঠার আগেই তো তার দিন শুরু হয়েছিল।একটু পরেই আবার সকলের চায়ের তেষ্টা পেয়ে যাবে।তাই বিছানায় গড়ানোর ইচ্ছেটা মুলতুবি রেখে, নিজের জন্য এককাপ কফি করে নিয়ে বসার ঘরে গিয়ে টিভি খুলে বসে। একটু রিলাক্স হবার জন্য স্টার জলসার সিরিয়ালে চোখ রাখে। চোখে দেখে বিদেশে ডিগ্রি নিয়ে আসা পশ্চিমি পোশাকে স্বচ্ছন্দ মেয়েটি কত সহজে শাড়ি গয়নায় মুড়ে নিয়ে,স্বামী,পরিবারের মঙ্গল কামনায় ব্রত করছে,আবার স্বামী নামক ধনকুবের পুরুষটি তার স্বামী হবার আগে আর একজন নারীর স্বামী থাকা সত্তেও তাকেই তার অঞ্চলে বাঁধার জন্য তার বিদেশি ডিগ্রির বিদ্যা ব্যবহার করছে নানারকম তুকতাক, সিঁড়িতে তেল ফেলা সহ, পঞ্চব্যঞ্জন রান্নার মতো কাজে। রান্না করা, পূজা করায় অসুবিধে নেই। অসুবিধা হলো এই কাজ করার উদ্দেশ্য নিয়ে। অহনা সেই হিসেবটা মেলাতে পারে না আজকাল।
আর এসব দেখতে দেখতে মনে হলো যতদিন না মেয়েরা নিজেকে নিজে সম্মান করতে শিখবে ততদিন অহনাদের জীবনে পয়লা মে বলে কিছু থাকবে না। বছরের তিনশত পয়ষট্টি দিনই তাদের একই রকম হিসেবে চলবে। ছকে বাঁধা নিয়মে পয়লা মে বিশ্ব শ্রমিক দিবসের ছুটি আসবে। কিন্তু অহনার মতো মুজুরিবিহীন শ্রমিকদের কোনো দিবস নেই।তাই তাদের কোনো ছুটিও পাওনা নেই।
সকল শ্রমজীবি মানুষের কল্যাণ হোক। বিশ্বময় চলমান সকল বৈষম্যের অচলায়তন ভেঙে যাক। এরকম গল্প যেন লিখতে না হয়।